বাংলাদেশের শেয়ারবাজারে বিনিয়োগকারীদের টার্গেট করে একটি ভয়াবহ প্রতারণা চক্র সক্রিয় রয়েছে। স্বাধীন ফ্যাক্ট-চেকিং প্ল্যাটফর্ম ডিসমিসল্যাবের অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস (এমএফএস) ব্যবহার করে সংঘটিত এই প্রতারণা ইতিমধ্যে কয়েক হাজার বিনিয়োগকারীকে ফাঁদে ফেলেছে। মাসব্যাপী অনুসন্ধানে দেখা যায়, অত্যন্ত সাধারণ কিন্তু কার্যকর কৌশল ব্যবহার করে প্রতারকরা প্রায় তিন হাজার বিনিয়োগকারীর কাছ থেকে অর্থ হাতিয়ে নিয়েছে।
প্রতারকরা প্রথমে ফেসবুক ও ইনস্টাগ্রামের মতো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দ্রুত ও নিশ্চিত লাভজনক বিনিয়োগের লোভনীয় বিজ্ঞাপন ছড়িয়ে দেয়। এসব বিজ্ঞাপন সাধারণ বিনিয়োগকারীদের সহজেই আকৃষ্ট করে। এরপর আগ্রহী ব্যক্তিদের বিশেষ হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত করা হয়। সেখানে প্রতারকরা নিজেদের শেয়ারবাজারের তথাকথিত বিশেষজ্ঞ পরিচয়ে আস্থা অর্জনের চেষ্টা করে এবং মনগড়া তথ্য ও বিশ্লেষণ দেখিয়ে বোঝাতে থাকে যে তাদের নির্দেশনা মেনে বিনিয়োগ করলেই দ্রুত লাভ সম্ভব।
পরবর্তী ধাপে বিনিয়োগকারীদের নকল ওয়েবসাইটে নিবন্ধন করতে বলা হয়। একইসঙ্গে বিকাশ বা নগদের মতো এমএফএস প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে অর্থ জমা দেওয়ার চাপ সৃষ্টি করা হয়। তবে আসল ব্রোকারেজ অ্যাকাউন্টের বদলে এই অর্থ জমা দেওয়া হয় ব্যক্তিগত এমএফএস বা ব্যাংক অ্যাকাউন্টে, যার মাধ্যমে প্রতারকরা সহজেই টাকা আত্মসাৎ করে।
ডিসমিসল্যাবের অনুসন্ধানে আরও দেখা গেছে, দেশের স্বনামধন্য ব্রোকারেজ প্রতিষ্ঠান সিটি ব্রোকারেজ লিমিটেড ও ব্র্যাক ইপিএল স্টক ব্রোকারেজ-এর নাম ব্যবহার করে অন্তত ২০টি প্রতারণামূলক হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ পরিচালিত হচ্ছে। এসব গ্রুপে মোট সদস্য সংখ্যা তিন হাজারের বেশি। শুধু সেপ্টেম্বর মাসেই অন্তত ১৫টি ফেসবুক পেজ থেকে শত শত বিজ্ঞাপন চালিয়ে নতুন সদস্য সংগ্রহ করা হয়েছে। প্রতারকরা নকল অ্যাপ এবং ওয়েবসাইট ব্যবহার করছে, যেগুলো দেখতে হুবহু আসল ট্রেডিং প্ল্যাটফর্মের মতো। এমনকি বিশ্বব্যাংকের সাবেক অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন-এর নাম ও ছবি ব্যবহার করেও বিশ্বাসযোগ্যতা বাড়ানোর চেষ্টা করা হয়েছে।
প্রতারণার ঘটনা জানাজানি হওয়ার পর ব্রোকারেজ প্রতিষ্ঠানগুলো বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) ও অপরাধ তদন্ত বিভাগকে (সিআইডি) অবহিত করেছে। এর আগে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) এবং বিএসইসি একই ধরনের ভুয়া চক্র নিয়ে সতর্কবার্তা জারি করেছিল। ডিএসই জানিয়েছিল, প্রতারকরা তাদের নাম, লোগো এবং অফিসিয়াল ঠিকানা পর্যন্ত ব্যবহার করছে বিনিয়োগকারীদের বিভ্রান্ত করতে।
বিএসইসি আবারও বিনিয়োগকারীদের সতর্ক করে জানিয়েছে, অনুমোদন ছাড়া শেয়ারবাজারসংক্রান্ত গবেষণা বা পরামর্শ প্রকাশ করা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (রিসার্চ অ্যানালিস্ট) রুলস, ২০১৩ অনুযায়ী বেআইনি এবং এটি গুরুতর অপরাধ। বিনিয়োগকারীদের অনুরোধ করা হয়েছে যেকোনো লোভনীয় বিজ্ঞাপনে প্রলুব্ধ না হতে, অচেনা গ্রুপে যুক্ত হওয়ার আগে যাচাই-বাছাই করতে এবং বিনিয়োগের আগে ব্রোকারেজ হাউসের অফিসিয়াল ওয়েবসাইট ও বিএসইসির অনুমোদিত তালিকা পরীক্ষা করতে। এছাড়া ব্যক্তিগত এমএফএস বা ব্যাংক অ্যাকাউন্টে কখনো অর্থ লেনদেন না করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। কোনো সন্দেহজনক ঘটনা দেখা দিলে তাৎক্ষণিকভাবে বিএসইসি বা আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে অবহিত করার আহ্বান জানানো হয়েছে।