বুধবার, ২৭ নভেম্বর ২০২৪, ০৫:৩২ পূর্বাহ্ন
নিজস্ব প্রতিবেদক: ‘কমিশনার স্যার যে উদ্যোগ নিয়েছেন তাতে আমরা খুশি। রক্ষক যদি ভক্ষক হয়, অর্থাৎ খোদ পুলিশই যদি মাদক সেবন করে এবং মাদক কারবারিদের থেকে ঘুষ নেয়, তাহলে সমাজ থেকে মাদক নির্মূল সম্ভব হবে না।’
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) মাঠপর্যায়ের সদস্যরা বলছিলেন কথাগুলো। গত রবিবার দুপুরে রাজধানীর মগবাজার এলাকায় দায়িত্বরত অন্তত ১৩ জন পুলিশ সদস্যের সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। মাদকাসক্তির কারণে ডিএমপির ২৬ সদস্য চাকরিচ্যুতির বিষয়ে গণমাধ্যমে আসা খবর নিয়ে আলোচনা করছিলেন তাঁরা। এ সময় স্বতঃপ্রণোদিত হয়েই তাঁরা এসব কথা বলেন।
ডিএমপি সদর দপ্তর সূত্রে জানা গেছে, মাদকের বিরুদ্ধে সরকারের শূন্য-সহিষ্ণু নীতি বাস্তবায়নে পুলিশ নিরলস কাজ করছে। এর ধারাবাহিকতায় মাদক সেবন ও এর কারবারে জড়িত পুলিশ সদস্যদের চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। এর মধ্যে ডোপ টেস্টে মাদকাসক্তি প্রমাণ হওয়া ২৬ পুলিশ চাকরি হারাচ্ছেন। তবে গত রবিবার পর্যন্ত সংখ্যাটি বেড়ে ৪০ জনে দাঁড়িয়েছে। তাঁদের বিরুদ্ধেও একই ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।
ডিএমপি কমিশনার মোহা. শফিকুল ইসলাম বলেন, এই শাস্তি দেওয়ার আগে সবাইকে সতর্ক করা হয়েছে। যাঁরা নিজেদের শোধরায়নি তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। মহানগর পুলিশের মাদকাসক্ত কোনো সদস্য আমার কাছে এলে স্বাভাবিক জীবনে ফেরাতে চিকিৎসার ব্যবস্থা করব। কিন্তু আমার এই আহ্বানে সাড়া দিয়ে এ পর্যন্ত কেউ আসেনি। এ জন্য ডিএমপি থেকে উদ্যোগ নিয়ে ডোপ টেস্ট করানো হচ্ছে।’
জানা গেছে, মাদকবিরোধী অভিযানের অংশ হিসেবে নিজেদের মধ্যে শুদ্ধি অভিযান শুরু করেছে পুলিশ সদর দপ্তর। এর অংশ হিসেবে দুই মাস আগে ডিএমপি সদস্যদের ডোপ টেস্ট শুরু হয়। এই উদ্যোগকে প্রশংসনীয় হিসেবে উল্লেখ করেছেন বিশ্লেষকরা। মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগের অধ্যাপক ড. ওমর ফারুক কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘উদ্যোগটি অবশ্যই প্রশংসার দাবি রাখে। সারা দেশেই পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে এ ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে। পুলিশের ঊর্ধ্বতনদের মধ্যে কেউ মাদকাসক্ত থাকলে, তাঁর বা তাঁদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।’
সূত্র জানায়, ডিএমপির সদস্যদের মধ্যে মাদকাসক্ত হিসেবে সন্দেহভাজনদের তালিকা করে সিআইডির ল্যাবে তাঁদের রক্ত ও প্রশ্রাবের নমুনা পরীক্ষা করা হয়। প্রথম ধাপে ১০৫ জন সদস্যের ডোপ টেস্টে ৪০ জনই মাদকাসক্ত হিসেবে চিহ্নিত হয়েছেন। এরই মধ্যে ২৬ জনের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা হয়েছে। তাঁদের মধ্যে একজন ট্রাফিক সার্জেন্ট, চারজন এসআই, তিনজন এএসআই, একজন নায়েক ও ১৭ জন কনস্টেবল। তাঁরা ডিএমপির বিভিন্ন ইউনিটে কর্মরত। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) একজন, পাবলিক অর্ডার ম্যানেজমেন্টের (পিওএম) চারজন, কল্যাণ ও ফোর্সের চারজন, ডিপ্লোম্যাটিক সিকিউরিটি জোনের সাতজন এবং বাকিরা পল্লবী, আদাবর, খিলগাঁও, উত্তরখান ও গেণ্ডারিয়া থানায় কর্মরত। বাকি ১৪ জনও মাঠপর্যায়ে কর্মরত। তাঁদের বিরুদ্ধেও এই ব্যবস্থা প্রক্রিয়াধীন।
যেভাবে শুরু : সম্প্রতি ডিএমপির বিভিন্ন থানাসহ অন্যান্য বিভাগের সদস্যদের আচরণে সংশ্লিষ্ট বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সন্দেহ হয়। এরপর প্রথম দফায় সাতজনের ডোপ টেস্ট করলে বেশির ভাগের রেজাল্ট পজিটিভ আসে। এরপর ওই ইউনিটের আরো ১৮ জনের নমুনা পরীক্ষা করলে একজনের পজিটিভ আসে। এতে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সন্দেহ বেড়ে যায়।
এ ছাড়া কয়েক মাস আগে রাজধানীর তেজগাঁও ট্রাক স্ট্যান্ড ও রেললাইন এলাকায় মাদকবিরোধী অভিযান চালিয়ে ২১ মাদক কারবারিকে আটক করে থানা পুলিশ। তাঁদের জিজ্ঞাসাবাদে সংশ্লিষ্ট থানা পুলিশের মাদক কারবারে সংশ্লিষ্টতার তথ্য মেলে। তাঁদের সহযোগিতাকারী হিসেবে শিল্পাঞ্চল থানার এক এসআইয়ের নাম সামনে আসে। এরপর ডিএমপি কমিশনারের নির্দেশে মাদকাসক্ত ও মাদক কারবারে সংশ্লিষ্ট পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে খোঁজ নেওয়া শুরু হয়।
সম্প্রতি সদর দপ্তর থেকে প্রতিটি ইউনিট ও বিভাগের উপকমিশনারদের চিঠি দিয়ে সন্দেহভাজন মাদকাসক্ত সদস্যদের তালিকা করতে বলা হয়। বিভিন্ন ইউনিট ও বিভাগের উপকমিশনাররা তালিকা পাঠালে তা যাচাই-বাছাই করে ১০০ জন সন্দেহভাজনের একটি তালিকা করা হয়। পরে তাঁদের ডোপ টেস্টের আওতায় আনা হয়। তবে এই ৪০ জনই শেষ নয়। দ্বিতীয় ধাপেও একই আদলে পুলিশ সদস্যদের ডোপ টেস্ট করা হবে। পরীক্ষায় পজিটিভ হলেই তাঁকে শাস্তির মুখোমুখি হতে হবে।
সূত্র জানায়, ডিএমপি কমিশনারের নিজস্ব গোয়েন্দা সংস্থা (ইন্টেলিজেন্স এনালাইসিস ডিভিশন-এনআইডি) পুলিশের মাদক সেবন ও মাদক কারবারে সম্পৃক্ততার বিষয় তদন্ত করছে। ডিএমপির বিভিন্ন বিভাগে দায়িত্বরতদের অনেকে মাদকাসক্ত হওয়ার পাশাপাশি মাদক কারকারিদের সঙ্গে সখ্য গড়ে আর্থিক সুবিধা নিয়ে থাকে বলেও তদন্ত উঠে এসেছে। তাঁদেরও তালিকা করা হচ্ছে।