শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ১১:১৯ অপরাহ্ন
ভিশন বাংলা নিউজ: বরিশালে উৎপাদিত বোম্বাই মরিচ ঝাল আর গন্ধে অতুলনীয়। এই মরিচের একমাত্র আমদানিকারক দেশ জাপান। ২০১১ সাল থেকে জাপানে বোম্বাই মরিচ রপ্তানি করা হচ্ছে। জাপানে বোম্বাই মরিচ রপ্তানি করে প্রতিবছর বিপুল পরিমাণের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করছে বাংলাদেশ। আগামী বছর মালয়েশিয়াও যুক্ত হবে আমদানিকারক দেশের তালিকায়। প্রতিবছর বরিশালের বানারীপাড়া ও পিরোজপুরের স্বরূপকাঠি উপজেলার কুড়িয়ানার উৎপাদিত বোম্বাই মরিচ দেশে-বিদেশে বিক্রি করে শতকোটি টাকা আয় করছে কৃষক ও ব্যবসায়ীরা।
একসময়ে ঘরোয়া চাহিদা পূরণের জন্য বাড়ির আঙিনায় এবং ঘরের কোনায় বোম্বাই মরিচের দু-একটি গাছ লাগানো হতো। দেশে-বিদেশে বোম্বাই মরিচের চাহিদা থাকায় এখন বরিশালসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় বাণিজ্যিক ভিত্তিতে বোম্বাই মরিচের চাষ হচ্ছে।
পিরোজপুরের স্বরূপকাঠি উপজেলার আটঘর-কুড়িয়ানা, ঝালকাঠি সদর উপজেলার ভীমরুলী এবং বরিশাল জেলার বানারীপাড়া উপজেলার ইলুহার ও মলুহার এলাকার এমন কোনো বাড়ি পাওয়া যাবে না, যে বাড়িতে বোম্বাই মরিচের চাষ না হয়। ওই সব এলাকার কৃষিজমি, রাস্তার পাশে, বাড়ির উঠানে মরিচগাছ লাগানো যেন মানুষের নেশায় পরিণত হয়েছে। পতিত জমি ভরাট করে বড় বড় বাগান তৈরি করছে।
এ অঞ্চলের বোম্বাই মরিচের গুণ ও মান ভালো হওয়ায় প্রতিবছর তাকিউসি নামে জাপানের এক ব্যবসায়ী মরিচবাগান দেখে যান। এর পরে তিনি মরিচের চাহিদার কথা জানিয়ে যান। সেই অনুযায়ী বাংলাদেশে রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান বাংলা অ্যাগ্রো মরিচ কৃষকদের কাছ থেকে মরিচ সংগ্রহ করে। পরে তাদের ফ্যাক্টারিতে মরিচ শুকিয়ে মেশিনের মাধ্যমে গুঁড়া করে প্যাকেটজাত করে জাপানে পাঠিয়ে দেয়।
বাংলা অ্যাগ্রোর ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) কামাল হোসেন চৌধুরী বলেন, জাপানে বোম্বাই মরিচের প্রচুর চাহিদা রয়েছে। বিশেষ করে জাপানের প্রস্তুতকৃত খাবারে বোম্বাই মরিচের ব্যবহার বেশি করা হয়। এ ছাড়া দৈনন্দিন খাবারেও বোম্বাই মরিচ ব্যবহার করা হয়। বিশ্বে অন্যান্য দেশের উৎপাদিত মরিচের চেয়ে এ অঞ্চলের মরিচের ঝাল ও সুগন্ধি থাকায় এর কদর বিদেশিদের কাছে বৃদ্ধি পাচ্ছে। মালয়েশিয়ার এক আমদানিকারকের সঙ্গে কথা চলছে। ভবিষ্যতে ওই ব্যবসায়ীও বরিশাল অঞ্চলের বোম্বাই মরিচ তাঁদের দেশে নেওয়ার জন্য আগ্রহ দেখিয়েছেন।
বরিশালের কৃষি অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, দক্ষিণাঞ্চলে বরিশালের বানারীপাড়া, ঝালকাঠি সদর, পিরোজপুরের স্বরূপকাঠিতে বাণিজ্যিকভাবে বোম্বাই মরিচের চাষ হচ্ছে। এর মধ্যে স্বরূপকাঠির কুড়িয়ানায় ৩২৫ একর, ঝালকাঠি সদরের গাভা, রামচন্দ্রপুর, কীর্তিপাশা ও নবগ্রাম ইউনিয়নে ৩৭৫ একর এবং বানারীপাড়ার ইলুহার, বিশারকান্দি, উদয়কাঠি ও সৈয়দকাঠি ইউনিয়নে প্রায় ১০০ একর জমি রয়েছে। এই তিন উপজেলায় প্রায় পাঁচ হাজার মানুষ মরিচ চাষের সঙ্গে জড়িত।
স্বরূপকাঠি উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. শহিদুল্লাহ বলেন, উপজেলার আটঘর-কুড়িয়ানা ইউনিয়নের ১৬টি এবং পার্শ্ববর্তী উপজেলা বানারীপাড়ার ইলুহার ইউনিয়নের মলুহারসহ সাতটি গ্রামে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে বোম্বাই মরিচের চাষ হচ্ছে। প্রতি একর বাগানে চার থেকে সাড়ে চার হাজার মরিচের চারা লাগানো হয়। প্রতিটি চারায় মৌসুমে দেড় শ থেকে দুই শ মরিচ পাওয়া যায়। প্রতি পিস মরিচ কৃষকরা ৩০ থেকে ৫০ পয়সা দামে বিক্রি করে। ফলন ভালো হলে বছরে এক একর জমি থেকে প্রায় দেড় লাখ থেকে দুই লাখ টাকা আয় হয়। তিনি জানান, এ অঞ্চলে উৎপাদিত বোম্বাই মরিচ তিন বছর ধরে জাপানে রপ্তানি করা হচ্ছে।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, বানারীপাড়ার রায়ের হাট থেকে স্বরূপকাঠির আটঘর-কুড়িয়ানা পর্যন্ত প্রায় ১৫ কিলোমিটার রাস্তার দুই ধারে ছোট-বড় অসংখ্য মরিচবাগান রয়েছে। গাছগুলোতে ঝুলছে কাঁচা-পাকা লাল আর সবুজ রঙের মরিচ। কৃষকরা বাগান থেকে মরিচ তুলে কুড়িয়ানার জিন্দাকাঠি কালীমন্দির মাঠের পাইকারি বাজারে নিয়ে আসে। এই হাটে সপ্তাহের সোম ও শুক্রবার ভোর ৫টা থেকে সকাল সাড়ে ৭টা পর্যন্ত বোম্বাই মরিচ বেচাকেনা হয়।
ইজারাদার হুমায়ুন কবির জানান, ফাল্গুন থেকে জ্যৈষ্ঠ মাস পর্যন্ত বোম্বাই মরিচের আমদানি বেশি হয়। প্রতি হাটে ১০ থেকে ১৫ লাখ টাকার মরিচ বেচাকেনা হয়। এ ছাড়া বছরের প্রতি মাসেই এ হাটে বোম্বাই মরিচ পাওয়া যায়।
কুড়িয়ানা এলাকার বোম্বাই মরিচের আড়তদার মো. মনির হোসেন বলেন, ‘প্রতি হাটে গড়ে আড়াই থেকে তিন লাখ পিস মরিচ কিনে দেশের বিভিন্ন স্থানে নিয়ে যাই। তবে যেসব মরিচের মান ভালো সেগুলো ঢাকার রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান বাংলা অ্যাগ্রোর কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। এ ছাড়া বিদেশে রপ্তানি করার জন্য ওই প্রতিষ্ঠানের মরিচের চাহিদা দেওয়া থাকে। তারা প্রক্রিয়াজাত করে বিদেশে রপ্তানি করে।’
কৃষক ইব্রাহীম আহমেদ বলেন, সাধারণত পিস হিসেবে বিক্রি হয় বোম্বাই মরিচ। মানভেদে প্রতি ১০০ মরিচ ২০ থেকে ৬০ টাকা দরে কেনা হয়। তবে মৌসুমের বাইরে মরিচের দাম গিয়ে দাঁড়ায় ৮০ থেকে ১০০ টাকা। লতা, সাদা, কালো, ঢোলশাই, ঘৃতকুমারী বোম্বাই মরিচের চাহিদা একটু বেশি।
বরিশাল কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত পরিচালক রফিকুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, অধিক পরিমাণে ও বাণিজ্যিক ভিত্তিতে নাগা মরিচ বা বোম্বাই মরিচ চাষের উজ্জ্বল সম্ভাবনা রয়েছে। আর বরিশাল অঞ্চল বোম্বাই মরিচ চাষের সম্পূর্ণ উপযোগী। কৃষি বিভাগ বোম্বাই মরিচ আবাদের ওপর জোর দিলে এই কৃষিপণ্য রপ্তানি করে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন সম্ভব।