বুধবার, ১৭ ডিসেম্বর ২০২৫, ০১:৪৮ অপরাহ্ন
শিরোনাম :
অপারেশন ডেভিল হান্ট ফেজ-২ : চার দিনে গ্রেপ্তার ২৪৩৩ গণভোটে ঠিক হবে নতুন বাংলাদেশের চরিত্র: প্রধান উপদেষ্টা ১৬ ডিসেম্বর মহান বিজয় দিবস উপলক্ষে আনুষ্ঠানিকভাবে জাতীয় পতাকা উত্তোলন মহান বিজয় দিবস উপলক্ষে DYDF বরিশাল জেলা শাখার শ্রদ্ধা নিবেদন কোটচাঁদপুরে জামায়াতে ইসলামীর বিজয় দিবস উদযাপন কালিয়ায় মহান বিজয় দিবসে বিএনপির বিজয় র‍্যালি ও শহীদ মিনারে পুষ্পস্তবক অর্পণ সিংড়ায় বিয়াশ নূরানী ক্যাডেট মাদ্রাসার উদ্যোগে মহান বিজয় দিবস উদযাপন কুড়িগ্রামে নানান আয়োজনে মহান বিজয় দিবস উদযাপন জাতীয় স্মৃতিসৌধে শহীদদের প্রতি প্রধান উপদেষ্টার শ্রদ্ধা পুলিশ সুপার মহোদয়ের পলাশ থানা আকস্মিক পরিদর্শন

হাসপাতাল থেকে হাসপাতাল—সেবার বদলে সহ্যশক্তির পরীক্ষা

তুহিন ভূঁইয়া:
  • আপডেট টাইম : শুক্রবার, ২৮ নভেম্বর, ২০২৫
  • ২০

গত এক মাসে কয়েকজন সহকর্মী, নিজের ও বাবার চিকিৎসার প্রয়োজনে আমাকে রাজধানীর বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে ছুটতে হয়েছে—শাহবাগের পিজি হাসপাতাল, পুরান ঢাকার মিডফোর্ড হাসপাতাল, ধানমন্ডির ইবনে সিনা, মগবাজারের আদ্-দ্বীন হাসপাতাল, এমনকি সরকারি কমিউনিটি হাসপাতালও। সব মিলিয়ে এই কয়েক দিনের অভিজ্ঞতা বাংলাদেশের স্বাস্থ্যসেবার কঙ্কালসার ও রুগ্ন বাস্তবতাকে আবারও চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। টাকা খরচ করেও কাঙ্ক্ষিত সেবা না পাওয়া, সরকারি হাসপাতালে নোংরা পরিবেশ ও অমানবিক ভিড়, বেসরকারি হাসপাতালে অতিরিক্ত টেস্টের চাপ, উদাসীন চিকিৎসক, কর্মচারীদের খারাপ ব্যবহার, তথ্য পেতে অবিশ্বাস্য ভোগান্তি—সব মিলিয়ে সাধারণ মানুষের চিকিৎসা এখন যেন নিছক ভাগ্যের ওপর নির্ভর এক লড়াই।

সবশেষ গত সোমবার পিজি হাসপাতালে ভোলার প্রবীণ সাংবাদিক এবং দৈনিক বাংলার কণ্ঠ পত্রিকার সম্পাদক ও প্রকাশক এম. হাবিবুর রহমানের মৃত্যুর বিষয়টি বেশ ভাবিয়ে তুললো নিজের বিবেককে। যে মানুষটি সকাল বেলাতেও কথা বলতে বলতে হাসপাতালে ভর্তি হলো দুপুর পেরোতেই তাঁর মৃত্যু হলো উপযুক্ত উন্নত চিকিৎসার অভাবে। বাবার মৃত্যুতে ছেলে যখন আইসিওর সামনে প্রায় অজ্ঞান হয়ে পরে আছে, তার প্রেসার মাপতেও ঘুরতে হয়েছে এ’দুয়ার ও দুয়ার। বেশ কয়েকজনের অনুরোধ, রাগারাগির পরে অনেক কষ্টে দীর্ঘ সময় পর একজন নার্স এসে নিশ্চিত করলো সে উচ্চ রক্তচাপে ভুগছে। তাকে ডাক্তারের কাছে নিতে জরুরী বিভাগে গিয়ে রোগী বহন করার মতো একটি ট্রলি অথবা হুইল চেয়ারও মিললো না পিজি হাসপাতালে, নেই কোনো সহকারী! এই হলো আমাদের দেশের চিকিৎসা সেবার করুণ দৃশ্য।

শারীরিক চিকিৎসা ব্যবস্থার সংকট যেমন স্পষ্ট, তার চেয়েও ভয়াবহ চিত্র রয়েছে দেশের মানসিক স্বাস্থ্যসেবায়। সাম্প্রতিক এক গবেষণায় উঠে এসেছে—বাংলাদেশে প্রায় ৩ কোটি মানুষের মানসিক চিকিৎসার প্রয়োজন, কিন্তু চিকিৎসা নিতে পেরেছে মাত্র ১০ শতাংশ। পেশাগত দায়িত্ব পালনের সুবাদে পাবনা মানসিক হাসপাতাল, শেরেবাংলা নগরের জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট, পিজি হাসপাতালের মনোরোগ বিভাগ, বিভিন্ন বেসরকারি মানসিক হাসপাতাল, মাদক নিরাময় কেন্দ্র, এমনকি অসংখ্য সংস্থা, মাজার, উপাসনালয় ও আখড়াসহ বহু স্থানে গিয়ে যে বাস্তবতা দেখা গেছে, তা আরও উদ্বেগজনক। চিকিৎসার নামে অনেক ক্ষেত্রেই যা ঘটছে তার ফলাফল রোগীর অবস্থাকে সুস্থ করার বদলে আরও জটিল করে তুলছে। সব মিলিয়ে মানসিক স্বাস্থ্যসেবার এই ভঙ্গুর ও বিশৃঙ্খল পরিবেশই আজ দেশের জন্য সবচেয়ে বড় সংকটগুলোর একটি। কারণ এই বিপুলসংখ্যক মানসিক রোগীই নির্মাণ করছে দেশের আগামীর মানবসম্পদ—যার প্রভাব পড়ছে পরিবার থেকে সমাজ, রাষ্ট্র থেকে বিশ্বপর্যায়ের প্রতিটি জায়গায়।

তবে ভিআইপিদের বেলায় পুরো চিত্র ভিন্ন। তা হোক– ওবায়দুল কাদের, তোফায়েল আহমেদ অথবা বেগম জিয়া।

চিকিৎসা মানুষের মৌলিক অধিকার। রাষ্ট্রের মৌলিক দায়িত্বও বটে। অথচ বাংলাদেশের চিকিৎসা ব্যবস্থা আজ এক ধরনের শ্রেণিভিত্তিক বিভাজনের প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে। নিম্নবিত্তদের চিকিৎসার জন্য আছে সরকারি হাসপাতাল, যেখানে লাইনে দাঁড়িয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা ও অবহেলা গিলে খাওয়ার প্রস্তুতি নিয়েই যেতে হয়। নিম্ন-মধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্তরা সামর্থ্য অনুযায়ী বেসরকারি হাসপাতালে যায়, আর উচ্চবিত্তরা চিকিৎসার জন্য নির্দ্বিধায় বিদেশ-পথে। একজন কর্মজীবী মানুষ সরকারি হাসপাতালে শুধু একটি সাধারণ পরীক্ষার সিরিজ সম্পন্ন করতে গেলেই দুই দিন নষ্ট হয়ে যায়—টিকিটের লাইন, ডাক্তার দেখার লাইন, টেস্টের লাইনে টাকা জমা, টেস্টের লাইন, রিপোর্টের লাইন এবং শেষে আবার ডাক্তার দেখার লাইন। আর এই দীর্ঘ ভোগান্তির পথ ঘুরে শেষে জানা যায়—সরকারি যন্ত্রপাতি বিকল, দক্ষ জনবল নেই, কিছু পরীক্ষা এখানেই সম্ভব নয়, তাই বাধ্য হয়ে বেসরকারি হাসপাতালে যেতে হবে। অথচ সরকারি হাসপাতালের মূল বৈশিষ্ট্যই হলো—সুলভ চিকিৎসা। তবে সেই সুলভ সেবার জন্যও যে মানুষকে কী ভয়াবহ মূল্য দিতে হয়—সময়, মানসিক যন্ত্রণা, শারীরিক ক্লান্তি, মানবিক অপমান—তা কোনো পরিসংখ্যানেই ধরা পড়ে না।

অন্যদিকে বেসরকারি হাসপাতালে অভিজ্ঞতা ভিন্ন হলেও সুখকর নয়। আধুনিক অবকাঠামো, শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত পরিবেশ, দ্রুত পরীক্ষা ও যত্নশীল আচরণের বিপরীতে দাঁড়িয়ে থাকে ভয়াবহ ব্যয়ভার। সেখানে একজন রোগীর চিকিৎসা নির্ধারিত হয় তার অর্থ-সামর্থ্য দিয়ে, প্রয়োজন দিয়ে নয়। এক থেকে দুই হাজার টাকা ফি দিয়ে ডাক্তার দেখানো, সরকারি খরচের কয়েক গুণ ব্যয়ে প্রতিটি টেস্ট করা, শয্যার জন্য অত্যধিক ভাড়া পরিশোধ, এবং সবচেয়ে কষ্টকর বিষয়—অপ্রয়োজনীয় টেস্ট ও চেকআপের চোরাবালি। সুবিধা মিললেও প্রশ্ন রয়ে যায়—এই চিকিৎসা কি সত্যিই ন্যায্য, নাকি বাজার অর্থনীতির নির্মমতায় বন্দি এক ব্যবসায়িক মডেল?

আরও ভয়াবহ দিক হলো—জরুরি পরিস্থিতি। দুর্ঘটনায় আহত কেউ সরকারি হাসপাতালে গেলে দ্রুত সেবা পাওয়া সম্ভব হলেও বেসরকারি হাসপাতালে ছোট-বড় যেকোনো জরুরি কেসে ‘পুলিশ কেস’ কিংবা ‘ব্যয়ভার বহনের নিশ্চয়তা’ না থাকলে অধিকাংশ সময় রোগীকে ফিরিয়ে দেওয়া হয়। কিছুক্ষণের প্রাথমিক চিকিৎসার পর পাঠিয়ে দেওয়া হয় সরকারি হাসপাতালে। মানবিকতা নয়, সেখানে প্রথমে দেখা হয় অর্থ, নিয়ম এবং দায়বদ্ধতার হিসাব।

স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থা দীর্ঘদিন ধরে এক ধরনের নীতিহীনতা ও রাজনৈতিক উদাসীনতার ফাঁদে আটকে আছে। সরকার স্বাস্থ্য খাতে যে পরিমাণ হাসপাতাল, ডাক্তার, নার্স, যন্ত্রপাতি ও দক্ষ জনবল রাখার কথা—তা কোনোভাবেই বাস্তবায়িত হয়নি। এই ঘাটতির সুযোগে বেসরকারি হাসপাতালগুলো গজিয়ে উঠেছে, কিন্তু সেবার পরিবর্তে মুনাফা অর্জনই তাদের প্রথম লক্ষ্য। সরকারি হাসপাতালে যন্ত্রপাতি পড়ে থাকে অকেজো, কমিউনিটি ক্লিনিকগুলো কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য পূরণ করতে পারছে না, সুশাসনের অভাব সর্বত্র প্রকট। উন্নয়ন বাজেট বরাদ্দ পেলেও তা সময়মতো ছাড়ে না, ফলে ওষুধ ও উপকরণের সংকট থেকে যায়। রোগীরা এসে দেখে—ডাক্তার নেই, ওষুধ নেই, যন্ত্রপাতি নষ্ট। বাধ্য হয়েই তারা ছুটে যায় বেসরকারি হাসপাতালে, যদিও জানে—ওখানে তাদের ওপর আরেক দফা আর্থিক চাপ অপেক্ষা করছে।

এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আরেকটি বড় সমস্যা—দালাল চক্র ও চিকিৎসকদের দ্বৈত ভূমিকা। সরকারি হাসপাতালে দালালদের দাপট রোগীদের বিভ্রান্ত করে বেসরকারি হাসপাতালে পাঠিয়ে দেয়, আর সরকারি হাসপাতালের বহু চিকিৎসক বিকেলে নিজেরা সেই বেসরকারি চেম্বারে রোগী দেখেন। ফলে সিস্টেমের ভেতর থেকে সিস্টেমকেই দুর্বল করার প্রবণতা চলে আসছে বছরের পর বছর। একই সঙ্গে নার্স ও প্যারামেডিকের স্বল্পতা, দুই আলাদা অধিদপ্তরের দ্বন্দ্ব, প্রশাসনিক বিশৃঙ্খলা—সব মিলিয়ে সরকারি স্বাস্থ্যসেবার ভরাডুবি যেন নিশ্চিত।

বেসরকারি চিকিৎসায়ও ভয়াবহ অনিয়ম—উদাহরণস্বরূপ গর্ভবতী নারীদের ক্ষেত্রে ৭০–৮০ শতাংশ সিজারিয়ান অপারেশন করানো, যেখানে বিশ্বমান অনুযায়ী সর্বোচ্চ ১৫ শতাংশ হওয়া উচিত। কিন্তু এসব নিয়ন্ত্রণ করবে কে? বেসরকারি হাসপাতালের বড় অংশই ক্ষমতাবানদের মালিকানায়। তদারকির অভাব, রাজনৈতিক প্রভাব এবং অস্পৃশ্যতার সংস্কৃতি বেসরকারি হাসপাতালগুলোকে প্রায় অপ্রতিরোধ্য শক্তিতে পরিণত করেছে।

বাংলাদেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থার এই সংকট কোনো একদিনের সৃষ্টি নয়, কিন্তু সমাধানও কোনো একদিনে আসবে না। প্রয়োজন রাজনৈতিক সদিচ্ছা, সুশাসন, বাজেটে বাস্তবসম্মত বরাদ্দ, এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ—মানুষের মৌলিক অধিকারকে ব্যবসার সংকীর্ণ গণ্ডি থেকে মুক্ত করার দৃঢ় কৌশল। নীতিমালা আছে, বাস্তবায়ন নেই; যন্ত্রপাতি আছে, চালানোর মানুষ নেই; ভবন আছে, সেবার মনোযোগ নেই—এই বৈপরীত্য দূর না হলে স্বাস্থ্যব্যবস্থা কখনোই রোগীর হবে না, হবে শুধু ক্ষমতা, দালালি ও ব্যবসার হাতিয়ার।

আজ বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ চিকিৎসা পেতে গিয়ে শুধু রোগের সঙ্গে নয়, ব্যবস্থা নামক এক দানবের সঙ্গেও যুদ্ধ করে। সরকারি হাসপাতালে অবহেলার চাপ, বেসরকারি হাসপাতালে ব্যয়ের চাপ—এই দুই মুখো চিকিৎসা ব্যবস্থার মাঝে দাঁড়িয়ে মানুষের একমাত্র প্রশ্ন—এই রাষ্ট্র কি সত্যিই তার নাগরিকের স্বাস্থ্য অধিকার নিশ্চিত করতে চায়, নাকি মানুষকে বোঝায় যে চিকিৎসা এখন সুবিধাভোগীদের জন্য একটি বিশেষাধিকার?

এই প্রশ্নের উত্তরই নির্ধারণ করবে বাংলাদেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থার আগামী পথ।

ভালো লাগলে নিউজটি শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর..
© All rights reserved © 2011-2025 VisionBangla24.Com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com