মঙ্গলবার, ১৯ নভেম্বর ২০২৪, ০৬:২৭ পূর্বাহ্ন
হিমু আহমেদ:
গতকাল ১৬ নভেম্বর ২০২৪ শনিবার সন্ধ্যে ৬টায় কল্যাণব্রতের কবি আফজাল চৌধুরীকে নিবেদিত কেমুসাস সাহিত্য সম্মেলন ২০২৪ ও দশম-পঞ্চদশ কেমুসাস সাহিত্য পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠান কেমুসাস’র শহীদ সোলেমান হলে অনুষ্ঠিত হয়েছে। এর মধ্যে চতুর্দশ কেমুসাস সাহিত্য পুরস্কার পেয়েছেন সব্যসাচী লেখক মীর লিয়াকত আলী। দেশের ৮৯ বছরের প্রাচীন সাহিত্য প্রতিষ্ঠান কেন্দ্রীয় মুসলিম সাহিত্য সংসদ অর্থাৎ কেমুসাস প্রবর্তিত কেমুসাস সাহিত্য পুরস্কারের জন্যে ৬ বিশিষ্ট লেখককে মনোনীত করা হয়েছিল। তাদেরকে আনুষ্ঠানিকভাবে পুরস্কার প্রদান করা হয়েছে।কেমুসাস সাহিত্য সম্মেলন ২০২৪ ও দশম-পঞ্চদশ কেমুসাস সাহিত্য পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসাবে উপস্থিত ছিলেন মানারাত ইন্টা. ইউনিভার্সিটি ঢাকার ভাইস চ্যান্সেলার ড. আব্দুর রব। অনুষ্ঠানটিকে সভাপতিত্ব করেছেন দৈনিক মিরর পত্রিকার সম্পাদক ও সিলেট প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি আহমেদ নুর। অন্যান্য পুরস্কারপ্রাপ্তরা হচ্ছেন রাগিব হোসেন চৌধুরী (দশম কেমুসাস সাহিত্য পুরস্কার ২০১৯), আবদুল হামিদ মানিক (একাদশ কেমুসাস সাহিত্য পুরস্কার ২০২০), আমেনা আফতাব (দ্বাদশ কেমুসাস সাহিত্য পুরস্কার ২০২২), মুকুল চৌধুরী (ত্রয়োদশ কেমুসাস সাহিত্য পুরস্কার ২০২১), এবং শাকুর মজিদ (পঞ্চদশ কেমুসাস সাহিত্য পুরস্কার ২০২৪)।
মুসলিম সাহিত্য সংসদ ২০০১ সাল থেকে কেমুসাস সাহিত্য পুরস্কার প্রদান করে আসছে। ২০০১ সালের ১৩ জানুয়ারি প্রথম কেমুসাস সাহিত্য পুরস্কার কথাশিল্পী অধ্যাপক শাহেদ আলীকে প্রদান করা হয়েছিল। পরবর্তীতে ২০০২ সালে সাহিত্যিক সৈয়দ শামসুল ইসলাম, ২০০৪ সালে গবেষক অধ্যাপক আসাদ্দার আলী, ২০০৬ সালে গবেষক সৈয়দ মোস্তফা কামাল, ২০০৮ সালে গবেষক ড. গোলাম কাদির, ২০০৯ সালে গবেষক দেওয়ান নূরুল আনোয়ার হোসেন চৌধুরী, ২০১০ সালে শিক্ষাবিদ-গবেষক প্রফেসর মো. আব্দুল আজিজ, ২০১৩ সালে সাংবাদিক-বীর মুক্তিযোদ্ধা সালেহ চৌধুরী, ২০১৬ সালে কবি মোফাজ্জল করিম এবং সর্বশেষ ২০১৮ সালে কবি নৃপেন্দ্র লাল দাসকে কেমুসাস সাহিত্য পুরস্কার প্রদান করা হয়েছিল।
পরবর্তীতে ২০২৪ পর্যন্ত কাউকে উক্ত পুরস্কার প্রদান করা হয়নি। পুরস্কার প্রদানের ধারাবাহিকতায় ২০১৯ থেকে ২০২৪ পর্যন্ত ৬ জন লেখককে সার্বিক সাহিত্যকর্ম বিবেচনা করে কেমুসাস সাহিত্য পুরস্কার প্রদান করা হচ্ছে।
কেন্দ্রীয় মুসলিম সাহিত্য সংসদ অর্থাৎ কেমুসাস প্রবর্তিত কেমুসাস সাহিত্য পুরস্কারের জন্যে যে ৬ বিশিষ্ট লেখককে মনোনীত করা হয়েছে তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছেন সব্যসাচী লেখক মীর লিয়াকত আলী। শিক্ষা সংগঠন সাহিত্য সংস্কৃতি সাংবাদিকতার প্রায় সকল শাখায় প্রায় অর্ধশতাব্দীকাল তাঁর রয়েছে একটানা বিচরন। মীর লিয়াকত আলী একজন পরিচ্ছন্ন নিরলস নিভৃতচারী সব্যসাচী। তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে সাহিত্যের প্রায় সকল শাখার উপকরন। কবিতা, ছড়া, কল্পকাহিনী, ভ্রমন, গীতিনাট্য, কাব্যনাটক, ছোটগল্প, কলাম, গীতিকবিতা, উপন্যাস, রূপকথা, প্রবন্ধ, গবেষণা, নাটক, অনুবাদ সাহিত্য, শিশুকিশোর সাহিত্য, নিবন্ধ, জীবন বৈচিত্র ইত্যাদি। এর মধ্যে প্রকাশিত উপন্যাস সমগ্র, গল্প সমগ্র, সঙ্গীত সমগ্র, কবিতা সমগ্র, লিমেরিক সমগ্র, উল্লেখযোগ্য। মুক্তিযুদ্ধের উপর তাঁর লেখা একাধিক উপন্যাস ইতোপূর্বে প্রশংসিত হয়েছে। প্রকাশিত গ্রন্থ একশত ছিচল্লিশটি। প্রথম প্রকাশিত গ্রন্থ ‘যেমন যেখানে জীবন।’ ১৯৬৮ সালে এমসি কলেজে অধ্যয়নকালে তাঁর প্রথম লেখা প্রকাশিত হয়েছিল। করাচী বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে তারঁ রচিত কয়েকটি পাণ্ডুলিপি স্বাধীনতাত্তোরকালে প্রকাশিত হয়েছিল।
সুসাহিত্যিক মীর লিয়াকত আলীর লেখা সিলেটী ছড়া, শ্রীহট্টিয়া ছড়া (নাগরীসহ), সিলেটের আঞ্চলিক গান, প্রেমের রাজা হাসন রাজা, হাসন রাজার গান, বাউল সম্রাট শাহ আব্দুল করিম ও তাঁর গান, সিলেটী ডায়ালগ গ্রন্থগুলি আদৃত হয়েছে। এছাড়া তাঁর লেখা সিলেটী আঞ্চলিক নাটক দেশে বিদেশে মঞ্চস্থ হয়েছে, প্রচারিত হয়েছে সিলেট বেতার ও টেলিভিশনে। এর মধ্যে সুরমা নাটকটি ভারতসহ সিলেটের বিভিন্ন স্থানে বিশোর্ধবার মঞ্চস্থ হয়েছে। টেলিনাটক রয়েছে ইউটিউবে যার ভিউ রয়েছে লক্ষ লক্ষ।
সব্যসাচী লেখক মীর লিয়াকত আলীর জন্ম সিলেটের শমশেরনগরে। তাঁর বাসা সুবিদবাজারের লন্ডনী রোডে। বসবাস করেন ঢাকার উত্তরায়। বহু সংগঠনের তিনি প্রতিষ্ঠাতা। রয়েছে একাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠায় তাঁর অগ্রণী ভূমিকা। ১৯৭২ সালে কমলগঞ্জে সুরাসর এবং ১৯৭৬ কমলগঞ্জ প্রেসক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতির অভিজ্ঞতা নিয়ে পরবর্তীকালে ১৯৮২ সালে ঢাকায় গড়ে তুলেছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম জাতীয় ভিত্তিক অবাধ সাংবাদিক সংগঠন ‘জাতীয় সাংবাদিক সংস্থা’ যা এখন সারা দেশে বিস্তৃত। ‘ঢাকা কালচারেল পর্ষদ’ এর তিনি চেয়ারম্যান এবং ‘ইন্টারন্যাশনাল কালচারাল ফোরাম’ আইসিএফ এর কেন্দ্রীয় মহাসচিব। দেশের শিল্পসাহিত্যের শীর্ষ ব্যক্তিবর্গের সমন্বয়ে সংগঠিত জাতীয় সাংস্কৃতিক সংস্থা’র তিনি ছিলেন অন্যতম শীর্ষ নীতিনির্ধারক। তিনি বেতার ও টেলিভিশনের গীতিকার, সুরকার, সঙ্গীত পরিচালক ও শিল্পী। বর্তমানে তিনি দৈনিক আলোর জগত এর উপদেষ্টা সম্পাদক, এবং একাধিক অনলাইন পোর্টাল এবং সুসময় সম্পাদকমন্ডলীর সভাপতি। সাংবাদিক সংস্থা, ঢাকার জালালাবাদ এসোসিয়েশন, সিলেট বিভাগ উন্নয়ন পরিষদ, সিলেট সমিতি উত্তরা এর আজীবন সদস্য। সিলেট সমিতি উত্তরা, জালালাবাদ এসোসিয়েশন, ঢাকা রেসিডেন্সিয়েল ল্যাবরেটরী কলেজ সহ বিভিন্ন বার্ষিক ম্যাগাজিন সম্পাদনা করেছেন ও করছেন। বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ দেশে বিদেশে সম্মানিত হয়েছেন। তাঁর জীবন ও কর্ম নিয়ে বাংলা একাডেমী বইমেলায় ‘সব্যসাচী মীর লিয়াকত’, ‘নিভৃতচারী মীর লিয়াকত’, চিরন্তন শব্দমালাসহ কয়েকটি প্রকাশিত গ্রন্থ পাঠক সমাদৃত হয়েছে। তাঁর সামগ্রিক সৃষ্টি নিয়ে অতিসম্প্রতি রাজধানীর বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে অনুষ্ঠিত বিশেষ অনুষ্ঠানে দেশের খ্যাতিমান ব্যক্তিবর্গ অংশগ্রহন করেছিলেন।
সুসাহিত্যিক মীর লিয়াকত আলী সম্পাদনা করছেন বিভিন্ন গ্রন্থ, সাহিত্য সংস্কৃতি সাময়িকী বিকিরণ, আলো, নুড়ি ইত্যাদি। এর মধ্যে ১৯৭৭ সালে সিলেট থেকে তাঁর সম্পাদনায় প্রকাশিত সাহিত্যপত্রিকা ‘বিকিরণ’ এর প্রকাশনা এখনো অব্যাহত রয়েছে। শুরুতে এর প্রধান সম্পাদক ছিলেন খলিলুর রহমান কাসেমী, সম্পাদক মীর লিয়াকত আলী এবং নির্বাহী সম্পাদক ছিলেন মহিরউদ্দিন শীরু। এছাড়া বক্স ছাপাঘর থেকে তার সম্পাদিত মূর্চ্ছনাও প্রকাশিত হয়েছিল।
সব্যসাচী লেখক মীর লিয়াকত আলী কেমুসাসের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা মুহম্মদ নুরুল হক এর খুব প্রিয়ভাজন ছিলেন। সত্তরের দশকে কেমুসাসে তাঁর যাতায়াত ছিলো বেশি। সে সময় মুহম্মদ নুরুল হক সম্পাদিত ঐতিহ্যবাহী ‘আল ইসলাহ’তে মীর লিয়াকত আলীর বেশ কয়েকটি সনেট প্রকাশিত হয়েছিল। এই সনেটগুলো নিয়ে তাঁর ‘সনেট অঞ্জলি’ গ্রন্থটি পরবর্তীকালে বাংলা একাডেমী বইমেলায় প্রকাশিত হয়েছিল। এছাড়া মুহম্মদ নুরুল হককে নিয়ে তাঁর আবেগপূর্ণ একাধিক লেখা সে সময় দৈনিক আজাদ ও যুগভেরীতে প্রকাশিত হয়েছিল।
সব্যসাচী লেখক মীর লিয়াকত আলী তাঁর সুদীর্ঘ সাহিত্যজীবনের স্বীকৃতিস্বরূপ জীবনের শেষপ্রান্তে এসে এ পুরস্কার অর্জন করায় সাহিত্যবোদ্ধামহল অভিনন্দন জানিয়েছেন। বাংলা একাডেমির ফেলো প্রাবন্ধিক আহমদ সিরাজ, দৈনিক আলোর জগত পত্রিকার প্রধান সম্পাদক তুহিন ভূইয়া, বিলেতপ্রবাসী জনপ্রিয় ছড়াকার রব্বানী চৌধুরী, বিলেতপ্রবাসী কবি ও স্বচিন্তা সম্পাদক সৈয়দ মাসুম, সাংবাদিক ও কবি এসএমএ মোহিন, কবি, সঙ্গীতশিল্পী এবং সম্পাদক সাইফুল খান, কবি ফারহানা মাহমুদ তান্নিসহ বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ কেমুসাসের এ উদ্যোগের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন এবং মীর লিয়াকত আলীকে অভিনন্দন জানিয়েছেন।
[হিমু আহমেদ, himuahmed964011@gmail.com]