শেয়ারবাজারের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) সাবেক ইন্স্যুরেন্স ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড রেগুলেটরি অথরিটি (আইডিআরএ)-এর চেয়ারম্যান এম মোশাররফ হোসেনের বিরুদ্ধে ‘ইনসাইডার ট্রেডিং’ ও শেয়ারবাজারের কারসাজির অভিযোগ খতিয়ে দেখতে তদন্ত শুরু করেছে।
তদন্তের উদ্দেশ্য হলো মোশাররফের আইডিআরএ-তে দায়িত্ব পালনের সময় ডেল্টা লাইফ ইন্স্যুরেন্স, পদ্মা ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স, প্রভাতী ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি, এশিয়া ইন্স্যুরেন্স এবং ইস্টার্ন ইন্স্যুরেন্স সংক্রান্ত গোপন নিয়ন্ত্রক তথ্য শেয়ারবাজারে লেনদেনের জন্য ব্যবহার করা হয়েছিল কিনা, তা যাচাই করা। এছাড়া, সুবিধাভোগী তথ্য ব্যবহার করে তার স্ত্রী নিয়ন্ত্রিত প্রভিডেন্ট ফান্ড বা অন্যান্য প্রাতিষ্ঠানিক তহবিল ট্রেডিংয়ের জন্য ব্যবহার করা হয়েছিল কিনা, সে বিষয়টিও তদন্ত করে দেখা হচ্ছে।
নিয়ন্ত্রক সংস্থার সূত্রমতে, বিএসইসি গত সেপ্টেম্বরে এই তদন্ত পরিচালনার জন্য ডেপুটি ডিরেক্টর মাওদুদ মোমেন, সহকারী পরিচালক মো. মেহেদী হাসান রনি এবং সহকারী পরিচালক নাভিদ হাসান খানকে নিযুক্ত করেছে এবং আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে তাদের প্রতিবেদন জমা দেওয়ার কথা রয়েছে। নিয়ন্ত্রক সংস্থা এই অভিযোগটিও খতিয়ে দেখছে যে মোশাররফ এবং তার স্ত্রী জান্নাতুল মাওয়া তাদের ব্যক্তিগত কোম্পানিগুলোর অধীনে থাকা প্রভিডেন্ট ফান্ডের ৩৩ কোটি টাকা ব্যক্তিগত ব্যবসা পরিচালনার উদ্দেশ্যে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করেছেন।
জানা যায়, মোশাররফ আইডিআরএ-তে কর্মরত থাকাকালীন ‘লাভস অ্যান্ড লাইভ অর্গানিক লিমিটেড’ এবং ‘গুলশান ভ্যালি এগ্রো ইন্ডাস্ট্রিজ’ নামে দুটি কোম্পানি খোলেন। তিনি উভয় প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন, আর তার স্ত্রীকে পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব প্রদান করা হয়। এই কোম্পানিগুলোর নামে চারটি পৃথক তহবিল তৈরি করা হয় এবং লেনদেনের জন্য চারটি ‘বেনিফিশিয়ারি ওনার (বিও)’ অ্যাকাউন্ট খোলা হয়।
আইডিআরএ-তে যোগদানের পর মোশাররফ এই চারটি তহবিলের ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান হন এবং প্রভিডেন্ট ফান্ড থেকে ৩২ কোটি ৯১ লাখ টাকা উল্লিখিত পাঁচটি তালিকাভুক্ত কোম্পানির শেয়ারে চ্যানেলাইজ করা হয়। কর্মকর্তারা প্রশ্ন তুলেছেন যে, মূলত কাগজপত্রে থাকা কোম্পানিগুলোর সঙ্গে যুক্ত প্রভিডেন্ট অ্যাকাউন্টগুলোতে জমা হওয়া তহবিলের উৎস কী, যেখানে প্রভিডেন্ট ফান্ডের মোট সম্পদের ২৫ শতাংশের বেশি বিনিয়োগের অনুমতি নেই।
বিনিয়োগ সম্পর্কে জানতে চাওয়া হলে মোশাররফ গণমাধ্যমকে বলেন, “৩৩ কোটি টাকা একটি বড় অঙ্ক, এর অর্ধেকও বিনিয়োগ করা হয়নি।” তিনি দাবি করেন, তখন বাজারে অনেক আইপিও ছিল এবং একই অর্থ ঘূর্ণায়মান তহবিল হিসেবে বিভিন্ন আবেদনে দেখানো হয়েছিল। তিনি আরও যোগ করেন, এই বিনিয়োগগুলো আইডিআরএ-তে যোগদানের আগেই করা হয়েছিল। সেই সময় শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল।
তিনি বলেন, “আইডিআরএ চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নেওয়ার পর আমি প্রচণ্ড ব্যস্ত হয়ে পড়ি। আমার প্রতিনিধি হয়তো ভুলবশত ডেল্টা লাইফ ইন্স্যুরেন্সের শেয়ার কিনে থাকতে পারে।” তবে তিনি অন্য চারটি কোম্পানির শেয়ার সম্পর্কে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। তিনি জানান, এই বিষয়ে তিনি ইতোমধ্যেই কয়েকটি তদন্ত সংস্থাকে তথ্য দিয়েছেন।
তদন্ত সম্পর্কে জানতে চাওয়া হলে বিএসইসি’র মুখপাত্র ও পরিচালক আবুল কালাম সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, “শেয়ারবাজারে স্বচ্ছতা বাড়ানোর জন্য কমিশন এই তদন্ত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। অভিযোগ প্রমাণিত হলে আইন অনুযায়ী কমিশন ব্যবস্থা নেবে।”
এর আগে, ১৮ নভেম্বর দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) মোশাররফ ও তার স্ত্রীর বিরুদ্ধে অবৈধভাবে ১৪.৫ কোটি টাকা সম্পদ অর্জনের অভিযোগে দুটি মামলা দায়ের করে।
বীমা ও বিনিয়োগ খাতে দুই দশকেরও বেশি অভিজ্ঞতা সম্পন্ন একজন চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট হিসেবে মোশাররফ ২০১৮ সালে আইডিআরএ-এর সদস্য হিসেবে যোগ দেন এবং ২০২০ সালে চেয়ারম্যান পদে পদোন্নতি পান। দুদক তার ও তার পরিবারের সদস্যদের সম্পদের হিসাব চাওয়ার পর তিনি ২০২২ সালের জুন মাসে পদ থেকে পদত্যাগ করেন।
এর আগে, বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) দুদককে জানায় যে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে মোশাররফ, তার পরিবারের সদস্য এবং সংশ্লিষ্ট কোম্পানিগুলোর ব্যাংক অ্যাকাউন্টগুলোতে প্রায় ৪২ কোটি টাকা জমা হয়েছিল।