রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ০৮:১৩ অপরাহ্ন
আন্তর্জাতিক ডেস্ক: ১৯৪৮ থেকে ২০২১ সাল। এই ৭৩ বছরে ফিলিস্তিনিরা যত কোণঠাসা হয়েছে, নিজ ভূমিভিটা থেকে বিতাড়িত হয়েছে এবং বেঘোরে প্রাণ হারিয়েছে, ইসরায়েলের শৌর্যবীর্য তত বেড়েছে। আজ গাজা ও পশ্চিম তীর নামের বিচ্ছিন্ন দুটি ভূখণ্ডে কোনোমতে টিকে আছে একদল ফিলিস্তিনি, বাকিদের বেছে নিতে হয়েছে আশপাশের দেশগুলোতে শরণার্থীর জীবন—এর বিপরীতে ফিলিস্তিনি ভূমি গ্রাস করে ইসরায়েল যেমন আয়তনে স্ফীত হয়েছে, তেমনি বিশ্বের অন্যতম সামরিক শক্তিধর রাষ্ট্রেও পরিণত। অথচ জাতিসংঘের প্রস্তাব অনুসারে ফিলিস্তিনেরও স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার কথা। এই কথা কি বিশ্বের মনে আছে?
প্রতিবার ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে ইসরায়েলের চালানো আগ্রাসনের সময় অবশ্য প্রশ্নটি সামনে আসে। নিষ্পাপ শিশু, ঘরকন্না করা সাধারণ নারী ও নিরপরাধ মানুষের মৃত্যুর মিছিল দেখে বিশ্ববিবেক কিছুটা নড়েচড়ে ওঠে! ব্যস, এটুকুই। এরপর আবার হারিয়ে যায় ফিলিস্তিনিদের ন্যায্য দাবি, আত্মিক চাওয়া—স্বাধীনতার প্রশ্নটি। চলমান ইসরায়েলি বাহিনীর লাগাতার হামলায় এখন পর্যন্ত ৪১ শিশুসহ দেড় শতাধিক ফিলিস্তিনির প্রাণহানিতে প্রশ্নটি আবার আলোচনায়। এবং যথারীতি তা হারিয়ে যেতেও হয়তো সময় নেবে না। কেননা এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র জানিয়ে দিয়েছে, আত্মরক্ষার অধিকার ইসরায়েলের আছে। অতএব, যত দোষ নন্দ ঘোষ ফিলিস্তিনের!
অথচ ইসরায়েল এবার শুধু গাজার বেসামরিক স্থাপনাকেই লক্ষ্যবস্তু করেনি, আন্তর্জাতিক একাধিক গণমাধ্যমের একটি ভবনও গুঁড়িয়ে দিয়েছে। ‘হামাসের সামরিক সম্পদ’ ভবনটিতে আছে, এমন দাবি করে হামলা চালানোর আগে মাত্র এক ঘণ্টা সময় দেওয়া হয়েছিল। অতিরিক্ত ১০ মিনিট চেয়ে ইসরায়েলি এক গোয়েন্দা কর্মকর্তাকে নাকি বারবার অনুরোধ করেছিলেন ভবনমালিক, কর্ণপাত করা হয়নি। এপি, আলজাজিরাসহ বেশ কয়েকটি গণমাধ্যমের কার্যালয়, বেসরকারি অফিস ও আবাসিক ফ্ল্যাট থাকা ‘জালা টাওয়ার’ নামের ভবনটি মাটিতে মিশিয়ে দেওয়ার প্রতিক্রিয়ায় হোয়াইট হাউসের প্রেসসচিব বলেছেন, সাংবাদিক ও স্বাধীন সংবাদমাধ্যমের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য ইসরায়েলকে বলা হয়েছে।
গাজার নেতৃত্বে থাকা তথাকথিত সন্ত্রাসীগোষ্ঠী হামাসের সঙ্গে সংঘাতে জড়িয়ে গণমাধ্যমের কার্যালয়ে হামলা বৈধতা পেতে পারে কি না—এমন প্রশ্নও যখন জোরালোভাবে ওঠে না, তখন ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু যুদ্ধের সিদ্ধান্তে অনড় থাকবেন, সেটাই স্বাভাবিক। এ কারণে হেস্তনেস্ত না হওয়া পর্যন্ত হামাসের বিরুদ্ধে অভিযান চলবে বলে জোর গলায় ঘোষণা করতে পারেন তিনি।
গত সোমবার থেকে চলমান এ সংঘাতে জাতিসংঘসহ বেশ কয়েকটি দেশ উদ্বেগ জানিয়েছে। অস্ত্র বিরতির আহ্বান তাদের সবার। গতকাল রবিবার এ নিয়ে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে জরুরি বৈঠক ডাকা হয়। বিশ্বজুড়ে ইসরায়েলের নিন্দা-ধিক্কারে রাজপথে নেমেছে বিবেকবান মানুুষ। অবশ্য এসবে এতটুকু হেলদোল নেই ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রীর। তাঁর সাফ কথা, ‘আমরা কোনো অপরাধ করিনি। যারা আমাদের আক্রমণ করছে, যাবতীয় দায় তাদের।’ সুতরাং ঈদের দিনও গাজায় হামলা চালিয়ে বেসামরিক মানুষের প্রাণহানিকে হামাসকে জব্দ করার অংশ বলেই মনে করে।
নেতানিয়াহুর দাবি, ‘হামাসের মতো ইচ্ছাকৃত সাধারণ নাগরিকদের আমরা নিশানা করছি না। নিরীহ নাগরিকদের এড়িয়ে সন্ত্রাসীদের ওপরই সরাসরি হামলা করছি।’
বলাই বাহুল্য, কোনোবারই সংঘর্ষে ইসরায়েলের গায়ে সেভাবে আঁচ লাগে না। বিপরীতে শয়ে শয়ে, এমনকি হাজার হাজার বেসামরিক ফিলিস্তিনির হতাহত হওয়ার সাক্ষী বিশ্ব। এবারও হামাসের রকেট হামলায় ইসরায়েলি প্রাণহানির সংখ্যা ধর্তব্যের মধ্যে নয়। কেন?
রকেট হামলা ঠেকানোর জন্য সামরিক শক্তিধর ইসরায়েলের হাতে রয়েছে ‘আয়রন ডোম’। অত্যাধুনিক এই প্রতিরক্ষাব্যবস্থা বিশেষভাবে স্বল্প পাল্লার হুমকির বিরুদ্ধে জবরদস্ত কার্যকর। এ কারণে যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তায় ইসরায়েলের রাফায়েল অ্যাডভান্সড ডিফেন্স সিস্টেমস ও ইসরায়েল অ্যারোস্পেস ইন্ডাস্ট্রিজের তৈরি আয়রন ডোম নাকি হামাসের ছোড়া ৯০ শতাংশ রকেটই মাটিতে পড়ার আগেই আকাশে ধ্বংস করে দিচ্ছে। এমন প্রতিরক্ষাব্যবস্থাসহ বিশ্বের অন্যতম সশস্ত্র ও শক্তিধর ইসরায়েলি বাহিনীর আক্রমণে বেসামরিক ফিলিস্তিনিদের গণহারে মৃত্যু তাই ‘স্বাভাবিক’ ঘটনা হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু এ অবস্থা আর কত দিন?