শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ০৬:১৩ পূর্বাহ্ন
“মোরা একই বৃন্তে দু’টি কুসুম ,হিন্দু মুসলমান
মুসলিম তার নয়নমণি হিন্দু তাহার প্রাণ।”
বিদ্রোহী কবি, জাগরণের কবি, যৌবনের কবি, মানবতার কবি, আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম। এক অনবদ্য ইসলামি ভাবধারার মুসলিম পরিবারে জন্ম নেয়া নজরুল তাঁরই ইচ্ছায় এখন চির নিদ্রায় শায়িত আছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদের পাশে।
যিনি একদিকে লিখেছিলেন, “গাহ নাম কৃষ্ণ নাম, কৃষ্ণ নাম..।” “ব্রজগোপী খেলে হরি, খেলে আনন্দ নবঘন শ্যাম সনে..।”
অন্যদিকে লিখেছেন, “আহমেদের ঐ মিমের পর্দা উঠিয়ে দেখ মন, আহাদ সেথায় লুকিয়ে আছে..।” কিংবা “মসজিদেরই পাশে আমার কবর দিও ভাই, যেনো গোরে থেকে মোয়াজ্জিনের আজান শুনতে পাই..।”
অসংখ্য ইসলামি সংগীত, কবিতা,গজল, ভজন, কীর্তন, শ্যামা সংগীত , নজরুলের বিয়ে সংসার, তার জীবন প্রবাহ সবকিছু বিশ্লেষণ করে আমরা নজরুলকে পেয়েছি একজন আপাতমস্তক অসাপ্রদায়িক চেতনার মানুষ হিসেবে। আশৈশব যিনি ছিলেন একজন খাঁটি মুসলমান, একদিকে সুর করে কোরান তিলাওয়াত, আজান দিয়ে নামাজ পড়া, নিয়মিত মসজিদে যাওয়া, অন্যদিকে লেটোদলে গান গেয়ে বেড়ানো নজরুল হিন্দু মুসলিম উভয় সংস্কৃতিতে লালিত হয়ে প্রতিটি ধর্মের অনুসৃত অন্তর্নিহিত রসাচ্ছাদন করে নিজেকে সকল ধর্ম জাতপাতের ঊর্ধ্বে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছেন।
ধর্ম বর্ণ জাতপাত নিয়ে দ্বিধাবিভক্ত ভারতবর্ষে কবি সোচ্চার কণ্ঠে উচ্চারণ করলেন–
“জাতের নামে বজ্জাতি সব জাত-জালিয়াৎ
খেলছ জুয়া,
ছুঁলেই তোর জাত যাবে? জাত ছেলের
হাতের নয়তো মোয়া।
হুঁকোর জল আর ভাতের হাঁড়ি ভাবলি এতেই জাতির জান,
তাইত বেকুব, করলি তোরা এক জাতিকে একশ’-খান।”
“কেউ বলেন, আমার বাণী যবন কেউ বলেন কাফের, আমি বলি ও দুটোর কেনটাই নই আমি কেবল মাত্র হিন্দু-মুসলমানকে এক জায়গায় ধরে এনে হ্যান্ডসেক করাবার চেষ্টা করেছি গালাগালিকে গলাগলিতে পরিণত করার চেষ্টা করেছি। সে হাতে হাত মেলান যদি হাতাহাতির চেয়ে অশোভন হয়ে থাকে তাহলে ওরা আপনি আলাদা হয়ে যাবে, আমার গাঁটছড়ার বাঁধন কাটতে তাদের কোনো বেগ পেতে হবেনা। কেননা এক জনের হাতে আছে লাঠি আর একজনের আস্তিনে আছে ছুরি।”
এখানে তিনি একদিকে উভয় ধর্মের সম্প্রীতির আহ্বান যেমন জানিয়েছেন অন্যদিকে নিজের মনের আবেগ আক্ষেপের কথাও ব্যক্ত করেছেন।
বলতে পারিস, বিশ্ব-পিতা ভগবানের কোন সে জাত?
কোন্ ছেলের তার লাগলে ছোঁয়া অশুচি হন জগন্নাথ?
ভগবানের জাত যদি নাই তোদের কেন জাতের বালাই?
ছেলের মুখে থুথু দিয়ে মার মুখে দিস ধূপের ধোঁয়া।
জাতের নামে বজ্জাতি সব জাত-জালিয়াৎ খেলছ জুয়া।।”
১৯২৭ সালে অধ্যক্ষ ইবরাহিম খাঁ- কে নজরুল লিখেছিলেন- “হিন্দু-মুসলমানের পরস্পরের অশ্রদ্ধা দূর করতে না পারলে যে এ পোড়া দেশের কিচ্ছু হবে না, এ আমিও জানি। এবং আমি এও জানি যে, একমাত্র-সাহিত্যের ভিতর দিয়েই এ অশ্রদ্ধা দূর হতে পারে।”
তাই তিনি সাহিত্যের ভেতর দিয়েই এই সাম্প্রদায়িক বিভেদ দূর করবার নিরন্তর প্রয়াস চালিয়েছেন।
কবি তার বিদ্রোহী কবিতায় লিখেছেন,
আমি বেদুঈন, আমি চেঙ্গিস,
আমি আপনারে ছাড়া করিনা কাহারে কুর্ণিশ,
আমি বজ্র, আশি ঈশান-বিষাণে ওঙ্কার,
আমি ইস্রাফিলে সিঙ্গার মহা-হুঙ্কার,
আমি পিণাকপানির ডমরু ত্রিশূল, ধর্মরাজের দণ্ড,
আমি চক্র ও মহাশঙ্খ, আমি প্রণব-নাদ প্রচন্ড।
মাত্র ২২ বছর বয়সে লেখা সাড়া জাগানো এ কবিতায় হিন্দু মুসলমান উভয় ধর্মীয় শব্দ ব্যবহার তার হৃদয়ের মানসের অসাম্প্রদায়িক ভাবনারই এক অগ্নিঝরা বহিঃপ্রকাশ।
‘ঘরে ঘরে তার লেগেছে কাজিয়া,
রথ টেনে আন, আনরে ত্যজিয়া,
পূজা দেরে তোরা, দে কোরবান।
শত্রুর গোরে গালাগালি কর, আবার হিন্দু-মুসলমান।
বাজাও শঙ্খ, দাও আজান।’
কাজিয়া, রথ, ত্যজিয়া, পূজা, কোরবান, গোরে, শঙ্খ ও আজান শব্দগুলি হিন্দু মুসলিম ধর্মীয় চেতনাকে একসূত্রে গাঁথার নিরন্তর চেষ্টা করেছেন কবি তার লেখনির মধ্য দিয়ে। যা তার মননের অসাম্প্রদায়িক ভাবনারই প্রকাশ বলা যায় নির্দ্বিধায়।
“জানিস যদি, খবর শোনা বন্ধু খাঁচায় ঘেরাটোপে,
উড়ছে আজো ধর্ম-ধ্বজা টিকির পিঠে, দাঁড়ির ঝোপে।”
কবি তার ফনিমনসা কাব্যগ্রন্থের
‘যা শত্রু পরে পরে’ কবিতায় বলেছেন-
“ঘর সামলে নে এই বেলা, তোরা ওরে ও হিন্দু-মুসলেমিন!
আল্লা ও হরি পালিয়ে যাবে না, সুযোগ পালালে মেলা কঠিন!
ধর্ম কলহ রাখ দু’দিন।”
নজরুল ছিলেন একজন আপাদমস্তক মানবতাবাদী অসাম্প্রদায়িক চেতনার কবি। তিনি হিন্দু মুসলিম বৌদ্ধ খ্রিস্টান সবকিছুর ঊর্ধ্বে নিজেকে এক অভিন্ন মানবিক মানুষ হিসেবে ভাবতেন।
“কে তুমি?- পার্সি? জৈন? ইহুদি? সাঁওতাল, ভীল, গারো? কনফুসিয়াস্? চার্বাক-চেলা? বলে যাও, বল আরো!”
সাম্যবাদী কবিতায় তিনি স্পষ্ট করেই বলেছেন-
“কোরান-পুরাণ-বেদ-বেদান্ত-বাইবেল-ত্রিপিটক-
জেন্দাবেস্তা গ্রন্থ সাহেব পড়ে যাও যত সখ,-
কিন্তু কেন এ পন্ডশ্রম, মগজে হানিছ শূল ?
দোকানে কেন এ দর-কষাকষি ? -পথে ফুটে তাজা ফুল !
তোমাতে রয়েছে সকল কেতাব সকল কালের জ্ঞান,
সকল শাস্ত্র খুঁজে পাবে সখা খুলে দেখ নিজ প্রাণ !
তোমাতে রয়েছে সকল ধর্ম সকল যুগাবতার
তোমার হৃদয় বিশ্ব-দেউল সকল দেবতার ।
কেন খুঁজে ফের দেবতা-ঠাকুর মৃত পুঁথি-কঙ্কালে ?
হাসিছেন তিনি অমৃত হিয়ার নিভৃত অন্তরালে !
বন্ধু বলিনি ঝুট,
এইখানে এসে লুটাইয়া পড়ে সকল রাজমুকুট ।
এই হৃদয়ই সে নীলচল, কাশী, মথুরা বৃন্দাবন,
বন্ধু-গয়া এ, জেরুজালেম এ, মদিনা, কাবা-ভবন
মসজিদ এই মন্দির এই, গির্জা এই হৃদয়,
এইখানে বসে ঈসা মুসা পেল সত্যের পরিচয় ।
এই রণ-ভূমে বাঁশীর কিশোর গাহিলেন মহা-গীতা
এই মাঠে হ’ল মেষের রাখাল নবীরা খোদার মিতা ।
এই হৃদয়ের ধ্যান-গুহা মাঝে বসিয়া শাক্যমুনি
ত্যজিল রাজ্য মানবের মহা-বেদনার ডাক শুনি ।
এই কন্দরে আরব-দুলাল শুনিতেন আহ্বান,
এইখানে বসি গাহিলেন তিনি কোরানের সাম-গান !
মিথ্যা শুনিনি ভাই,
এই হৃদয়ের চেয়ে বড় কোনো মন্দির-কাবা নাই।”
সুতরাং এখানে স্পষ্টই প্রতিয়মান হয় যে তিনি সকল ধর্ম ও সম্প্রদায়ের ঊর্ধ্বে অসাম্প্রদায়িক চেতনার কবি। মানবতার কবি। তিনি সকল ধর্ম জাত পাতের চেয়ে মানুষের মানবিক চেতনা ও মূল্যবোধকে সবচেয়ে বেশি মূল্যায়িত করেছেন। তাকে বলা হতো বিদ্রোহী কবি, কিন্তু তিনি শুধুমাত্র রাষ্ট্রযন্ত্র বা সামাজিক বৈষম্যের বিরুদ্ধেই বিদ্রোহ করেন নি, বিদ্রোহ করেছেন সাম্প্রদায়িক বিভেদ বৈষম্যের বিরুদ্ধেও।
শুধু কবিতা ও গানে নয়, গদ্যেও তিনি ধর্মের অন্তর্নিহিত ভাবধারার সমন্বয়ে অসাম্প্রদায়িক ভাবনাকেই তুলে ধরেছেন। এবং দাঁড় করিয়েছেন একটি শক্ত কাঠামোর উপর। যা তার বাঁধনহারা উপন্যাসেও অনেকটা পরিলক্ষিত হয়। আমি হিন্দু, আমি মুসলমান, আমি খ্রিস্টান, আমি বৌদ্ধ, আমি ব্রাহ্ম। আমি তো কোনো ধর্মের বাইরের খোলসটাকে ধরে নেই।
হিন্দু-মুসলমান’ এবং ‘মন্দির ও মসজিদ’ শীর্ষক গদ্যে নজরুলের অসাম্প্রদায়িক মনোভাব সুপরিস্ফুট। ‘মন্দির ও মসজিদ’ প্রবন্ধের শুরুতেই বলেন, ‘‘মারো শালা যবনদের’’। ‘মারো শালা কাফেরদের।’’-আবার হিন্দু-মুসলমানী কাণ্ড বাঁধিয়া গিয়াছে। প্রথম কথা কাটাকাটি, তারপর মাথা ফাটাফাটি আরম্ভ হইয়া গেল। আল্লার এবং মা কালীর ‘ প্রেস্টিজ’ রক্ষার জন্য যাহারা এতক্ষণ মাতাল হইয়া চীৎকার করিতেছিল তাহারাই যখন মার খাইয়া পড়িয়া যাইতে লাগিল, দেখিলাম-তখন আর তাহারা আল্লা মিয়া বা কালী ঠাকুরাণীর নাম লইতেছে না। হিন্দু-মুসলমান পাশাপাশি পড়িয়া থাকিয়া এক ভাষায় আর্তনাদ করিতেছে-“বাবা গো, মাগো মাতৃ পরিত্যক্ত দুটি বিভিন্ন ধর্মের শিশু যেমন করিয়া এক স্বরে কাঁদিয়া তাহাদের মাকে ডাকে।’…
একই প্রবন্ধের অন্যত্র তিনি উল্লেখ করেন, ‘এক স্থানে দেখিলাম, ঊনপঞ্চাশ জন ভদ্র-অভদ্র হিন্দু মিলিয়া একজন শীর্ণকায় মুসলমান মজুরকে নির্মমভাবে প্রহার করিতেছে, আর এক স্থানে দেখিলাম, প্রায় ঐ সংখ্যক মুসলমান মিলিয়া একজন দুর্বল হিন্দুকে পশুর মত মারিতেছে।’ এরপরই নজরুল মন্তব্য করেন-‘দুই পশুর হাতে মার খাইতেছে দুর্বল মানুষ। ইহারা মানুষকে মারিতেছে যেমন করিয়া বুনো জঙ্গী বর্বরেরা শুকরকে খোঁচাইয়া মারে। উহাদের মুখের দিকে তাকাইয়া দেখিলাম, উহাদের প্রত্যেকের মুখ শয়তানের চেয়েও বীভৎস, শুকরের চেয়েও কুৎসিত। হিংসায়, কদর্যতায় উহাদের গাত্রে অনন্ত নরকের দুর্গন্ধ।’
নজরুল আরো মন্তব্য করেন, ‘ দেখিলাম, আল্লার মজসিদ আল্লা আসিয়া রক্ষা করিলেন না, মা-কালীর মন্দির কালী আসিয়া আগলাইলেন না। মন্দিরের চূড়া ভাঙ্গিল মসজিদের গম্বুজ টুটিল। আল্লার এবং কালীর কোনো সাড়া শব্দ পাওয়া গেল না। আকাশ হইতে বজ্রপাত হইল না হিন্দুদের মাথার উপর। এই গোলমালের মধ্যে কতকগুলি হিন্দু ছেলে আসিয়া গোঁফ দাড়ি কামানো দাঙ্গায় হত খায়রু মিয়াকে হিন্দু মনে করিয়া ‘বল হরি হরিবোল’ বলিয়া শ্মশানে পুড়াইতে লইয়া গেল এবং কতকগুলি মুসলমান ছেলে গুলী খাইয়া দাড়িওয়ালা সদানন্দ বাবুকে মুসলমান ভাবিয়া, ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ পড়িতে পড়িতে কবর দিতে নিয়া গেল। মন্দির ও মসজিদ চিড় খাইয়া উঠিল, মনে হইল যেন উহারা পরস্পরের দিকে চাহিয়া হাসিতেছে।
হিন্দু-মুসলমান’ প্রবন্ধে তিনি বলেন-‘হিন্দুত্ব ও মুসলমানিত্ব দুই সওয়া যায়, কিন্তু তাদের টিকিত্ব, দাড়িত্ব অসহ্য, কেননা ঐ দুটোই মারামারি বাঁধায়। টিকিত্ব হিন্দুত্ব নয়, ওটা হয়ত পণ্ডিত্ব, তেমনি দাড়িত্ব ইসলামিত্ব নয়, ওটা মোল্লাত্ব! এই দুই ‘ত্ব’ মার্কা চুলের গোছা নিয়েই আজ এত চুলোচুলি! আজ যে মারামারিটা বেঁধেছে সেটাও ভাই পণ্ডিত মোল্লায় মারামারি, হিন্দু-মুসলমানের মারামারি নয়।”
নজরুল ইসলাম শ্যামা সঙ্গীত, হরিনাম, কীর্তন যখন রচনা করেছেন তখন তিনি হয়েছেন কাফের, আবার গজল ইসলামী সঙ্গীত যখন রচনা করেছেন, আরবী ফারসী সাহিত্যকর্ম বাংলায় অনুবাদ করেছেন, কবিতা গানে বা সাহিত্য কর্মে ফারসী আরবী ব্যবহারে করেছেন তখন এক শ্রেণির লোকদের কাছে হয়েছেন সাম্প্রদায়িক।
তিনি বলেছেন,
আমাকে বিদ্রোহী বলে খামোখা লোকের মনে ভয় ধরিয়ে দিয়েছেন কেউ কেউ। এই নিরীহ জাতটাকে আছড়ে-কামড়ে তেড়ে নিয়ে বেড়াবার ইচ্ছা আমার কোনদিনই নেই। আমি বিদ্রোহ করেছি বিদ্রোহের গান গেয়েছি অন্যায়ের বিরুদ্ধে অত্যাচারের বিরুদ্ধে। যা মিথ্যা কুলুষিত পুরাতন পঁচা সেই মিথ্যা সনাতনের বিরুদ্ধে, ধর্মের নামে ভণ্ডামি ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে।
হিন্দু-মুসলমানে দিন-রাত হানা-হানি জাতিতে জাতিতে বিদ্বেষ যুদ্ধ বিগ্রহ, মানুষের জীবনে একদিকে কঠোর দারিদ্র-ঋন-অভাব, অন্যদিকে লোভী অসুরের যক্ষের ব্যাংকে কোটি কোটি টাকা পাষান স্তুপের মত জমা হয়ে আছে। এই অসাম্য ভেদ জ্ঞানকে দূর করতেই আমি এসেছিলাম। আমার কাব্যে, সংগীতে কর্মজীবনে অভেদ সুন্দর সাম্যকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলাম। আমি যশ চাইনা খ্যাতি চাইনা প্রতিষ্ঠা চাইনা নেতৃত্ব চাইনা। জীবন আমার যত দুঃখময়ই হোক আনন্দের গান, বেদনার গান গেয়ে যাব আমি। দিয়ে যাব নিজেকে নিঃশেষ করে সকলের মাঝে বিলিয়ে, সকলের বাঁচার মাঝে থাকবো আমি বেঁচে। এই আমার ব্রত এই আমার সাধনা এই আমার তপস্যা। কাজেই কবির হৃদয়ের অসাম্প্রদায়িক চেতনার মাঝেই সম্পৃক্ত এক সত্য সুন্দর মানবিক বোধ।
নজরুল লিখেছেন– “সুন্দরের ধ্যান, তার স্তব গানই আমার উপাসনা, আমার ধর্ম। যে ধর্মে যে দেশেই জন্মগ্রহণ করি সে আমার দৈব। আর আমি তাকে ছাড়িয়ে উঠতে পেরেছি বলেই আমি কবি।”
এই সত্য সুন্দর বোধ একজন লেখককে তার ভাবনার সীমিত গণ্ডিকে অতিক্রম করে পৌঁছে দিতে পারে মহা চেতনার মহাকাশে, অতিদূরে, যা হয়তো সাধারণের কল্পনাকে অতিক্রম করে যেতে পারে অনেক অনেক অরো অনকে দূর।
মিথ্যা শুনিনি ভাই
এই হৃদয়ের চেয়ে বড় কোন
মন্দির কাবা নাই।”
কিংবা
“মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই
নহে কিছু মহীয়ান।”
“…হয়তো উহারই বুকে ভগবান জাগিছে দিবারতি!”
নব চেতনার বৈষম্যহীন অসাম্প্রদায়িক ভাবনার কবি নজরুলের কণ্ঠে তাই তো শুনি
“গাহি সাম্যের গান
যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে সব বাঁধা ব্যবধান
যেখানে মিশেছে হিন্দু বৌদ্ধ মুসলিম খ্রীশ্চান।”
“একই দেশের মাটিতে যাই
কেউ গোরে কেউ শ্মশানে ঠাঁই
মোরা এক ভাষাতে মাকে ডাকি
এক সুরে গাই গান।”
“হিন্দু মুসলিম দুটি ভাই
ভারতের দুটি তারা
একই বাগানে দুটি তরু দেবদারু আর কদমচারা।”
“শিহরি উঠো না, শাস্ত্রবিদেরে, করো নাক বীর ভয়
তাহারা খোদার খোদ প্রাইভেট সেক্রেটারি তো নয়
সকলের মাঝে প্রকাশ তাহার সকলের মাঝে তিনি
আমারে দেখিয়া আমার অদেখা জন্মদাতারে চিনি।”
“ভগবানের ফৌজদারি কোর্ট
নাই সেখানে জাত বিচার
পৈতে টিকি টুপি টোপর
সব সেথা ভাই একাকার।”
নজরুল সম্পর্কে জনৈক লেখকের অভিব্যক্তি– “বর্তমান বিশ্বের চলমান সাম্প্রদায়িক সহিংসতা বৃদ্ধির যে প্রবণতা তা থেকে মুক্তি পেতে নজরুলের অমর বাণী সমৃদ্ধ কবিতা পাঠের আর গান শ্রবণের বিকল্প নেই।
আজো আমরা নজরুলের অসাম্প্রদায়িক চেতনা, মানবতাবোধ বিদ্রোহী চেতনায় নিত্য আলোড়িত হই। সাম্য মৈত্রীর বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে নজরুলকে অনুভব করি। নজরুল আমাদের প্রেরণা, নজরুল আমাদের সত্তায়, মননে।”
শুধু গল্প কবিতা উপন্যাস কিংবা সংগীতে নয়, বাস্তব জীবনেও আমরা অসাম্প্রদায়িক নজরুলকেই দেখেছি। তৎকালীন চরম সাম্প্রদায়িক বিভেদ বৈষম্যের সমাজব্যবস্থার মধ্যে থেকেও ধর্মান্তরিত না করে প্রমিলাকে বিয়ে যা সে সময়ের বিবেচনায় কল্পনার অতীত। শোনা যায় নজরুল যখন আজান দিয়ে নামাজ পড়তেন, প্রমিলা হয়তো তখন উলুধ্বনি দিয়ে সন্ধ্যাপ্রদীপ জ্বালাতেন। তার সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির আরেক উজ্জ্বল প্রমাণ হলো স্বীয় পুত্রের নাম কৃষ্ণ মোহাম্মদ রাখা।
তাই আজও যারা নজরুলের বিভিন্ন সৃষ্টিকে সুবিধামত ব্যবহার করে তাকে একেক ধর্মের একেক সম্প্রদায়ের প্রতিভূ বলে গলা ফাঁটাতে চায় তাদের নজরুল সম্পর্কে সাধারণ ধারনাটুকুও নেই।
কবি বলেছেন- “অবতার পয়গম্বর কেউ বলেননি, আমি হিন্দুর জন্য এসেছি, আমি মুসলমানদের জন্য এসেছি, আমি ক্রীশ্চানের জন্য এসেছি। তাঁরা বলেছেন, আমি মানুষের জন্য এসেছি-আলোর মত, সকলের জন্য।”
কিন্তু এই বিভেদ তৈরি করেছে মূর্খ ভক্তরা। আর এই বিভক্তিই যুগ যুগ ধরে তৈরি করেছে সাম্প্রদায়িক বিভেদ বৈষম্যের মহা বেড়াজাল। যা নজরুলের মতো কেউ আর এতো তীব্রভাবে অনুভব করেন নি।
নজরুলের অসাম্প্রদায়িক ভাবনা নিয়ে আলোচনা শুধু এই ছোট্ট প্রবন্ধে শেষ করা বড়ই দুঃসাধ্য।
কবি বলেছেন– বিংশ শতাব্দীর অসম্ভবের সম্ভাবনার যুগে আমি জন্মগ্রহণ করেছি। এরই অভিযান সেনাদলের তুর্য বাদকের একজন আমি, এই হোক আমার সবচেয়ে বড় পরিচয়।
আমি এই দেশে এই সমাজে জন্মেছি বলেই শুধু এই দেশেরই এই সমাজেরই নই, আমি সকল দেশের সকল মানুষের। কবি চায়না দান, কবি চায় অঞ্জলী কবি চায় প্রীতি। কবিতা আর দেবতা সুন্দরের প্রকাশ সুন্দরকে স্বীকার করতে হয় যা সুন্দর তাই দিয়ে সুন্দরের ধ্যান, তার স্তব গানই আমার ধর্ম। তবু বলছি আমি শুধু সুন্দরের হাতে বীণা পায়ে পদ্মফুলই দেখিনি, তার চোখে চোখ ভারা জলও দেখেছি। শ্বশানের পথে, গোরস্থানের পথে তাঁকে ক্ষুধা দীর্ণ মুর্তিতে ব্যথিত পায়ে চলে যেতে দেখেছি…। (যদি আর বাঁশি না বাজে)
আজো এই একবিংশ শতাব্দির মহা সন্ধিক্ষণে বিশ্বময় সাম্প্রদায়িক হানাহানি, জাতিতে জাতিতে ক্রন্দল। এই অসম্ভবের যুগযন্ত্রণার অভিক্ষেপণে একজন অসাম্প্রদায়িক নজরুলকে বড় প্রয়োজন, প্রয়োজন নজরুল চেতনাকে নুতন প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দেয়া। নজরুল সাহিত্য, নজরুল চর্চা, নজরুল গবেষণা ক্ষেত্রগুলো রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় আরো বেশি সচল করা উচিত। তাহলেই নজরুলের অসাম্প্রদায়িক চেতনা সার্থক হবে, গড়ে উঠবে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ইপ্সিত লক্ষের ও বাহাত্তুরের সংবিধানের মূলনীতি একাত্তুরের স্বাধীনতার সোনালি ফসল অসাম্প্রদায়িক ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশ। যে চেতনা পারাধীন দেশের নজরুলের কাছ থেকে পেয়ে আমরা বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে অর্জন করেছিলাম স্বাধীনতা। সেই স্বাধীনতাকে অর্থবহ করতেই হয়তো বঙ্গবন্ধু স্বাধীন বাংলাদেশে নজরুলকে নিয়ে এসেছিলেন। তাই, আমাদের রক্তে কেনা স্বাধীনতাকে সার্থক করতে চাইলে সকল ধর্মান্ধতা ধর্ম ব্যবসায়ী, ধর্মীয় টাউট, জঙ্গীবাদমুক্ত দেশের জন্যে অসাম্প্রদায়িক নজরুলের অসাম্প্রদায়িক চেতনা চর্চার কোনো বিকল্প নেই। আসুন, আমরা নজরুলকে জানি, নজরুলের অসাম্প্রদায়িক চেতনায় গড়ে তুলি আমাদের আগামির স্বপ্ন সোনার দেশ।
জয়তু নজরুল, জয় হোক মানবতার ।
মাসুদ আলম বাবুল, কবি, কথাসাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক ।
অধ্যক্ষ, হাজী আক্কেল আলী হাওলাদার ডিগ্রি কলেজ, পটুয়াখালী।