ডেস্ক নিউজ:
আইন লংঘন করে বীমা ব্যবসার অভিযোগ উঠেছে নন-লাইফ প্রতিষ্ঠান তাকাফুল ইসলামী ইন্স্যুরেন্সের বিরুদ্ধে। শেয়ার ধারণ নিয়ে একই পরিবারের তিনজন সদস্য পরিচালনা পর্ষদে থাকা বীমা আইন ও বিধিমালার পরিপন্থী হলেও বছরের পর বছর অনিয়ম করছে প্রতিষ্ঠানটি। এ বিষয় নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে- তাকাফুলের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের দাবী জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
তাকাফুল ইসলামী ইন্স্যুরেন্সের এনুয়াল রিপোর্ট, প্রসপেক্টাস ও ওয়েবসাইট সূত্রে জানা গেছে, পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠানটিতে একই পরিবারের মো: হুমায়ুন কবির পাটোয়ারী, তার স্ত্রী মিসেস শাহানাজ পারভীন ও পুত্র রেদওয়ান কবির–পরিচালক পদে রয়েছেন। একই সঙ্গে মো: হুমায়ুন কবির পাটোয়ারী সুরক্ষা কমিটির চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। এর আগে তিনি ইসি কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন। এভাবে তিন সদস্যের পারিবারিক প্রতিষ্ঠান- আইনের পরিপন্থি বলে মনে করছেন খাত সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, ‘‘বিষয়টি বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ) প্রণীত বীমাকারীর নিবন্ধন প্রবিধানমালা, ২০১৩ ও বীমা আইন, ২০১০ এর সংশ্লিষ্ট ধারা অনুযায়ী অযোগ্যতা হিসেবে গণ্য করা হচ্ছে।’’
প্রবিধানমালার ১৮ নং অনুচ্ছেদের (ঠ) উপ-ধারায় স্পষ্টভাবে উল্লেখ রয়েছে যে, “নিজের পরিবারে পরিচালক সংখ্যা ২ (দুই) এর অধিক হওয়া চলবে না। এই বিধান অনুসারে- একটি নির্দিষ্ট বীমা কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদে একই পরিবারের সর্বোচ্চ দুইজন সদস্য পরিচালক হতে পারেন।’’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক তাকাফুলের একাধিক কর্মকর্তা গণমাধ্যমকে বলেন, “অনিয়ম থেকে দু:শাসনের জন্ম হয়। পারিবারিক আধিপত্যবাদ প্রতিষ্ঠানের বিকাশকে বাঁধাগ্রস্থ করে। সুশাসন, স্বচ্ছতা এবং নৈতিকতা বজায় রাখতে- আইন ও নীতিমালার প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকতে হবে। এ বিষয় আইডিআরএ এবং কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদের পক্ষ থেকে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণের আহ্বান জানান তারা।”
আইনানুযায়ী, এক পরিবারের তিনজন সদস্যের একযোগে পরিচালনা পর্ষদে থাকা একটি ‘স্পষ্ট অযোগ্যতা’ হিসেবে বিবেচিত হওয়ায় বিষয়টি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নজরে আনা হয়েছে। এ ব্যাপারে আগামী ১৬ আগস্ট প্রতিষ্ঠানের বার্ষিক সাধারণ সভায় আইন অনুযায়ী প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রস্তাব উত্থাপন করা হয়েছে।
এছাড়াও তাকাফুলের পরিচালক ও সুরক্ষা কমিটির চেয়ারম্যান মো: হুমায়ুন কবির পাটোয়ারী পরিবারের ৩ সদস্যের কাছে প্রায় ১৫ শতাংশ শেয়ার রয়েছে।
এদিকে, কোনো পরিবারের সদস্যদের হাতে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে, একক বা অন্যের সঙ্গে যৌথভাবে বা উভয়ভাবে ১০ শতাংশের বেশি শেয়ার থাকতে পারবে না- বীমা খাতে এমন আইন চায় আইডিআরএ।
আইডিআরএ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, বীমা খাতে অনিয়ম-দূর্নীতি দূর করে শৃঙ্খলা ফেরাতে বিদ্যমান আইন পরিবর্তন ও সংশোধনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। এক্ষেত্রে আইডিআরএ বীমা আইন সংশোধনে কাজ করছে। আইনে পরিবর্তন আনা হচ্ছে বীমা খাতের অস্পষ্টতা ও দুর্বলতা দূর করে যুগোপযোগী করার জন্য। এজন্য ইতিমধ্যে সংশোধিত আইনের খসড়া ওপর সংশ্লিষ্ট অংশীজন, বিশেষজ্ঞ ও জনগণের মতামত নিচ্ছেন। এতে করে বীমা খাতের উন্নয়নের পাশাপাশি কোম্পানী, মালিক, গ্রাহক ও বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ সংরক্ষণ সম্ভব হবে।
বীমা আইন সংশোধনের প্রস্তাবে বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি, কোম্পানি বা একই পরিবারের সদস্যদের মধ্যে বীমা কোম্পানিকে কেন্দ্রীভূত করা যাবে না। কোনো পরিবারের সদস্যদের হাতে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে, একক বা অন্যের সঙ্গে যৌথভাবে বা উভয়ভাবে ১০ শতাংশের বেশি শেয়ার থাকতে পারবে না। এ ছাড়া শর্ত ও নির্দেশনা অনুযায়ী বিমা কোম্পানির সহযোগী প্রতিষ্ঠানগুলো পরিচালিত হচ্ছে কি না, এখন থেকে তা সময়ে সময়ে পরীক্ষা করবে আইডিআরএ।
খসড়া প্রস্তাবে আরও বলা হয়েছে, “পরিচালক, শেয়ারহোল্ডার বা তাঁদের পরিবারের সদস্যরা বীমা কোম্পানির সম্পত্তি বন্ধক রেখে ঋণ নিতে পারবেন না। ১০ বছরের ব্যবস্থাপনা, ব্যবসায়িক বা পেশাগত অভিজ্ঞতা ছাড়া কেউ বিমা কোম্পানির পরিচালক বা চেয়ারম্যানও হতে পারবেন না।”
বিদ্যমান বীমা আইনে ‘পরিবার’ বলতে স্বামী বা স্ত্রী, পিতা, মাতা, পুত্র, কন্যা, ভাই ও বোন এবং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির ওপর নির্ভরশীলদের চিহ্নিত করা আছে। সংশোধন করে পরিবার সংজ্ঞাতে জামাতা ও পুত্রবধূকে যুক্ত করার প্রস্তাব করা হয়েছে। বাদ দেওয়া হয়েছে ‘সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির ওপর নির্ভরশীল সবাই’ কথাটি। কোনো কোম্পানি বেআইনি বীমা ব্যবসা করলে বা আইডিআরএর নির্দেশ অমান্য করলে সংস্থাটি দৈনিক পত্রিকায় ঘোষণা দিয়ে তা প্রকাশ করতে পারবে।
এদিকে বীমা খাতের উন্নয়ন এবং যুগোপযোগী আইন সংশোধনের উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছেন বাংলাদেশ ইনস্যুরেন্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিআইএ) ও বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স ফোরাম (বিআইএফ)। আইডিআরএর তথ্য অনুযায়ী, দেশে বর্তমানে ৮২টি বীমা কোম্পানি রয়েছে। এর মধ্যে ৩৬টি জীবন বীমা ও ৪৬টি সাধারণ বীমা।
এর আগে প্রতিষ্ঠানের পরিচালক ও শেয়ার ধারণ নিয়ে আরও একটি সিদ্ধান্ত হয় মন্ত্রিসভায়। ২০২৩ সালে আর্থিক প্রতিষ্ঠানে একক ব্যক্তি বা পরিবার থেকে ১৫ শতাংশের বেশি শেয়ার ধারণ করা যাবে যাবে না—এমন বিধান রেখে ‘ফাইন্যান্স কোম্পানি আইন, ২০২৩’-এর খসড়ার চূড়ান্ত অনুমোদন দেয় মন্ত্রিসভা। এছাড়াও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বোর্ডে একই পরিবার থেকে দুজনের বেশি পরিচালকও থাকা যাবে না বলে উল্লেখ করা হয় আইনে। ২৩ অক্টোবর ২০২৩-এ মন্ত্রিসভা বৈঠকে এই খসড়া আইনের অনুমোদন দেওয়া হয়।
এ প্রসঙ্গে আইডিআরএর এক সদস্য বলেন, “বীমা আইনের বেশ কিছু বিষয় হালনাগাদ করার সময় এসেছে। আইডিআরএর ক্ষমতাও বৃদ্ধি করা দরকার। আইন সংশোধন সম্ভব হলে বীমা খাত এগিয়ে যাবে।”
এছাড়াও তাকাফুলের অনিয়ম নিয়ে তিনি বলেন, “বীমা খাতের শৃঙ্খলা বজায় রাখতে সতর্ক অবস্থানে আইডিআরএ। কোন কোম্পানীতে অনিয়ম পরিলক্ষিত হলে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। প্রয়োজনে পরিচালনা পর্ষদ ভেঙ্গে দেয়া হতে পারে।”
এ প্রসঙ্গে তাকাফুল ইসলামী ইন্স্যুরেন্সের পরিচালক ও সুরক্ষা কমিটির চেয়ারম্যান মো: হুমায়ুন কবির পাটোয়ারীকে ফোন করা হলে “মিটিং এ আছি বলে ফোন কেটে দেন।”
প্রতিষ্ঠানের ‘পরিচালক ও শেয়ার সংখ্যা’ নিয়ে তাকাফুল ইসলামী ইন্স্যুরেন্সর চেয়ারম্যান তাহমিনা আফরোজ ও সিইও আবুল কালাম আজাদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে ফোন রিসিভ করেন নি। হোয়াটসঅ্যাপে ম্যাসেজ করা হলেও উত্তর মেলেনি।
সূত্র: অর্থবাংলা.কম