রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ০১:৫৬ অপরাহ্ন
আশুলিয়ায় বৃদ্ধি পেয়েছে সিচরে চোরদের উপদ্রুপ। সরকারি বেসরকারি মূল্যবান লৌহজাত যন্ত্রাংশসহ বাসাবাড়ির জিনিসপত্র চুরির ঘটনার পেছনে ভাঙ্গারি ব্যবসায়িদের বিরুদ্ধে এই অভিযোগ উঠেছে।
গত কয়েক মাস ধরে আশুলিয়ার বিভিন্ন এলাকায় গ্যাস লাইনের রাইজার, বাসাবাড়ির নলকূপের মাথা, বিদ্যুৎ অফিসের তার ও আঁধাপাকা বাড়ির সিধ কেটে ফ্যানসহ মূল্যবান জিনিসপত্র চুরি হওয়ার মত ঘটনা নিত্য ঘটছে। একই সাথে নির্মাণাধীন ভবনের দরজা, জানালা ও রডসহ বিভিন্ন উপকরণ চুরি হওয়ায় প্রতিনিয়ত বিরম্বনার শিকার হচ্ছেন এলাকাবাসী। এদিকে আশুলিয়ার নবীনগর-চন্দ্রা ও টঙ্গী-আশুলিয়া-ইপিজেড সড়কের উভয় পাশে ব্যাঙ্গের ছাতার মত বৃদ্ধি পেয়েছে ভাঙ্গারি ব্যবসায়িদের রমরমা বাণিজ্য।
সরেজমিনে আশুলিয়ার বাইপাইল, বগাবাড়ি, ইউনিক, জামগড়া, জিরাবো, ভাদাইল, ডেন্ডাবর, পলাশবাড়ী, কাঁইচাবাড়ি, নিরিবিলি, শ্রীপুর, জিরানিসহ প্রায় অর্ধশত এলাকায় যত্রতত্র গড়ে উঠেছে ভাঙ্গারি পট্টি। যেখানে গিয়ে দেখা গেছে সড়কের পাশে বিশাল আকৃতির গোডাউন নিয়ে পুরাতন মালামালসহ নানা ধরণের লৌহজাত সামগ্রী মজুদ রাখা হয়েছে। যেখানে রয়েছে সরকারি মালামাল সহ নানা উপকরণ। যা খোলা বাজারে বিক্রি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। এছাড়াও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে ছোট ছোট শিশুদেরকেও স্বল্প মূল্যে এসব ভাঙ্গারি ব্যবসায়িরা অমানবিক পরিশ্রম করাচ্ছে। সেই সাথে তাদেরকে লোভনীয় প্রস্তাবের মাধ্যমে অনেক মূল্যবান জিনিসপত্র চুরির সুযোগ করে দিচ্ছে এই সমস্ত ব্যবসায়িরা।
জানা যায়, বাইপাইল, ইউনিক ও জামগড়া এলাকার ভাঙ্গারি দোকান গুলোতে পথশিশুদের দিয়ে টোকাইয়ের কাজ করানো হয়। আর এই টোকাইরাই সুযোগ বুঝে বিভিন্ন বাসাবাড়ি ও প্রতিষ্ঠানে চুরির ঘটনা ঘটাচ্ছে। আর সেখান থেকে চুরিকৃত মালামাল এসব ভাঙ্গারি দোকানে তারা বিক্রি করছে। এসময় ভাঙ্গারি দোকানে গিয়ে দেখা গেছে, নির্মাণাধীন ভবনে ব্যবহৃত নতুন উপকরণও সেখানে মিলছে। এছাড়াও সড়কের পাশে যত্রতত্র লোহা জাতীয় জিনিসপত্র ফেলে রাখায় প্রতিনিয়ত যানজটের সৃষ্টি হচ্ছে। এমনকি পথচারীরাও বিভিন্ন সময় আহত হচ্ছে।
এবিষয়ে ভুক্তভোগী এলাকাবাসী জানায়, ডেন্ডাবর এলাকার মোহাম্মদ আলী ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কসপের কর্ণধার মোহাম্মদ আলী জানান, বিগত বিশ বছর যাবৎ তিনি এই এলাকায় লেদ সংক্রান্ত সকল লৌহজাত মেশিনারীজ প্রস্তুত করে আসছেন।
ইদানিং সিচড়ে চোরদের উপদ্রুপ বেড়ে যাওয়ায় দিনের বেলাতেই তার ব্যবয়াকি প্রতিষ্ঠানের ভিতর থেকে মূল্যবান ছোট লৌহজাত জিনিস চুরি যাচ্ছিলো। পরবর্তীতে এক পথশিশুকে হাতেনাতে আটকের পর জানা যায় সে কোন এক ভাঙ্গারি দোকানের কর্মচারী। আর তাকে দিয়ে ভাঙ্গারি দোকান মালিক দীর্ঘ দিন যাবৎ বিভিন্ন বাসা বাড়ি ও দোকান থেকে লোহজাত জিনিস চুরি করাচ্ছে।
এদিকে কাঁঠালবাগানের বাসা মালিক আতিক হোসেন, পলাশবাড়ির আতাউর রহমান, কাঁইচাবাড়ীর আবু তাহের ও কাঁঠগড়ার ফারুক হোসেন জানান, তাদের বসত বাড়ির ব্যবহৃত টিউবওয়েলের মাথা মাঝে মধ্যেই চুরি যাওয়ার ঘটনা ঘটছে। উপায়ন্তু না পেয়ে রাতের বেলায় তারা টিউবওয়েলের মাথায় লোহার চেইন পেঁচিয়ে তালাবদ্ধ করে রাখলেও তা চোরদের হাত থেকে রক্ষা করা যাচ্ছে না।
বাইপাইল এলাকার রমজান আলী জানান, পানি উত্তোলনের জন্য তার শ্রমিক পল্লীর একটি মোটর গত মাসে খোয়া যায়। পরে খোঁজ নিয়ে ইউনিক এলাকার একটি ভাঙ্গারি দোকানে তার মটরটির সন্ধান পান। পরে ভাঙ্গারি দোকান থেকে উচিত মূল্যের অর্ধেক দামে তিনি ঐ মটরটি ক্রয় করেন।
তবে ইউনিক, জমাগড়া, বগাবাড়ি ও শ্রীপুর এলাকার একাধিক ভাঙ্গারি দোকানদাররা এসব অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, অযথায় প্রশাসনের যোগসাজস ও স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তিরা তাদের মিথ্যে চুরির অপবাদ দিয়ে তাদের লাঞ্চিত করে। একই সাথে মোটা অঙ্কের টাকাও হাতিয়ে নেয় ঐ প্রশাসনের লোকজন ও প্রভাবশালীরা।
বগাবাড়ি বাজার এলাকার ভাঙ্গারি ব্যবসায়ি মান্নান জানান, এই ব্যবসার মধ্যে দিয়ে তারা একদিকে যেমন নষ্ট ও বাতিল মালামাল সংগ্রহ করে যা পুনরায় ব্যবহার উপযোগী করে তোলেন। তেমনি প্রান্তিক পর্যায়ের অসহায় বেকারদেরও কর্মের ব্যবস্থা করেন তারা। তাদের ব্যবসায় লৌহজাত জিনিসপত্র বেশি থাকায় এখানে কাঁচা টাকার প্রতি প্রলুব্ধ হয়ে বিভিন্ন অনৈতিক কর্মকা- ঘটে থাকে। তবে তিনি ট্রেড লাইলেন্স ও সরকারকে শুল্ক প্রদানের মাধ্যমে হালাল ভাবে ব্যবসা করছেন দাবি করলেও তিন বছর পূর্বের পুরাতন টিন সার্টিফিকেট দেন। যা নবায়ন করা হয়নি। এই ভাঙ্গারি দোকানেও মিলেছে বেশ কিছু রাইজার ও বিদ্যুতের কাজে ব্যবহৃত তারসহ বিভিন্ন সরকারি সরঞ্জামাদি।
তবে একাধিক ভাঙ্গারি দোকান থেকে পুলিশকে মাসোহারা দেওয়ার বিষয়টি উঠে আসলে তা প্রমাণসহ বক্তব্য প্রদান করতে চায়নি কেউই। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অনেকেই জানান, আশুলিয়ার বিভিন্ন এলাকায় প্রায় তিন’শ ভাঙ্গারি দোকান প্রতি গড়ে তিন হাজার টাকা করে চাঁদা উত্তোলন করে ভাঙ্গারি সমিতির লোকজন।
তবে এব্যাপারে আশুলিয়া থানা পুলিশের অফিসার ইনচার্য আব্দুল আউয়াল ভাঙ্গারি দোকান থেকে পুলিশ কতৃক চাঁদা উত্তোলনের বিষয়টি পুরোপুরি মিথ্যা বলে জানান।
এব্যাপারে ঢাকা জেলা উত্তর গোয়েন্দা পুলিশের অফিসার ইনচার্য এফএম সায়েদ জানান, ভাঙ্গারি দোকান থেকে যদি ডিবি পুলিশের কোন সদস্যের বিরুদ্ধে চাঁদা উত্তোলনের প্রমাণ মেলে তবে তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
ফুটপাত ব্যবহারের বিষয়টি নিয়ে মানিকগঞ্জ সড়ক ও জনপদ বিভাগের নয়ারহাট জোনের প্রকৌশলী আতিকুল্লাহ আতিক জানান, ফুটপাত গুলো মুক্ত রাখতে তিন মাস অন্তর তারা অভিযান পরিচালনা করে আসছেন। এসময় বিভিন্ন অবৈধ স্থাপনা ভেঙ্গে দিলেও পরবর্তীতে স্থানীয় প্রশাসন ও রাজনৈতিক নেতাদের ছত্রছায়ায় পুনরায় স্থাপনা নির্মাণ করছে।
এব্যাপারে ডেন্ডাবর এলাকার বাসিন্দা বিশিষ্ট সমাজসেবক, পরিবেশবিদ ও সাভার উপজেলা দূর্নীতি দমন কমিশনের অন্যতম সদস্য রহিম উদ্দিন জানান, গত মাস ধরে ভাঙ্গারি দোকান গুলোতে শিশু শ্রম ও মাদকের আড্ডাস্থলে পরিণত হয়েছে। ফলে ব্যক্তিগত গাড়ির লুকিং গ্লাস মূল্যবান জিনিসপত্র চুরি করে নিয়ে যাচ্ছে টোকাইরা। আর এসব জিনিস পাওয়া যাচ্ছে বিভিন্ন ভাঙ্গারি দোকান গুলোতে। অধিক মূল্যবান জিনিস কম টাকায় কিনতে পারা সেই সাথে মাদকসেবীদের অর্থেও যোগান পাওয়া ও শিশুরা অধিক টাকা আয়ের লোভ সামলাতে না পারায় এধরনের অপরাধ বাড়ছে বলেও জানান তিনি।
তবে এলাকাবাসীর দাবী যে কোন মূল্যেই হোক তারা নিরাপদে ঘুমাতে চায় ও তাদের মূল্যবান জিনিসপত্রের নিরাপত্ত নিশ্চিত করতে চায়। কিন্তু এসব অভিযোগ স্থানীয় থানায় নিয়ে গেলেও তা অভিযোগ লেখা পর্যন্তই সীমাবদ্ধ।
আশুলিয়া থেকে শাহ্ আলম: