শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ০১:০১ অপরাহ্ন
ভিশন বাংলা ডেক্স: ইনসমনিয়া, যার প্রকৃত অর্থ ঘুমাতে না পারা বা অনিদ্রা। অল্প কথায় একটু বিস্তারিতভাবে বলতে গেলে ঘুমাতে কষ্ট হওয়া, ঘুম গভীর না হওয়া, তাড়াতাড়ি জেগে ওঠা কিংবা বা খুব অল্প সময়ের জন্য ঘুম হওয়াকে ইনসমনিয়া বলে। এই সমস্যা যাদের আছে তারা নিদ্রার ফলে যে বিশ্রাম পাওয়া যায় তা থেকে বঞ্চিত হন। ফলে তারা অবসাদে ভোগেন।
একজন মানুষের কয় ঘণ্টা ঘুম দরকার তা জীবনযাপনের ওপর নির্ভর করে। বিশেষজ্ঞদের মতে, পূর্ণবয়স্ক মানুষের ৭-৮ ঘণ্টা ঘুমই যথেষ্ট। এর চেয়ে কম ঘুমিয়েও অনেকেরই কোনো শারীরিক ও মানসিক সমস্যা দেখা দেয় না। ইন্দ্রিরা গান্ধি মাত্র দু’ঘণ্টা ঘুমিয়ে সারাদিন পূর্ণ শক্তি নিয়ে কাজ করতেন। যারা যোগব্যায়াম করেন তারা ৪-৫ ঘণ্টা ঘুমিয়েও পূর্ণ তৃপ্তি নিয়ে জেগে থেকে ক্লান্তিহীনভাবে গোটা দিন দিব্যি কাজ করে যান। শিশুরা অনেক বেশি ঘুমায়। বয়স যতই বাড়ে ঘুম ততই কমে। তাই বৃদ্ধকালে অনেকেই অনিদ্রায় ভোগেন।
ঘুম না হওয়ার প্রধান কারণ স্নায়বিক সমস্যা। যারা বেশি মেধা ব্যবহার করেন তাদের মধ্যে এ সমস্যা বেশি দেখা যায়। ঘুম আসছে না- এই দুশ্চিন্তা ঘুম আসাকে আরো কঠিন করে তোলে। বৈজ্ঞানিক গবেষণায় জানা গেছে, মস্তিষ্কের মেডুলা ও মিডব্রেনের মাঝখানে রয়েছে জাগ্রত কেন্দ্র। এই কেন্দ্র যখন কাজ করে তখন আমরা জেগে থাকি। আর কাজ বন্ধ করলে ঘুমিয়ে পড়ি। এই কেন্দ্রের কাজ নিয়ন্ত্রিত হয় হরমোন সংকেতের সাহায্যে। শরীরের ও মনের অবস্থার ওপর নির্ভর করে হরমোন নিঃসরণের মাত্রা। ইনসমনিয়া দুই ধরনের- ১. প্রাইমারি ইনসমনিয়া, ২.সেকেন্ডারি ইনসমনিয়া।
প্রাইমারি ইনসমনিয়ার কারণ মানসিক দুশ্চিন্তা, ছোটোখাটো শারীরিক অসুস্থতা এবং বিষণ্নতা। আর সেকেন্ডারি ইনসমনিয়ার কারণ মানুষের কঠিন রোগে ভোগা, যেমন- ক্যান্সার, হৃদরোগ, ব্রেন স্ট্রোক, কিডনির সমস্যা, আরথ্রাইটিন, ফিব্রো, মায়ালজিয়া ইত্যাদি।
গবেষণার মাধ্যমে দেখা গেছে, ইনসমনিয়া রোগীদের হার্টঅ্যাটাক এবং ব্রেন স্ট্রোকের সম্ভাবনা অনেক বেশি। গবেষণায় আরো বলা হয়েছে, আমাদের মস্তিষ্কের ‘নেগেটিভ ইফেক্টের’ ফলে বিষণ্নতা দেখা দেয়। দুশ্চিন্তা বাড়ায়। ঘুম না আসা কিংবা কম ঘুম হওয়া আমাদের শরীরের ওজন বৃদ্ধি করে। আর স্থূলতা অনেক রোগের কারণ। এতে কোলেস্টেরলের ভারসাম্যহীনতা, ডায়াবেটিস, হাড়ের সংযোগস্থলের ব্যথা, হৃদরোগ এবং ব্রেন স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ে।
অনিদ্রার জন্য ঘুমের বড়ি খাওয়া স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। তা সত্ত্বেও পৃথিবীর লক্ষ লক্ষ মানুষ নিয়মিত ঘুমের ওষুধ খাচ্ছেন। এটি একবার আরম্ভ করলে তা অভ্যাসে পরিণত হয়। তখন ওষুধ ছাড়া ঘুম হয় না। প্রথম দিকে অল্প মাত্রার ওষুধে ঘুম হলেও ক্রমশ মাত্রা বাড়তে থাকে। তাছাড়া স্বাভাবিক ঘুম যেমন প্রশান্তিদায়ক, ঘুমের বড়ি খেয়ে ঘুমানো তেমন নয়। এই ওষুধের পার্শ্বপ্রক্রিয়ায় কিডনি ও যকৃতের সমস্যা, রক্ত সঞ্চালন ও শ্বাসযন্ত্রের সমস্যা, উচ্চ রক্তচাপ ক্ষুধামন্দা ইত্যাদি দেখা দেয়।
আধুনিক যুগে আমরা যেকোনো কাজের পেছনে বৈজ্ঞানিক ভিত্তি খুঁজে থাকি। আমরা যে ব্যায়াম করছি তা কতটুকু বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে হচ্ছে তা জানা প্রয়োজন। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড মেডিক্যাল স্কুলের একটি রিসার্চে দেখানো হয়েছে ইনসমনিয়া রোগীদের কোন ধরনের শরীরচর্চা বেশি উপকারে আসে। গবেষকরা বলছেন, ইয়োগা প্রাণায়ামের মাধ্যমে ঘুমের গুণগতমান বিস্ময়করভাবে বেড়েছে। দিনের জন্য নির্ধারিত কিছু প্রাণায়াম, যেমন- নাড়ি শোধন, ভ্রামারী প্রাণায়াম, শীতলী প্রাণায়াম ইত্যাদি দারুণ উপকারী হয়ে ওঠে। প্রতিদিনের করণীয় আসন, যেমন- শর্শাঙ্গাসন, উষ্ট্রাসন, অর্ধমেসন্দ্রাসন, অর্ধচন্দ্রাসন, পদহস্তাসন, মহামুদ্রা, সর্বোপরি শবাসন অনিদ্রা রোগের জন্য অবশ্য করণীয়। যোগব্যায়াম বা ইয়োগা করতে গিয়ে যে শারীরিক শ্রম দিতে হয় তা গভীর ঘুম এনে দেয়। প্রাণায়াম মানসিক দুঃশ্চিন্তারোধে সহায়ক। এতে মধ্য স্নায়ুতন্ত্রে রক্ত চলাচল রক্ত সঞ্চালন ঘটে এবং পর্যাপ্ত অক্সিজেন পৌঁছায় যা ভালো ঘুমের সহায়ক।
যদি বলি ‘স্বাস্থ্যই সকল সুখের মূল’, তাহলে আমরা নিজের জন্যে বরাদ্দ ২৪ ঘণ্টার মধ্যে একটা ঘণ্টা সময় ব্যয় করি কিছু যোগাসন আর প্রাণায়ামের পেছনে। বিনিময়ে আমরা পেতে পারি ক্লান্তিহীন একটি দিন। এতে কাজের গুণগত মান বেড়ে যাবে। অবসাদমুক্ত দিনযাপনের আনন্দই আলাদা।
লেখক: প্রশিক্ষক, ইয়োগামরিতা ইয়োগা ইনস্টিটিউট