বৃহস্পতিবার, ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ১০:৩৯ অপরাহ্ন
নিজস্ব প্রতিবেদক: সাধারণ বীমা কর্পোরেশনের পরিচালক ও বীমা অধিদপ্তরের সাবেক ডেপুটি কন্ট্রোলার মিজানুর রহমান ক্ষমতার অপব্যবহার, কমিশন বাণিজ্য, অনিয়ম, দুর্নীতি ও অর্থ লোপাটের সঙ্গে জড়িত- এমন অভিযোগ করে তাঁর নিয়োগ বাতিলের দাবী জানানো হয়েছে। সাধারণ বীমার কর্পোরেশনের জনৈক কর্মকর্তা মো. সুমন আল আমিন অর্থ উপদেষ্টা বরাবর লিখিত চিঠিতে এমন অভিযোগ করেছেন।
সুমন আল আমিন অভিযোগে বলেন, বিলুপ্ত বীমা অধিদপ্তরের ডেপুটি কন্ট্রোলার ও এনআরবি ইসলামিক লাইফের সাবেক সিইও (ভারপ্রাপ্ত) মিজানুর রহমান ১৭ অক্টোবর ২০২৪ তারিখে সাধারণ বীমা কর্পোরেশনের পরিচালনা বোর্ডের পরিচালক হিসেবে ৩ বছরের জন্য নিয়োগ পেয়েছেন। চিহ্নিত আওয়ামী ফ্যাসিবাদের দোসর এই অসৎ ও দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা মিজানকে সাধারণ বীমা কর্পোরেশনের পরিচালক পদে নিয়োগ দেয়ায়- সরকারের সিদ্ধান্তের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়ে অবিলম্বে তার নিয়োগ বাতিলের দাবী জানানো হয়।
চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, মো. মিজানুর রহমান তৎকালীন সময়ে বীমা অধিদপ্তরে দায়িত্ব পালনকালীন সময়ে দুর্নীতিবাজ হিসেবে পরিচিত ছিলেন। বীমা খাতে অবৈধ কর্মকান্ড, ক্ষমতার অপব্যবহার ও কমিশন বানিজ্যের মাধ্যামে এক ভয়ংকর আতংকের নাম ছিলেন তিনি। বীমা অধিদপ্তর যোগদানের পর বীমা কোম্পানীর এজেন্ট লাইসেন্স নিয়ে কাজ করতেন। বীমা কোম্পানিগুলোতে প্রতিটি এজেন্ট লাইসেন্স অনুমতির ক্ষেত্রে মিজানের স্বাক্ষর প্রয়োজন হতো। প্রকাশ্যে ঘোষনা দিয়ে হাজার হাজার এজেন্ট অনুমতির জন্য প্রতিটি ফাইলে ২ টাকা ঘুস নিতেন তিনি। বীমা প্রতিষ্ঠানের এমডি নিয়োগ, নবায়ন, প্রতিষ্ঠানের গাড়ি কিংবা জমি ক্রয়ের অনুমতির ক্ষেত্রেও মোটা অংকের ঘুস নিতেন। এমনকি গণ বীমা, জন বীমা, সার্বজনীন বীমা- এমন বিভিন্ন বীমা প্রকল্পের অনুমোদন নেয়ার ক্ষেত্রেও মিজানকে টাকা দিয়ে ম্যানেজ হতো। শুধু তাই নয়, বীমা প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান, পরিচালক ও এমডিদের ফোন করে তিনি বিভিন্ন লোকজনকে চাকুরী দিতে চাপ চাপ প্রয়োগ করতেন। সেক্ষেত্রেও ঘুষ নিয়ে মিজান বীমা কোম্পানীতে চাকুরী বাণিজ্যে লিপ্ত ছিলেন। এরমধ্যে সান লাইফের সাজ্জাদুল ইসলাম, প্রগতি লাইফের নুরুজ্জামান, গোল্ডেন লাইফের আলমগীর হোসেন ও প্রয়াত নজরুল ইসলাম শাহিনের কাছ থেকে ৩০ হাজার থেকে এক লাখ টাকা ঘুস নিয়ে তিনি ওই সব প্রতিষ্ঠানে চাঁপ প্রয়োগ করে এদের চাকুরী দিয়েছেন।
অভিযোগ পত্রে বলা করা হয়, অপরাধের মাত্রা বাড়তে বাড়তে তৎকালীন সময়ে আদালতে ‘রীট’ বাণিজ্যেও জড়িয়ে পরেন মো. মিজানুর রহমান। পপুলার লাইফ, পদ্মা কিংবা সানলাইফ- সকল প্রতিষ্ঠানের রীটের নেপথ্যে ছিলেন এই মিজান। পপুলার লাইফের সাবেক এমডি মুফতি এম এ আজিজ প্রতিষ্ঠান নিয়ে আদালতে ‘রীট’ করলে সেখানেও ভয় দেখান মিজান। রাজধানীর বসুন্ধরা এলাকায় একটি ফ্ল্যাট মিজানকে ঘুস দিতে হয়। পপুলার লাইফ থেকে নেয়া সেই ফ্ল্যাটে এখন বসবাস করছেন তিনি। মিজানের এই অপরাধ, অনিয়ম ও দুর্নীতি ছিলো অনেকটাই প্রকাশ্যে। পরবর্তিতে বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের (আইডিআরএ) সাবেক চেয়ারম্যান শেফাক আহমেদ মিজানের আমলনামা খতিয়ে দেখতে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেন। প্রতিটি বীমা কোম্পানীতে বিষয়টি নিয়ে চিঠি পাঠানো হয়। পরবর্তিতে সেই তদন্ত কার্যক্রম অদৃশ্য কারণে বন্ধ হয়ে যায়। ভয়াবহ দিক হলো, তদন্তর সেই বিশেষ ফাইলটিও আইডিআরএ থেকে গায়েব করা হয়।
সুমন আল আমিন অভিযোগে আরো জানান, বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশনে চাকুরী করতেন মিজান। তার বিরুদ্ধে স্বেচ্ছাচারিতা, অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ উঠলে শিপিং কর্পোরেশন থেকে শাস্তিমূলক বদলি করা হয় আইডিআরএতে। এখানে এসে তিনি আরো বেশি বেপরোয়া ও দুর্নীতিবাজ হয়ে উঠেন। পুরো বীমা খাতকে অনিয়মের আখড়ায় পরিণত করে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যান।
বীমা অধিদপ্তরে চাকুরী শেষ হওয়ার দীর্ঘদিন পর তিনি এনআরবি ইসলামিক লাইফের ‘এডভাইজার’ হিসেবে যোগদান করেন। পরে তাকে ভারপ্রাপ্ত এমডির দায়িত্ব দেয়া হয়। মাত্র ২ মাস দায়িত্ব পালন করা অবস্থায় এনআরবি লাইফে ‘বীমা আইন লংঘন, অনিয়ম ও দূর্নীতির অভিযোগ উঠলে’ প্রতিষ্ঠানটির পরিচালনা পর্ষদ সভায় তাকে ‘বাধ্যতামূলক অব্যাহতি’ দেয়া হয়। এরপর মিজানের চোখ যায় সাধারণ বীমা কর্পোরেশনের প্রতি। বিশেষ ‘তদবির এবং অর্থ ব্যয় করে’ সাধারণ বীমা কর্পোরেশনের পরিচালক পদ বাগিয়ে নেন।
অপরাধ, অনিয়ম, দুর্নীতির করে অবৈধ উপায়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে কোটি কোটি টাকা কামিয়েছেন মো. মিজানুর রহমান। রাজধানীর পূবাইল, উত্তরা, গাজীপুর, নরসিংদী ও কেরানীগঞ্জ সহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় নামে-বেনামে করেছেন অসংখ্য প্লট ও ফ্ল্যাট। দেশে ছাগলকান্ডে আলোচিত জাতীয় রাজস্ব বোর্ড কর্মকর্তা মতিউর রহমান ও তার পরিবারের সাথে এই মিজানুর রহমানের রাজধানীতে যৌথ সম্পদ ও প্লট রয়েছে। যা দুদক এবং দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তদন্ত করলে সকল সত্যতা বেড়িয়ে আসবে।
একসময় ফ্যাসিবাদ আওয়ামী সরকারের ঘনিষ্ট হিসেবে নিজেকে পরিচয় দিতেন মো. মিজান। আওয়ামী বিভিন্ন নেতা, একাধিক এমপি এবং প্রশাসনের প্রভাবশালী কর্মকর্তাদের পরিচয় দিয়ে অপরাধের সাম্রাজ্য চালাতেন। তার ভয়ে কেউ মুখ খুলতেন না। ক্ষমতার পট পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে রাজনৈতিকভাবে এখন ভোল্ট পাল্টিয়েছেন এই হোয়াইট কালার ক্রিমিনাল। এখন তিনি বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত- এমন পরিচয় ব্যবহার করেন।
সেই ২ টাকার মিজান সাধারণ বীমা কর্পোরেশনের পর- আবার আইডিআরএতে লোলুপ দৃষ্টি দিয়েছেন। তার মিশন এখন আইডিআরএর সদস্য হওয়ার জন্য আবারো তদবিরে লিপ্ত হয়েছেন বলে জানানো হয় চিঠিতে।
স্বৈরাচার ও ফ্যাসিবাদের প্রেতাত্মা মো. মিজানের সকল কর্মকান্ড তদন্ত করে, কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করে সাধারণ বীমা কর্পোরেশনের নিয়োগ বাতিল এবং যথাযথ শাস্তি দাবী করা হয় চিঠিতে। লিখিত এই অভিযোগের অনুলিপি বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান, সাধারণ বীমা কর্পোরেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও দূর্নীতি দমন কমিশনের দেয়া হয়েছে বলে চিঠিতে উল্লেখ রয়েছে। এই অভিযোগ পত্রের একটি কপি ইকোনোমি বাংলার কাছে এসেছে।
অভিযোগের বিষয় জানতে চাইলে, ‘যাচাই বাছাই ছাড়া সংবাদ প্রকাশিত হলে সাংবাদিককে ‘দেখে নেওয়ার‘ হুমকিও দেন মো. মিজানুর রহমান। বলেন, ‘আপনারা সকল তথ্য উপাত্ত যাচাই করে লিখুন, আমি শক্ত আছি, বিষয়টি দেখবো, আমি কোন অন্যায় করিনি।’
তিনি আরো বলেন, ১৪ বছর আগে বীমা অধিদপ্তরে সুনামের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করে এরপর তিনি বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশনে যোগদান করেন। এমনকি এনআরবি ইসলামী লাইফেও সফলতার সঙ্গে কাজ করেছেন। সদ্য তিনি সাধারণ বীমা কর্পোরেশনের পরিচালক হিসেবে এসেছেন।
‘প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে তিনি মেধাবী, সৎ ও যোগ্য কর্মকর্তা হিসেবে পরিচিত ছিলেন’- এমন দাবী করে মো. মিজানুর রহমান বলেন, ‘‘ঠিক যখন তিনি আইডিআরএতে সদস্য হতে চেষ্টা করছেন- ঠিক তখন একটি মহল তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়ে অপপ্রচার করছে। ’’
এছাড়া ছাগলকান্ডে জড়িত আলোচিত জাতীয় রাজস্ব বোর্ড কর্মকর্তা মতিউর রহমান ও তার পরিবারের সাথে তার কোন ‘সম্পদ নেই’ বলেও জানান মো. মিজানুর রহমান।