শুক্রবার, ০৮ অগাস্ট ২০২৫, ০৫:৫৩ পূর্বাহ্ন
তুহিন ভূঁইয়া, ঢাকা:
গাজীপুরে মাত্র ২৪ ঘণ্টার ব্যবধানে দুইজন সংবাদকর্মীর ওপর নৃশংস হামলার ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে একজনকে নির্মমভাবে পিটিয়ে আহত করা হয়েছে পুলিশের সামনেই, আরেকজনকে জনবহুল এলাকায় কুপিয়ে ও জবাই করে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা। এ ঘটনায় দেশের সাংবাদিক সমাজ, সাধারণ জনগণ এবং মানবাধিকার সংগঠনগুলোর মাঝে তীব্র ক্ষোভ ও উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়েছে। প্রশ্ন উঠেছে একজনের উপর হামলার পরে প্রশাসন যদি সক্রিয় হতো তাহলে কী আরেকজনকে এভাবে কুপিয়ে হত্যা করতে পারতো!!!
সকালে পিটিয়ে গুরুতর আহত করে আনোয়ার হোসেনকে
বৃহস্পতিবার (৭ আগস্ট) সকাল ১০টার দিকে গাজীপুর সদর থানার পাশেই ঘটে প্রথম হামলার ঘটনা। ‘দৈনিক বাংলাদেশের আলো’ পত্রিকার জেলা প্রতিনিধি আনোয়ার হোসেনকে একদল দুর্বৃত্ত প্রকাশ্যে পিটিয়ে, টেনে-হিঁচড়ে মাটিতে ফেলে দেয় এবং ইট দিয়ে তার মাথা ও শরীর থেঁতলে দেয়। প্রত্যক্ষদর্শীদের অভিযোগ, ঘটনাস্থলে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা উপস্থিত থাকলেও তারা কোনো প্রকার হস্তক্ষেপ করেননি।
আনোয়ার হোসেন নিয়মিতভাবে গাজীপুর অঞ্চলের চাঁদাবাজি, দুর্নীতি ও অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড নিয়ে প্রতিবেদন করতেন। তারই ধারাবাহিকতায় সম্প্রতি একটি চাঁদাবাজ চক্রের বিরুদ্ধে সংবাদ প্রকাশ করেন তিনি। ধারণা করা হচ্ছে, সেই প্রতিবেদনের প্রতিশোধ হিসেবেই এই হামলা চালানো হয়েছে।
আহত সাংবাদিককে উদ্ধার করে শহীদ তাজউদ্দীন আহমেদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, তার পায়ে গুরুতর জখম হয়েছে এবং শরীরজুড়ে মারাত্মক আঘাত রয়েছে।
রাতে কুপিয়ে হত্যা আসাদুজ্জামান তুহিনকে
এই ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই রাত ৮টার দিকে ঘটে আরেক মর্মান্তিক ঘটনা। চান্দনা চৌরাস্তা মসজিদ মার্কেট এলাকায় ‘দৈনিক প্রতিদিনের কাগজ’ পত্রিকার গাজীপুর জেলা প্রতিনিধি আসাদুজ্জামান তুহিন (৩৮)-কে প্রকাশ্যে কুপিয়ে হত্যা করা হয়।
তুহিন সেই সময় চায়ের দোকানে বসেছিলেন। এর কিছুক্ষণ আগে তিনি ফুটপাতে চাঁদাবাজি নিয়ে একটি লাইভ সম্প্রচার করেন এবং একটি ফেসবুক পোস্ট দেন। এরপরই মুখোশধারী সন্ত্রাসীরা ধারালো অস্ত্র নিয়ে তার ওপর হামলা চালায়। তারা তাকে কুপিয়ে ফেলে এবং গলা কেটে মৃত্যু নিশ্চিত করে পালিয়ে যায়। ঘটনাস্থলেই তার মৃত্যু হয়।
তুহিন ছিলেন ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া থানার ভাটিপাড়া গ্রামের বাসিন্দা। তিনি পরিবারসহ গাজীপুরে বসবাস করতেন।
সাংবাদিক সমাজে শোক, ক্ষোভ ও প্রতিবাদ
এই দুটি ঘটনায় সাংবাদিক সমাজে নেমে এসেছে শোকের ছায়া ও প্রতিবাদের আগুন। গাজীপুর প্রেসক্লাবসহ বিভিন্ন সংগঠন দ্রুত বিচার ও দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানিয়েছে।
প্রশাসনের প্রতিক্রিয়া
গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের জিএমপি সদর থানার ওসি মেহেদী হাসান বলেন, “ঘটনাটি আমরা গুরুত্ব সহকারে তদন্ত করছি। অভিযুক্তদের শনাক্ত করে দ্রুত আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
তবে এখনো পর্যন্ত আনোয়ার হোসেনের পরিবারের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ জমা দেওয়া হয়নি বলেও জানান তিনি।
বাসন থানার ওসি শাহীন খান জানান, তুহিন হত্যা তদন্তে পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলো কাজ করছে। ময়নাতদন্ত শেষে লাশ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হবে।
সাংবাদিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত হোক
এই দুটি ঘটনা আবারও প্রমাণ করলো—বাংলাদেশে সাংবাদিকতা পেশা এখনো নিরাপদ নয়। পুলিশের সামনেই একজন সাংবাদিককে ইট দিয়ে মাথা থেঁতলে দেওয়া এবং আরেকজনকে জনসম্মুখে জবাই করে হত্যার ঘটনায় প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তা বড় প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। সাংবাদিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে প্রশাসনের আরও কঠোর ও কার্যকর পদক্ষেপ এখন সময়ের দাবি।
এই হত্যাকাণ্ড কেবল আসাদুজ্জামান তুহিন বা আনোয়ার হোসেনের উপর আঘাত নয়—এটি সত্য, ন্যায় ও স্বাধীন মতপ্রকাশের উপর একটি সুপরিকল্পিত ও বেপরোয়া হামলা। সাংবাদিকদের উপর হামলার বিরুদ্ধে এখনই জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলা প্রয়োজন।