শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ১০:১২ অপরাহ্ন
অর্থ-বাণিজ্য ডেস্কঃ রাজনৈতিক বিবেচনায় অনুমোদন পাওয়া ব্যাংকগুলোর ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা শুধু দেশের গণ্ডিতেই সীমাবদ্ধ নয়, সাত সমুদ্র তেরো নদীর ওপারে যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসিতে বিশ্বব্যাংক ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহিবলের (আইএমএফ) বসন্তকালীন সভায়ও এই উদ্বেগ উঠে এসেছে। বিশ্বব্যাংক মনে করে, বাংলাদেশে প্রয়োজনের তুলনায় ব্যাংকের সংখ্যা অনেক বেশি। বেসরকারি খাতের বেশ কয়েকটি ব্যাংক মারাত্মক ঝুঁকিতে রয়েছে। বসন্তকালীন সভার দ্বিতীয় দিনে শুক্রবার অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল যখন বিশ্বব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকে বসেন তখন বাংলাদেশের আর্থিক খাত নিয়ে বিস্তারিত একটি প্রতিবেদন তুলে ধরে বিশ্বব্যাংক। ওই প্রতিবেদনে বহুজাতিক সংস্থার নীতিনির্ধারকরা বাংলাদেশে ব্যাংকের সংখ্যা কমিয়ে আনার কথা বলেন। দুর্বল ব্যাংকগুলোকে শক্তিশালী ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত করার প্রস্তাব দেয় বিশ্বব্যাংক। একই সঙ্গে ক্রমাগত বাড়তে থাকা খেলাপি ঋণের লাগাম টেনে ধরারও পরামর্শ দেওয়া হয়।
বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের তিন দিনের বসন্তকালীন সভার দ্বিতীয় দিনে এক ব্যতিক্রমী আয়োজন করে বিশ্বব্যাংক। বিশ্বের ১৮৯টি সদস্য দেশ থেকে আসা প্রতিনিধি এবং অংশীজনের কাছে জানতে চাওয়া হয়, ২০৩০ সালের মধ্যে দারিদ্র্যের হার শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনতে কোন কোন বিষয়কে অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত। জবাবে অংশীজন ও প্রতিনিধিদের কাছ থেকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতে বিনিয়োগ বাড়ানো। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ অংশগ্রহণকারী অংশীজন বলেছেন, কর্মসংস্থান তৈরি করতে পারলে দারিদ্র্যের হার কমিয়ে আনা সম্ভব। বড় একটি অংশ বলেছে, দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান এবং সংস্কারের মাধ্যমে দারিদ্র্য কমিয়ে আনা। আরো রয়েছে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব মোকাবেলায় কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ, খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত, সংঘাত ও সহিংসতা বন্ধ। যদিও বাংলাদেশে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে বিনিয়োগ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর তুলনায় সবচেয়ে কম, যা মোট জিডিপির মাত্র ২ শতাংশের মধ্যে। বাংলাদেশের বিশেষজ্ঞরা বরাবরই শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে বিনিয়োগ বাড়ানোর দাবি করে আসছেন; যেটা শুক্রবারের সভায়ও উঠে এসেছে।
বেশ কয়েকটি সভায় অংশ নেওয়া শেষে বিকেলে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল সাংবাদিকদের বলেন, ‘বিশ্বব্যাংক বলেছে, আমাদের ব্যাংকের সংখ্যা বেশি। ঋণখেলাপির পরিমাণও বেশি। তারা বলেছে আর্থিক খাতে ব্যাপক সংস্কার আনতে। তারই অংশ হিসেবে ব্যাংকের সংখ্যা কমিয়ে আনতে।’ অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘বেশ কয়েকটি দুর্বল ব্যাংককে আমরা শক্তিশালী ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত করব। তবে সেটি অবশ্যই বেসরকারি ব্যাংক। কারণ সরকারি ব্যাংক বেশ ভালো করছে। তারা ভালো সেবা দিচ্ছে। বেসরকারি ব্যাংক যেগুলো দুর্বল এবং ঝুঁকিতে আছে, সেগুলো একীভূত করা হবে। সেটা সরকারি ব্যাংকের সঙ্গেও হতে পারে আবার ভালো বেসরকারি ব্যাংকের সঙ্গেও হতে পারে।’ অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ব্যাংক একীভূত হওয়ার ঘটনা আছে। আমরাও সেটা করব। সে জন্য প্রয়োজনে আমরা ব্যাংক কম্পানি আইন সংশোধন করব।’ যদি কোনো দুর্বল ব্যাংক একীভূত হতে না চায়, তখন বাংলাদেশ ব্যাংক প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করবে বলে জানান অর্থমন্ত্রী। ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও শেয়ারবাজারের বিষয়ে বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফ যেসব সংস্কারের প্রস্তাব দিয়েছে, সরকার সেসব সংস্কার প্রস্তাব বাস্তবায়নে চেষ্টা করবে বলেও জানান অর্থমন্ত্রী।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, রাজনৈতিক বিবেচনায় অনুমোদন পাওয়া যেসব ব্যাংক এখন ঝুঁকিতে আছে, সেসব ব্যাংককে শক্তিশালী ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত করতে একটি মার্জার নীতিমালা তৈরি করছে তারা। বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক স্থিতিশীলতা বিভাগের মহাব্যবস্থাপক কবির আহমদের নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটি মার্জার নীতিমালা নিয়ে বর্তমানে কাজ করছে। একীভূত ও দেউলিয়া আইন সংশোধন নিয়েও কাজ চলছে।
অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘ব্যাংক খাতে সংস্কারে আমরা বেশ কয়েকটি পদক্ষেপ গ্রহণ করেছি। ব্যাংকের পরিশোধিত মূলধন বিদ্যমান ৪০০ কোটি থেকে বাড়িয়ে এক হাজার কোটি টাকা করা হচ্ছে। তবে বিশ্বব্যাংককে আমরা বলেছি, তোমরা যেভাবে ঋণখেলাপির হিসাব করো, সেখানে সত্যিকারের চিত্র উঠে আসে না। নানা কারণে ঋণখেলাপি হওয়ার সুযোগ আছে। তারা আমাদের এসব যুক্তি শুনেছে। তার পরও আমরা ঋণখেলাপি কমাতে অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কম্পানি চালু করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’
বিশ্বব্যাংকের সহযোগী সংস্থা আইএফসির সঙ্গে বৈঠকের বিষয়ে অর্থমন্ত্রী বলেন, সংস্থাটি বাংলাদেশকে ১০০ কোটি ডলার ঋণ দেবে। এই টাকা বেসরকারি খাতের উন্নয়নে খরচ হবে। উৎপাদনশীল খাতে খরচ হবে। এর মাধ্যমে দেশে প্রচুর কর্মসংস্থান হবে। ফলে দারিদ্র্যের হারও কমে আসবে।
বিশ্বব্যাংকের সদস্যভুক্ত দেশগুলোর অর্থমন্ত্রীদের নিয়ে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) কিভাবে বাস্তবায়ন করা সম্ভব, তা নিয়ে আলাদা একটি সেশন অনুষ্ঠিত হয় দ্বিতীয় দিন। সেখানে এসডিজি বাস্তবায়নে বাংলাদেশের অগ্রগতি প্রতিবেদন তুলে ধরা হয়। অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘এসডিজি বাস্তবায়নে আমাদের কত টাকা দরকার, তা আমরা বের করেছি। বিষয়টি আমরা তাদের সামনে তুলে ধরেছি।’ অর্থমন্ত্রী বলেন, বিদেশে আর টাকা পাচার হবে না। এখন বরং বিদেশ থেকে টাকা বাংলাদেশে আসবে বিনিয়োগের জন্য। শেয়ারবাজারকে আরো গতিশীল করা হবে বলেও জানান অর্থমন্ত্রী।
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ঝুঁকিতে থাকা ২০টি দেশ নিয়ে প্রতিষ্ঠিত ‘ভালনারেবল গ্রুপ ২০’-এর সভাও অনুষ্ঠিত হয় এদিন। সেখানে ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলোকে অভিযোজন ও উপশম খাতের জন্য একটি তহবিল গঠনের বিষয়ে আলোচনা হয়। তবে তহবিলের আকার কত হবে, তা এখনো চূড়ান্ত হয়নি বলে জানান অর্থসচিব আবদুর রউফ তালুকদার। এদিনের আলাদা একটি সভায় বাংলাদেশের নারীর ক্ষমতায়ন নিয়ে ভূয়সী প্রশংসা করা হয়। সংবাদ সম্মেলনে অন্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন বিশ্বব্যাংকের বিকল্প নির্বাহী পরিচালক মোশাররফ হোসেন ভুঁইয়া, অর্থসচিব আবদুর রউফ তালুকদার, ইআরডি সচিব মনোয়ার আহমেদ প্রমুখ।