শনিবার, ১৮ মে ২০২৪, ০২:৩৩ অপরাহ্ন

পূজা-অর্চনা ও স্বজন হারাদের আহাজারিতে পালন হলো নৌকাডুবির এক বছর

পূজা-অর্চনা ও স্বজন হারাদের আহাজারিতে পালন হলো নৌকাডুবির এক বছর

এন এ রবিউল হাসান লিটন, পঞ্চগড় জেলা প্রতিনিধি: পঞ্চগড়ের বোদা উপজেলার মাড়েয়া বামনহাট ইউনিয়নে করতোয়া নদীর আউলিয়ার ঘাটের নৌকা ডুবির এক বছর পূর্ণ হলো। সোমবার সকাল থেকে বৃষ্টিকে উপেক্ষা করে আউলিয়ার ঘাটে নৌকা ডুবির ঘটনায় নিহতদের আত্মীয় স্বজনরা এসে জোর হয় নদীর ঘাটে। আত্মীয় স্বজনরা নিহতদের আত্মার শান্তির জন্য জারজার মত করে পূজা-অর্চনা করে। এসময় একে অপরকে জরিয়ে ধরে আহাজারি করতে দেখা যায়।২০২২ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর (রবিবার) দুপুরে করতোয়া নদীর আউলিয়ার ঘাট দিয়ে বদেশ্বরী মন্দিরের মহালয়া অনুষ্ঠানে যাওয়ার সময় নৌকা ডুবিতে ৭২ জনের সলিল সমাধি ঘটে। স্মরণকালের ভয়াবহ নৌকা ডুবির ঘটনার পরই উদ্ধার অভিযানে নামে ফায়ার সার্ভিসের ডুবুরি দল ও স্থানীয় উদ্ধারকারীরা। একে একে উদ্ধার করা হয় ৭১টি নিথর দেহ। এ ঘটনায় বোদা উপজেলার সাকোয়া ইউনিয়নের ডাঙ্গাপাড়া গ্রামের খগেন্দ্রনাথের ছেলে সুরেন নিখোঁজ রয়েছে।একই উপজেলার বড়শশী ইউনিয়নের বোদেশ্বরী মন্দিরে মহালয়ার অনুষ্ঠানে যোগ দিতে প্রায় ১০৫ জন যাত্রী নিয়ে একটি নৌকা নদী পার হওয়ার সময় মাঝপথে ডুবে যায়। এসময় অনেকে সাঁতরে উঠতে পারলেও নিখোঁজ হন নারী-শিশুসহ ৭২জন পূর্ণার্থী।দুর্ঘটনার পর সরকারি-বেসরকারি সহায়তায় নিহতের পরিবারগুলো ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করলেও সেইসব পরিবারগুলো আজও খুঁজে ফিরছে স্বজন হারানো স্মৃতি। দুর্ঘটনার পরই জেলা প্রশাসন, পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিস তিনটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। এর মধ্যে জেলা প্রশাসনের তদন্ত প্রতিবেদনে ওই দুর্ঘটনায় ঘাট ইজারাদারকে দায়ী করে প্রতিবেদন দাখিল করে।অন্যদিকে নৌযানের আকার ও আকৃতি বিবেচনায় ধারণক্ষমতার বেশি যাত্রী বহন, ইজারা চুক্তি মোতাবেক নিরাপত্তা সামগ্রী ও জীবন রক্ষাকারী সরঞ্জাম না রাখা এবং চালকের অদক্ষতাকে দায়ী করে ২০২৩ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি ঢাকার স্পেশাল মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে ঘাট ইজারাদার ও দুইজন মাঝিসহ তিনজনের বিরুদ্ধে নৌপরিবহন অধিদপ্তরের মুখ্য পরিদর্শক শফিকুর রহমান বাদী হয়ে একটি মামলা দায়ের করেন। পরে ঐ মামলায় ঘাট ইজারাদার আব্দুল জব্বার এবং মাঝি বাচ্চু মিয়াকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তারা এখনো কারাগারে আটক এবং অপরজন পলাতক রয়েছেন।বোদা উপজেলার শালডাঙ্গা ইউনিয়নের ছত্রশিকারপুর গ্রামের ৩ বছরের শিশু দীপু ফেলফেল করে তাকিয়ে থাকে। তার দূ’চোখ শুধু বাবা-মা কে খুচ্ছে। বলতে পারেনা বা জানতেও পারেনা তার বাবা-মা কেন তার থেকে দুরে। কেন বাবা-মা অভিমান করে আছে। তার প্রতিটা দিয়ের দুরন্তপনার সাথী ছিল তার মা। মাকে ছাড়া তার একটুও চলতো না। দুই ভাইয়কে ফাঁকি দিয়ে বাবা-মায়ের সঙ্গে মহালয়া দেখতে গিয়েছিল সে। নিজে ফিরে এসেছে ঠিক ঐ। হারিয়ে ফেলেছে বাবা-মাকে। মায়ের মরদেহ ফিরে আসলেও বাবার খোঁজ এখনও মিলেনি। নৌকাতেই মা-বাবার সঙ্গে মহালয়া দেখতে যাচ্ছিল দীপু। নৌকাডুবিতে নিজে বেঁচে ফিরলেও মা রুপালি রানী বাবা ভুপেন্দ্র নাথ ফিরেছে লাশ হয়ে।দীপুর দাদি লক্ষ্মী রানী বলেন, আমার একটা মাত্র ছেলে। ছেলে-বউমা নাতিসহ মহালয়া দেখতে গেছিল। নাতিটাকে লোকজন উদ্ধার করে বাঁচাইছে। তিনটা নাতি নিয়ে এখন খুব কষ্টে দিন পার করছি।নিখোঁজ স্বামী সরেন্দ্রনাথ রায়ের ছবি নিয়ে আজও বিলাপ করেন ডাঙ্গাপাড়া এলাকার শান্তি রাণী। শান্তি রাণী বলেন, মানুষটা সেদিন দুপুরে সাইকেল নিয়ে বেয়াইসহ মহালয়ার অনুষ্ঠানে গেলেন। পরে বিকালে শুনতে পাই নৌকাডুবি হয়েছে। তিনি হয়তো দূরের পথ ঘুরে বাড়ি ফিরছেন এই আশায় ছিলাম। কিন্তু এক দিন, দুই দিনও এক বছর হয়ে গেল আজও ফিরে পেলাম না।’উপজেলার মাড়েয়া ইউনিয়নের বটতলী এলাকার উজ্জ্বল কুমার রায় বলেন, ‘গত বছর ভয়াবহ নৌকাডুবির ঘটনায় আমার বাবা-মাসহ পরিবারের ছয়জন মারা যান। এখন আফসোস করা ছাড়া আমাদের আর কিছুই করার নেই। তবে আমরা ভেবেছিলাম, যাদের অবহেলায় ঘটনাটি ঘটেছে, তাদের বিচার হবে। কিন্তু কিছুই হয়নি।মাড়েয়া বটতলী এলাকার ষাটোর্ধ্ব ননী বালা বলেন, “মহালয়ার পূজা দিতে গিয়ে আমার উপার্জনক্ষম একমাত্র ছেলে জগদিশ চন্দ্রকে হারিয়েছি। জগদিশের দুই অবুঝ শিশু স্বন্দীপ আর প্রিয়াংকা অনাথ হয়েছে। নৌকাডুবিতে জগদিশের সঙ্গে থাকা ভাতিজা সেন্টু চন্দ্রও মারা গেছে। তাদের কথা মনে হলেই নিজেকে সামলাতে পারি না। অনেক কষ্ট বুকে চেপে অনাথ ছোট দুই বাচ্চাকে নিয়ে বেঁচে আছি।”ফুটকিবাড়ীর কৃষ্ণ কুমার বলেন, আমার বড় ভাইসহ পাঁচজন নৌকাডুবিতে মারা যান। চোখের সামনে এতগুলো মানুষ মারা গেল। সেদিনের কথা মনে পড়লে এখনও বুকটা কেঁপে ওঠে।নৌকাটিতে ছিলেন বড়শশী এলাকার তারা মিঞা। তিনি বলেন, আমারও বাঁচার কথা ছিল না। ১৭-১৮ ঘণ্টা পর রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আমার জ্ঞান ফেরে।নৌকাডুবির ঘটনায় বেঁচে ফেরেন মাড়েয়া বামনহাট ইউনিয়নের সর্দারপাড়া এলাকার ইশিতা কলি রায় ও তর্পণ নারায়ণ রায় নামে দুই ভাইবোন। সেদিনের কথা মনে হলে আজও আঁতকে ওঠেন তারা। ইশিতা বলেন, ‘সেদিন ছোট ভাইসহ মহালয়ার অনুষ্ঠানে যাচ্ছিলাম। নদীর মাঝপথে নৌকাডুবি হলে পানিতে পড়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। পরে ছোট ভাই সাঁতরে নদীর পাড়ে নিয়ে আসে। সেখান থেকে হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেদিনের ঘটনা মনে হলে আজও গা শিউরে ওঠে, ভয়ে আঁতকে উঠি।স্থানীয় সমাজকর্মী মো. সারোয়ার হোসেন বলেন, সেদিনের সে ঘটনা মনে পরলে এখনো আঁতকে উঠি। আমার দু’হাত দিয়ে অনেক মরদেহ উদ্ধার করি। আউলিয়ার ঘাটে একটি সেতু থাকলে হয়তো এত বড় দুর্ঘটনা ঘটত না।দুর্ঘটনার পর এক অনুষ্ঠানে রেলমন্ত্রী এডভোকেট নূরুল ইসলাম সুজন আউলিয়া ঘাটে একটি ওয়াই আকৃতির ব্রিজ নির্মাণের ঘোষণা দেন।একনেকে ব্রিজ নির্মাণের প্রকল্পটি পাস হয়েছে। গত ডিসেম্বরে ব্রিজ নির্মাণের কাজ শুরু হওয়ার কথা। যা আজও আলোর মুখ দেখেনি।স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর-এলজিইডির নির্বাহী প্রকৌশলী মাহমুদ জামান জানান, বোদা উপজেলার করতোয়া নদীর আউলিয়া ঘাটে ১১৬ কোটি টাকা ব্যয়ে ৮৯১ মিটার দৈর্ঘ্যরে একটি ওয়াই আকৃতির ব্রিজ নির্মাণের প্রক্রিয়া শেষের দিকে।টেন্ডার প্রক্রিয়া শেষ করে তা অনুমোদনের জন্য ঢাকায় পাঠানো হয়েছে। এটি অনুমোদন হলেই ব্রিজ নির্মাণের কাজ শুরু করা হবে।

ভালো লাগলে নিউজটি শেয়ার করুন

© All rights reserved © 2011 VisionBangla24.Com
Desing & Developed BY ThemesBazar.Com