মঙ্গলবার, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ০৫:১৬ পূর্বাহ্ন
৮ ডিসেম্বর। কক্সবাজারে জাহাজ ভাঙা শিল্পপ্রতিষ্ঠান এসএন করপোরেশনে কাটার হেলপার হিসেবে কর্মরত শ্রমিক মো. শাহজাহান কর্মস্থলে মারা যান। অক্সি-ফুয়েল গ্যাস কাটারের সাহায্যে জাহাজের লোহার পুরু পাত কাটার সময় ওই পাতের তাপেই তার মৃত্যু ঘটে। একই প্রতিষ্ঠানের কাটারম্যান মো. মোজাম্মেল মারা যান ৪ ডিসেম্বর। তার মৃত্যু হয় জাহাজের উঁচুস্থান থেকে পড়ে গিয়ে।
প্রতি মাসেই দেশের জাহাজ ভাঙা শিল্পে শ্রমিকের মৃত্যু ঘটে। ২০১৭ সালে এ শিল্পে কর্মরত অবস্থায় মারা গেছেন ১৫ জন শ্রমিক। ২০১৩ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত পাঁচ বছরে মারা গেছেন ৯৩ জন শ্রমিক; আহত হয়েছেন ১৫৪ জন। এ হিসাবে মোট হতাহত প্রায় ২৫০। হতাহতের প্রধান কারণগুলোর মধ্যে আছে— জাহাজ থেকে পড়ে যাওয়া, লোহার পাতের ধাক্কা বা নিচে চাপা পড়া, অগ্নিকাণ্ড, এক্সক্যাভেটরের আঘাত এবং বিষাক্ত গ্যাসে আটকা পড়া।
খাতসংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, জীবনের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ এ বাস্তবতা মেনে নিয়েই শ্রমিকরা পেটের তাগিদে এ শিল্পে কাজ করেন। কিন্তু দুর্ঘটনার জন্য জাহাজ ভাঙা ইয়ার্ডে রাতের বেলায় কাজ করা, সেফটি প্রশিক্ষণ ছাড়াই শ্রমিক নিযুক্ত করা, শ্রম আইন ও বিধিমালার অপর্যাপ্ত প্রয়োগ, সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগের অনিয়মিত পরিদর্শন এবং ইয়ার্ডগুলোয় ব্যবস্থাপনার অভাবকে দায়ী করা হয়। সবকিছু ছাপিয়ে দুর্ঘটনার অন্যতম বড় কারণ হলো, কাজের সময় ব্যক্তিগত সুরক্ষা উপকরণ ব্যবহার না করা।
জাহাজ ভাঙা শ্রমিকদের অভিযোগ, কাজের সময় প্রয়োজনীয় সুরক্ষা উপকরণ সরবরাহের দায়িত্ব মূলত মালিকপক্ষের। আর বেশির ভাগ মালিকেরই এসব উপকরণ দিতে অনীহা রয়েছে। ফলে সুরক্ষা উপকরণ হিসেবে হেলমেট, সেফটি জ্যাকেট, বুট ব্যবহার করার কথা থাকলেও ইয়ার্ডগুলোয় এসবের ব্যবহার খুব একটা দেখা যায় না। বেসরকারি সংস্থা বাংলাদেশ অকুপেশনাল সেফটি, হেলথ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট ফাউন্ডেশনের (ওশি) জরিপ বলছে, প্রায় ৯৫ শতাংশ ইয়ার্ড মালিক শ্রমিকদের এসব সুরক্ষা উপকরণ সরবরাহ করেন না।
শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ড শ্রমিক-কর্মচারী ফেডারেশনের অভিযোগ, জাহাজ মালিকরা তাদের জাহাজ ভাঙার কাজ দেন ঠিকাদারকে। এক্ষেত্রে ভাঙার কাজ সম্পন্ন করতে সময় বেঁধে দেন ইয়ার্ড মালিকরা। দ্রুত জাহাজ ভাঙতে শ্রমিকদের চাপ দিয়ে কাজ করিয়ে নেন এ ঠিকাদাররা। ব্যক্তিগত সুরক্ষা উপকরণ ব্যবহারে অনেক সময় কাজের গতি শ্লথ হয়ে যায়। এ কারণে ঠিকাদাররা সুরক্ষা ব্যবস্থা ব্যবহারে শ্রমিকদের নিরুত্সাহিত করেন।
শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ড শ্রমিক-কর্মচারী ফেডারেশনের সভাপতি শফর আলী বলেন, মালিকপক্ষ এখন আগের চেয়ে অনেক সচেতন। আগে ইয়ার্ডগুলোয় ব্যক্তিগত সুরক্ষা ব্যবস্থা চোখেই পড়ত না। এখন উপকরণ আছে সেটা দেখা যায়। কিন্তু এগুলোর ব্যবহার দেখা যায় না। ঠিকাদাররাও মালিকপক্ষ। তাই এগুলোর ব্যবহার নিশ্চিত করার দায়িত্বও তাদের। আর প্রায় শতভাগ ক্ষেত্রেই এ দায়িত্বে অবহেলা দেখা যায়। এছাড়া আইন অনুযায়ী ঠিকাদারদের সরকারি অনুমোদন থাকার কথা। কিন্তু সাত থেকে আটটি প্রতিষ্ঠানের অনুমোদন থাকলেও বেশির ভাগ ঠিকাদারই অনুমোদিত নয়।
কল-কারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের মহাপরিদর্শক সামছুজ্জামান ভূঁঁইয়া বলেন, জাহাজ ভাঙা শিল্প মালিকরা জাহাজ ভাঙার কাজ দেন ঠিকাদারকে। সুরক্ষা উপকরণ ব্যবহার নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে দুপক্ষেরই দায় রয়েছে। আর দুপক্ষই এ দায়িত্ব পালন করছে কিনা, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। কিন্তু আমাদের পরিদর্শন ব্যবস্থার দুর্বলতার কারণে সেখানে প্রতিদিন তদারকি করা সম্ভব হয় না। আর অধিকাংশ ক্ষেত্রে সুরক্ষা উপকরণের ব্যবহার না হওয়ার পেছনে শ্রমিকেরও দায় আছে। পরিবেশগত কারণেই উপকরণ ব্যবহার থেকে শ্রমিকরা বিরত থাকেন। যেসব উপকরণ ব্যবহার করার নিয়ম, সেগুলো বাংলাদেশের আবহাওয়ার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। অতিরিক্ত তাপের কাজ হওয়ায় শ্রমিকরা এগুলো ব্যবহার থেকে বিরত থাকেন।
ওশির বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০১৭ সালে জাহাজ ভাঙা শিল্প দুর্ঘটনার প্রায় ৩২ শতাংশ ঘটেছে আয়রন প্লেটের তাপে। একই সংখ্যক দুর্ঘটনা ঘটেছে উঁচুস্থান থেকে পড়ে গিয়ে। ১৩ শতাংশ দুর্ঘটনা ঘটেছে অগ্নিকাণ্ডে। এক্সক্যাভেটরের আঘাতে হতাহতের ঘটনা ৫ শতাংশ। গ্যাসের কারণে শ্বাসরোধের ঘটনা ২ শতাংশ।