নিজস্ব প্রতিবেদক:
রাজশাহীর মিষ্টির জগতে এক অনন্য নাম—‘হোবা ঘোষের রসগোল্লা’। অবাক করার মতো হলেও সত্যি, এই প্রতিষ্ঠানের নেই কোনো সাইনবোর্ড, এমনকি নির্দিষ্ট কোনো দোকানঘরও নেই। শুধুমাত্র মিষ্টির প্যাকেটে লেখা থাকে—‘হোবা ঘোষের রসগোল্লা’ এবং দুটি ফোন নম্বর। তাতেই রাজশাহীজুড়ে একনামে পরিচিত এই মিষ্টির দোকান। প্রায় ৯০ বছরের ঐতিহ্য বহন করা এই রসগোল্লার হাল ধরে আছেন ৮০ বছর বয়সী হোবা ঘোষ, যিনি টানা ৬৬ বছর ধরে মিষ্টি তৈরি করছেন।
রাজশাহী সাবরেজিস্ট্রি অফিসের পাশেই বসেন হোবা ঘোষ। মূলত দলিল সম্পাদনের কাজে আসা মানুষই তাঁর প্রধান ক্রেতা। স্থানীয়দের মতে, দলিল সম্পাদনের পর বিক্রেতার হাতে হোবা ঘোষের মিষ্টির প্যাকেট তুলে দেওয়া যেন এক অলিখিত নিয়ম। বিক্রেতাদের যত বেশি ওয়ারিশ থাকে, তত বেশি মিষ্টি বিক্রি হয়।
হোবা ঘোষের বাড়ি রাজশাহী নগরের বুলনপুর ঘোষপাড়ায়। তাঁর দাদু উমাচরণ ঘোষ ১৯৩৭ সালে এই ব্যবসা শুরু করেন। সেই থেকে প্রজন্ম ধরে চলছে এই ঐতিহ্য। বর্তমানে হোবা ঘোষের দুই ছেলে—বিমল কুমার ঘোষ ও অমল কুমার ঘোষও বাবার সঙ্গে এই ব্যবসা সামলাচ্ছেন। মজার ব্যাপার হলো, রাজশাহী আদালত চত্বরে যত মিষ্টির দোকান রয়েছে, তার বেশিরভাগই এই পরিবারের লোকদের।
হোবা ঘোষের কাছে রাজশাহীর মিষ্টি ব্যবসার ইতিহাসও চমকপ্রদ। তাঁর ভাষ্যে, ওডিশার ব্যবসায়ীরাই প্রথম রাজশাহীতে মিষ্টির দোকান চালু করেছিলেন। তাঁদের মধ্যে নিত্যানন্দ ঠাকুরের ‘জোড়কালি মিষ্টান্নভান্ডার’ ছিল প্রথম, যা বর্তমানে তাঁর নাতি শ্রীকান্ত বর্মণ পরিচালনা করছেন।
হোবা ঘোষ জানালেন, তিনি পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেছেন। বাবার ৪০-৫০টি গরু দেখাশোনার কারণে আর পড়াশোনা এগোয়নি। একসময় রাজশাহীর চিড়িয়াখানা যেখানে, সেটি ছিল ঘোড়দৌড়ের মাঠ, যেখানে তাঁদের গরু চরত। তখন নিজের গরুর দুধ থেকেই ছানা তৈরি হতো। এখন বাইরের খামারিদের কাছ থেকে ছানা কিনতে হয়। তবে তিনি ছানার মান নিয়ে কোনো আপস করেন না। তাঁর কথায়, ‘এক নম্বর ছানা ছাড়া মিষ্টি হয় না।’ এ কারণেই তাঁর রসগোল্লার স্বাদ অনন্য।
একসময় যখন রাজশাহীতে মাত্র একটি সাবরেজিস্ট্রি অফিস ছিল, তখন হোবা ঘোষের দোকানে সারাদিন মিষ্টি তৈরি ও বিক্রি হতো। এখন প্রতিটি উপজেলায় সাবরেজিস্ট্রি অফিস হওয়ায় বিক্রি কিছুটা কমেছে। বর্তমানে তিনি প্রতিদিন প্রায় মণখানেক মিষ্টি বিক্রি করেন। প্রতি কেজি রসগোল্লার দাম ২৪০ টাকা।
রাজশাহীর সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের সঙ্গে মিশে গেছে হোবা ঘোষের রসগোল্লা। শহরের বাচিকশিল্পী শরীফ আহমেদ জানান, কলেজজীবনে তাঁরা শুধু এই রসগোল্লা খেতেই কোর্ট এলাকায় যেতেন। এখনো কোর্টে কোনো কাজে গেলে তিনি এই মিষ্টি খাওয়ার চেষ্টা করেন।
প্রায় এক শতকের কাছাকাছি সময় ধরে মানুষকে স্বাদের আনন্দ দিয়ে আসছে হোবা ঘোষের রসগোল্লা। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে মুখে হাসি ফোটানো এই ঐতিহ্য রাজশাহীর মিষ্টির ইতিহাসে এক অনন্য অধ্যায় হয়ে থাকবে।