শুক্রবার, ৩১ অক্টোবর ২০২৫, ১২:০০ অপরাহ্ন

চিহ্নিত প্রতারকরা আবারো হোমল্যান্ডে

তুহিন ভূঁইয়া:
  • আপডেট টাইম : সোমবার, ২৭ অক্টোবর, ২০২৫
  • ৫৭

সপ্তাহের ব্যবধানে চিহ্নিত প্রতারক শাহাদাত ও জাকির আবারো ফিরলো হোমল্যান্ডে।  তদন্ত বিলম্বে হবে তাই ঊর্ধ্বতন দুই কর্মকর্তার বাধ্যতামূলক ছুটি প্রত্যাহার করেছেন হোমল্যান্ড লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির অন্তর্বর্তীকালীন বোর্ডের চেয়ারম্যান মো. আবদুল মজিদ। ওই দুই কর্মকর্তা হলেন কোম্পানির অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও ভারপ্রাপ্ত মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা শাহাদাত হোসেন এবং উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও হেড অব মার্কেটিং জাকির হোসেন। অভিযোগ উঠেছে যে, যাদের দুর্নীতি নিয়ে তদন্ত করা হবে সেই চিহ্নিত প্রতারকদের আবার কেনো দায়িত্ব দিলো তা নিয়ে। এখানে কোনো গভীর ষড়যন্ত্র রয়েছে বলেও আশঙ্কা খাত সংশ্লিষ্টদের।

হোমল্যান্ড লাইফ ইন্স্যুরেন্সের এই দুই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে কোম্পানিটির বিগত সময়ের প্রশাসনিক ও আর্থিক অনিয়ম তদন্তের উদ্যোগ নিয়েছে উচ্চ আদালতের গঠন করে দেয়া প্রতিষ্ঠানটির অন্তর্বর্তীকালীন বোর্ড। এই তদন্ত কার্যক্রম নিরপেক্ষ এবং সুষ্ঠুভাবে সম্পাদনের স্বার্থে গত ১৮ অক্টোবর তাদের বাধ্যতামূলক ছুটিতে পাঠানো হয়।

তবে এই সিদ্ধান্তের ৭ দিনের মাথায় গত ২৫ অক্টোবর তাদের বাধ্যতামূলক ছুটি প্রত্যাহার করে নেন বীমা কোম্পানিটির অন্তর্বর্তীকালীন পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান মো. আব্দুল মজিদ।

চিঠিতে তিনি উল্লেখ করেন, অন্তর্বর্তীকালীন পরিচালনা পর্ষদের ৭ম সভায় আপনাদের প্রেরিত গত ২৩ অক্টোবরের আবেদন পত্রটি পর্যালোচনার পর বিগত সময়ের প্রশাসনিক ও আর্থিক কার্যক্রম তদন্ত বিলম্বে হওয়ার কারণে আপাতত আপনাদের উপর আরোপিত বাধ্যতামূলক ছুটি প্রত্যাহার করা হলো। পৃথক চিঠিতে ওই দুই কর্মকর্তাকে এই সিদ্ধান্তের বিষয় অবহিত করা হয়।

বাধ্যতামূলক ছুটিতে পাঠানো দুই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে যতো অভিযোগ:

হোমল্যান্ড লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক শাহাদাত হোসেন। একইসঙ্গে তিনি কোম্পানিটির মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তারও দায়িত্ব পালন করছেন। শাহাদাত হোসেনকে প্রথমে কোম্পানির উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদে নিয়োগ দেয়া হয় ২০২৪ সালের জুলাই মাসের ৭ তারিখে। এর ৩ মাস পরেই (৭ অক্টোবর, ২০২৪) তাকে চাকরি থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়।

চাকরির অব্যাহতি পত্রে উল্লেখ করা হয়, ১ কোটি ৬২ লাখ ৪৭ হাজার ৯০১ টাকার বীমা প্রিমিয়াম বকেয়া রাখা, কোন উন্নয়ন কর্মকর্তা নিয়োগ দিতে না পারা, কোম্পানির বিভিন্ন তথ্য পাচার, নৈতিক স্খলনজনিত কারণে তাকে চাকরি থেকে অব্যাহতি দেয়া হল।

আবার চাকরি থেকে শাহাদাত হোসেনকে অব্যাহতি দেয়ার ৩ মাস পরেই ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ সালে পদোন্নতি দিয়ে কোম্পানির অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদে নিয়োগ দিয়ে মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তারও দায়িত্ব দেন কোম্পানির তৎকালীন চেয়ারম্যান জামাল উদ্দিন। পরিচালনা পর্ষদের অনুমোদন ছাড়াই চেয়ারম্যান জামাল উদ্দিন একক সিদ্ধান্তে এ নিয়োগ দেন।

শাহাদাত হোসেন দায়িত্ব নেয়ার পর কোম্পানির চেয়ারম্যান জামাল উদ্দিন নিয়ম বহির্ভুতভাবে ৩৯ লাখ ৭০ হাজার টাকা নেন কোম্পানি থেকে। এই টাকা তিনি নেন আইও শ্লিপ দিয়ে। এসব টাকা উত্তোলনের নোটশিটে স্বাক্ষর করে শাহাদাত হোসেন। এর মধ্যে ৫ লাখ ৯০ হাজার টাকা তিনি নিজেই আইও শ্লিপে স্বাক্ষর দিয়ে গ্রহণ করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

নথিপত্রে দেখা যায়, ২০২৫ সালের ৩০ এপ্রিল থেকে ১৮ মে পর্যন্ত সময়কালে শাহাদাত হোসেন দায়িত্বে থাকাকালীন কোম্পানির তহবিল থেকে ৩৯ লাখ ৭০ হাজার টাকা আত্মসাৎ করা হয়। এর মধ্যে জামাল উদ্দিন নেন ২২ লাখ ৮০ হাজার টাকা, শাহাদাত হোসেন ৫ লাখ ৯০ হাজার টাকা, কামরুল আহসান ৩ লাখ টাকা এবং কাজী শহিদুল ইসলাম ৫ লাখ টাকা। এই অর্থ আত্মসাতের জন্য ব্যবহৃত প্রতিটি আইওইউ স্লিপে শাহাদাত হোসেনের স্বাক্ষর রয়েছে।

পরবর্তীতে থানায় একাধীক জিডি ও মামলাও করা হয় তার বিরুদ্ধে। উল্লেখ্য ২০১২ সালে গোল্ডেন লাইফে চাকুরীরত অবস্থায় পিআর জালিয়াতি, অর্থ আত্মসাৎসহ বিভিন্ন অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে ধোলাইয়ের শিকার হয়েছিল এই শাহাদাত। গোল্ডেন লাইফে হামলা-মামলা আর মারামারির নেপথ্য নায়ক ছিলেন শাহাদাত। অনিয়ম-দুর্নীতি ঢাকতে প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা পর্ষদের বিরুদ্ধে মামলা করেছিল এই শাহাদাত। যাতে প্রতিষ্ঠান পরে চরম ক্ষতির মুখে। এসব অপকর্মের কারণে গোল্ডেন লাইফের করা মামলায় দীর্ঘদিন জেল খাটতে হয় এই তাকে। এর আগে সন্ধানী লাইফে চাকুরীরত অবস্থায় লক্ষ্মীপুরে প্রতারণার কারণে সাধারণ গ্রাহকদের গণরোশে মার খেয়ে এলাকাছাড়া হন এই শাহাদাত। ঢাকায় এসেও ঐ প্রতিষ্ঠানে ঢুকে জালিয়াতি, অনিয়ন-দুর্নীতি আর অর্থ লোপাটের কারণে মামলা খেতে হয় তাকে। এমনকি পদ্মা লাইফে থাকাকালীন সময়েও তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগে মামলা হয়েছিল।

প্রতিষ্ঠানের আর্থিক দৈন্যদশার মধ্যেও আইডিআরএর নিয়ম ভঙ্গ করে আইও স্লিপ দিয়ে লাখ লাখ টাকা উত্তোলন করছে শাহাদাত। এখন পর্যন্ত অন্তর্বর্তীকালীন বোর্ডও এ বিষয়ে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।

সবচেয়ে ভয়াবহ তথ্য হলো—হোমল্যান্ডে যোগদানের আগে শাহাদাত যে বায়োডাটা দাখিল করেছিলেন, তা পুরোপুরি মিথ্যা ও জাল তথ্যপূর্ণ। তিনি দাবি করেন, ২০০৯ সালে আমেরিকা বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি থেকে সমাজবিজ্ঞান বিষয়ে বিবিএ (অনার্স) ডিগ্রি অর্জন করেছেন। অথচ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের রেকর্ড অনুযায়ী, ২০০৬ সালের ২২ অক্টোবর সরকার এসআরও জারি করে আমেরিকা বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি বন্ধ ঘোষণা করে। বিশ্ববিদ্যালয়টির কার্যক্রমের কোনো আইনগত ভিত্তি নেই, অনুমোদিত কোনো ক্যাম্পাস বা কর্তৃপক্ষও নেই। ফলে ২০০৯ সালের ওই ডিগ্রি পুরোপুরি ভুয়া।

এই শাহাদাতের অর্থ-আত্মসাতের পাশাপাশি রয়েছে নারী কেলেংকারীর আরেক অন্ধকার অধ্যায়। ‘ত’ আদ্যাক্ষরের এক নারীর সঙ্গে সম্পর্কের গুঞ্জন রয়েছে।

তার বায়োডাটায় আরও উল্লেখ আছে, তিনি ২০১৮ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত সোনালী লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিতে অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। কিন্তু সেই নিয়োগপত্রটিও জাল। তথাকথিত ওই নিয়োগপত্রে সোনালী লাইফের তৎকালীন সিইও অজিত চন্দ্র আইচের স্বাক্ষর থাকলেও, কোম্পানির নথি অনুযায়ী এ ধরনের কোনো নিয়োগ কখনো হয়নি।

বরং বর্তমানে শাহাদাত হোসেনকে পুনরায় গুরুত্বপূর্ণ পদে বসানোর প্রস্তুতি নিচ্ছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। “জেনারেল সার্ভিস ডিপার্টমেন্ট” নামে একটি নতুন বিভাগও খোলা হয়েছে, যেখানে শাহাদাতকে সিনিয়র পদে বসানোর পরিকল্পনা রয়েছে বলে জানা গেছে।

সব মিলিয়ে হোমল্যান্ড লাইফ এখন আদালতের নির্দেশনা, আইডিআরএর নিয়ন্ত্রণ ও প্রশাসনিক শৃঙ্খলার বাইরে এক চক্রের কবলে। আদালতের রায় কার্যকর না হওয়া, জাল ডিগ্রিধারী ও অর্থ আত্মসাতের দায়ে অভিযুক্ত এক ব্যক্তির হাতে কোম্পানির নিয়ন্ত্রণ—সবকিছুই বীমা খাতের জন্য এক ভয়াবহ দৃষ্টান্ত।

অপরদিকে কোম্পানিটির সাবেক চেয়ারম্যান জামাল উদ্দিনের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত জাকির হোসেন সরকার দায়িত্ব পালন করছেন কোম্পানিটির উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও হেড অব মার্কেটিং পদে। জাকির হোসেন সরকার নিয়োগ পান ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ তারিখে।

কোম্পানির একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, জাকির হোসেন সরকার সারাদেশের ব্রাঞ্চ ম্যানেজারদের কাছ থেকে প্রিমিয়ামের নামে প্রায় ৬০ লাখ টাকা নিয়েছেন এমন গুঞ্জন রয়েছে। তবে ব্যক্তিগত বিকাশ একাউন্ট ও নগদে টাকা নেয়ায় কোনো প্রমাণাদি দিতে পারছে না কেউ।

এছাড়াও জামাল উদ্দিনের ঘনিষ্ঠ ও কোম্পানিতে প্রভাবশালী কর্মকর্তা হিসেবে পরিচিত হওয়ার কারণে জাকির হোসেন সরকারকে যারা টাকা দিয়েছেন তারা মৌখিকভাবে অভিযোগ করলেও চাকরি হারানোর ভয়ে লিখিত কোন অভিযোগ করছেন না।

হোমল্যান্ড লাইফের মামলা সংক্রান্ত নথিপত্রের তথ্য অনুসারে, মতিঝিল থানায় জাকির হোসেন সরকারের বিরুদ্ধে দায়ের করা ১৮(১)১১নং মামলাটি উচ্চ আদালতে আদেশের অপেক্ষায় আছে। এই মামলায় তার বিরুদ্ধে হোমল্যান্ড লাইফের ৮৫ লাখ ৭১ হাজার ৫৭৩ টাকা আত্মসাতের অভিযোগ রয়েছে। আর কতোয়ালী থানার ০১(০১)১১নং মামলায় জাকির হোসেন সরকারের বিরুদ্ধে কোম্পানির ৭ লাখ ৩৬ হাজার টাকা আত্মসাতের অভিযোগ আনা হয়।

দুই কর্মকর্তার বাধ্যতামূলক ছুটি প্রত্যাহারের বিষয়ে হোমল্যান্ড লাইফ ইন্স্যুরেন্সের অন্তর্বর্তীকালীন পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান মো. আবদুল মজিদের বক্তব্য জানতে যোগাযোগ করা হলে তিনি ফোন কলটি রিসিভ করেন। তবে এই প্রতিবেদকের পরিচয় দেয়ার পর তিনি রং নাম্বার বলে ফোন কলটি কেটে দেন।

ভালো লাগলে নিউজটি শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর..
© All rights reserved © 2011-2025 VisionBangla24.Com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com