বীমা কর্মকর্তা মো. আলাউদ্দিন মিয়ার বিরুদ্ধে এবার হাসপাতাল লুটেপুটে খাওয়ার অভিযোগ উঠেছে। তার বিরুদ্ধে বীমা সেক্টরেও ব্যাপক অনিয়ম, দুর্নীতি, জালিয়াতি ও অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ রয়েছে দীর্ঘদিন ধরে। তিনি কুমিল্লার নাঙ্গলকোট ডায়াবেটিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক থাকাকালীন সময়ে সমিতির নামে সরকারি অনুদান ও প্রতিষ্ঠানের তহবিল থেকে কোটি টাকারও বেশি অর্থ আত্মসাত করেন। জালিয়াতি ও লোপাটসহ নানান অভিযোগ তদন্ত প্রতিবেদনেও উঠে আসলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করা হয় তার বিরুদ্ধে।
২০২৩ সালের ৬ সেপ্টেম্বর সমিতির নির্বাহী পরিষদের ২৭তম সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। তদন্ত কমিটির সদস্য নাসরিন আক্তার মুন্নী, খন্দকার আবুল বাসার ও মো. সাহাবউদ্দীন এক যৌথ প্রতিবেদনে অভিযোগের বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরেন।
তদন্তে উঠে আসে, ২০২০ সালে সমিতির কমিউনিটি-ভিত্তিক ডায়াবেটিক হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার সময় মেশিনারিজ ও আসবাবপত্র ক্রয়ের ক্ষেত্রে বাজারদর অপেক্ষা কমপক্ষে ৩ লাখ টাকা বেশি দেখিয়ে আলাউদ্দিন মিয়া ১২ লাখ ৬০ হাজার টাকার কেনাকাটায় কারসাজি করেন।
পরবর্তীতে ২০২১-২২ অর্থবছরে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয় থেকে কুমিল্লা জেলা পরিষদের মাধ্যমে ৫০ লাখ টাকার সরকারি অনুদান আসে। ওই অর্থে একটি ৫০০ এমই ডিজিটাল এক্স-রে মেশিন, একটি সি-আর মেশিন, একটি ১ টন এসি এবং একটি জেনারেটর সরবরাহের কথা ছিল। জেলা পরিষদ দরপত্র আহ্বান করে ঠিকাদার মেসার্স তৃষান এন্টারপ্রাইজকে কার্যাদেশ দেয়। কিন্তু আলাউদ্দিন মিয়া ঠিকাদারের সঙ্গে সমঝোতা করে ৩২ লাখ ৫০ হাজার টাকার চেক তার পরিচিত প্রতিষ্ঠান মেডিসায়েন্স লিমিটেডের নামে নেন।
তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, ওই অর্থে যেসব যন্ত্রপাতি আনা হয়, তার মধ্যে এক্স-রে মেশিনটি শুরু থেকেই নষ্ট ছিল। পরে মেরামতের অজুহাতে আলাউদ্দিন মিয়া এক্স-রে ও সি-আর মেশিন দু’টি ঢাকায় নিয়ে যান, কিন্তু একটি মেশিন আর ফেরত দেননি। এর মূল্য প্রায় ৩১ লাখ ৫০ হাজার টাকা। এ ছাড়াও মেশিনের বাড়তি খরচ দেখিয়ে তিনি আরও ৮ লাখ ৬২ হাজার ৮৩০ টাকা এবং এক্স-রে ফিল্ম বাবদ ৯০ হাজার টাকা নেন।
এছাড়া ২০২০ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বেতন, ঈদ বোনাস ও যাতায়াত ভাতা বাবদ প্রায় ১০ লাখ ১৭ হাজার ৫০০ টাকা তিনি প্রতিষ্ঠানের তহবিল থেকে গ্রহণ করেন—যদিও তার নিয়োগপত্রে স্পষ্টভাবে উল্লেখ ছিল যে তিনি কোনো প্রকার বেতন বা ভাতা নেবেন না।
সব মিলিয়ে আলাউদ্দিন মিয়ার বিরুদ্ধে প্রায় ৫৪ লাখ ২০ হাজার টাকার অবৈধ অর্থ গ্রহণ ও আত্মসাতের প্রমাণ পেয়েছে তদন্ত কমিটি। প্রতিবেদনে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, তিনি দায়িত্বে থেকে আর্থিক শৃঙ্খলা ভঙ্গ ও প্রতিষ্ঠানের অর্থ লোপাট করেছেন।
তদন্ত কমিটি অবিলম্বে প্রশাসনিক ও আইনগত ব্যবস্থা নিয়ে আত্মসাৎকৃত অর্থ আদায়ের সুপারিশ করেছে। সমিতির নির্বাহী পরিষদও এই প্রতিবেদনের ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় আইনি পদক্ষেপ নেওয়ার বিষয়ে গুরুত্ব দিচ্ছে বলে জানা গেছে।স্থানীয় পর্যায়ে বিষয়টি আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। সরকারি অনুদানের অর্থ ব্যবহারে এমন অনিয়ম ও আত্মসাতের ঘটনায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন সাধারণ সদস্যরাও। নাঙ্গলকোট ডায়াবেটিক সমিতির তদন্ত কমিটিও লিখিত প্রতিবেদনে একই ধরনের সুপারিশ করেছে। তাদের মতে, আলাউদ্দিন মিয়া দায়িত্বে থেকে সংস্থার আর্থিক শৃঙ্খলা ভঙ্গ করে পদ্ধতিগতভাবে কোটি টাকা লোপাট করেছেন।
সংশ্লিষ্টরা জানান, হাসপাতাল জনগণের সেবার জন্য প্রতিষ্ঠা হলেও এখন এটাকে আলাউদ্দিন ‘ব্যক্তিগত বিশেষ সেবার কারখানা’ বানিয়েছেন। এখানে তিনি যন্ত্রপাতি ক্রয় হতে শুরু করে প্রতিটি পদে পদে অনিয়ম ও দুর্নীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। এসব বিষয় নিয়ে এখন বড় ধরনের সমস্যা মোকাবেলা করতে হচ্ছে প্রতিষ্ঠানকে।
বিক্ষুব্দ এলাকাবাসী জানান, হাসপাতাল খেকো আলাউদ্দিন অবৈধ প্রভাব বিস্তারের নেশায় মেতে উঠেছেন। আগে তিনি আওয়ামী ছত্রছায়ায় হাসপাতাল দখল, লুটপাট এবং নানান অপরাধে জড়িয়ে পড়েন। লীগের পতন হলে কিছুদিন গা ঢাকা দিয়ে থাকেন। পরে আইনশৃংখলা বাহিনীর নিস্ক্রিয়তায় আবার তিনি প্রকাশ্যে আসতে শুরু করেন, এলাকায় বিএনপির ছত্রছায়ায় শুরু করেন ধান্দাবাজী। এখন পুরো হাসপাতাল গিলে খাওয়ার চেষ্টা করছেন। আলাউদ্দীনের বিরুদ্ধে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ, স্টাফ হতে শুরু করে এলাকাবাসী পর্যন্ত সবাই ক্ষুব্ধ। অর্থ লোপাট, পরিচালনা পর্ষদ সদস্য পদ বিক্রি- এসব বিষয় এখন আলোচনা হচ্ছে। যে কোন সময় এই ক্ষোভ থেকে অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটতে পারে। এজন্য দ্রুত প্রশাসনের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন এলাকাবাসী।
এসব ব্যাপারে তার বক্তব্য জানতে চাইলে আলাউদ্দিন মিয়া সকল অভিযোগ অস্বীকার করে এসবকে ষড়যন্ত্র হিসেবে আখ্যায়িত করে। বরং তিনি এখনো নাঙ্গলকোট ডায়াবেটিক সমিতির দায়িত্ব পালন করছে বলেও দাবী করেন। সবশেষ তিনি এসব ষড়যন্ত্রকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণেরও হুশিয়ারী দেন।
এছাড়াও আলাউদ্দিন মিয়া বিভিন্ন বীমা প্রতিষ্ঠানে দায়িত্ব পালনকালে বারবার আর্থিক কেলেঙ্কারিতে জড়িয়েছেন বলে বিভিন্ন তথ্য-প্রমাণ পাওয়া গেছে। বর্তমানে তিনি যে কোম্পানীতে রয়েছে সেখানেও অনিয়ম চালিয়ে যাচ্ছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।
কোম্পানির অভ্যন্তরীণ অডিট রিপোর্টে তার বিরুদ্ধে অতিরিক্ত কমিশন গ্রহণ, কর্মীদের বেতন, ট্যুর বিল, টিএ/ডিএ বিল, আসবাবপত্র বাবদ অর্থ লোপাটসহ একাধিক দুর্নীতির প্রমাণ পাওয়া গেছে।
ইন্স্যুরেন্সে চাকরিরত অবস্থায়ও প্রতারণা, জালিয়াতি এবং বীমা আইন লঙ্ঘনের অভিযোগ, অর্থ আত্মসাতের দায়ে মামলা, প্রিমিয়ামের টাকা জমা না দিয়ে আত্মসাৎসহ নানা দুর্নীতির সংবাদ নিয়ে ৩ পর্বের ধারাবাহিক নিউজের আজ ছিল ১ম পর্ব….
চলবে…