শনিবার, ১৪ Jun ২০২৫, ০৮:৫৩ পূর্বাহ্ন
ভোলা থেকে মো. আতিকুর রহমানের প্রতিবেদন :
ভোলার চরফ্যাশনের মুখারবান্দা এলাকায় বসবাসকারী স্বামীহীন এক বৃদ্ধা মা কাঁদতে কাঁদতে বললেন, “আমি কোরবানির খাসি দিতে না পারায় আমার মেয়ে সুরমাকে ওরা মেরেই ফেলবে।” কথাগুলো শুধু কণ্ঠে নয়, যেন তার গোটা অস্তিত্বের আর্তনাদ।
তিনি জানান, বিয়ের সময় জামাইয়ের বাড়িতে যৌতুক হিসেবে ফ্রিজ, মোটরসাইকেল, স্বর্ণের চেইন, ঘড়িসহ প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র দেওয়া হয়েছিল। পরে মেয়ের পুত্রসন্তান জন্ম নিলে আরও নগদ অর্থ ও স্বর্ণালঙ্কার দিতে হয়। কিন্তু এর পরেও শ্বশুরবাড়ির চাহিদার কোনো শেষ নেই।
জৈষ্ঠ্য মাস এলেই শ্বশুরবাড়ির পক্ষ থেকে দাবি আসে আম, কাঠাল, দুধ পাঠানোর। এরপর কোরবানির ঈদ উপলক্ষে খাসি, চালের গুড়া, আদা, রসুন, তেলসহ রান্নার যাবতীয় উপকরণও চাওয়া হয়। বৃদ্ধা মা বলেন, “স্বামীকে হারিয়েছি বহু বছর আগে। মেয়েকে একা হাতে বড় করেছি। এখন বয়স হয়েছে, রোজগার নেই। এসব চাহিদা মেটানো আমার পক্ষে অসম্ভব। তাই কিছুই পাঠাতে পারিনি। সেই অপরাধে ঈদের দ্বিতীয় দিন আমার মেয়েকে ওরা পিটিয়েছে। আমি এখন তার জীবনের নিরাপত্তা নিয়ে গভীর শঙ্কায় আছি।”
এই ঘটনা নতুন নয়। ভোলাসহ দেশের অনেক এলাকায় ‘উৎসব উপহার’ বা ‘ঈদ সামগ্রী’ পাঠানো যেন এক অলিখিত সামাজিক নিয়মে পরিণত হয়েছে। এই ‘উপহার’ এখন আর ভালোবাসা বা সৌজন্যের প্রকাশ নয়, বরং নিম্নবিত্ত পরিবারের ওপর একপ্রকার চাপ এবং সামাজিক নিপীড়ন।
সামর্থ্যবানরা কখনো শখের বসে জামাইয়ের বাড়িতে ফলমূল বা দুধ পাঠিয়ে থাকেন। কিন্তু সেই প্রথা আজ সমাজে এমনভাবে গেঁথে গেছে যে, না পাঠালে মেয়েরা হয়রানি ও অপমানের শিকার হন। অনেক সময় তাদের ওপর চালানো হয় শারীরিক নির্যাতন।
চরফ্যাশনের এক স্কুলশিক্ষক বলেন, “এই ‘উপহার’ এখন এক প্রকার বাধ্যবাধকতায় পরিণত হয়েছে। এটি একপ্রকার আধুনিক যৌতুক। সমাজে এমন এক পরিবেশ তৈরি হয়েছে—না পাঠালে লজ্জা, আর না পেলে রাগ, হুমকি, এমনকি হিংস্রতা। গরীব বাবা-মা কীভাবে এসব সামাল দেবেন?”
যৌতুকবিরোধী আইন থাকলেও ‘উপহার’ নামের এই প্রথা আইনের চোখে পড়ছে না। অধিকাংশ পরিবার সামাজিক সম্মানের কথা ভেবে চুপ থাকেন। মেয়ের সংসার ভাঙার ভয়ে মুখ খোলেন না কেউ।
বৃদ্ধা মা আরও বলেন, “আমি চাই না মেয়ের ঘর ভাঙুক। কিন্তু ওর জীবন যদি নিরাপদ না থাকে, তাহলে আর ঘর দিয়ে কী হবে? আমি অসহায় হয়ে গেছি। কোথায় যাবো, কার কাছে যাবো?”
এই প্রশ্ন শুধু এক মায়ের নয়, গোটা সমাজের বিবেকের কাছে এক জোরালো অনুরোধ। উপহার যদি ভালোবাসার পরিবর্তে হয়ে ওঠে নির্যাতনের কারণ, তাহলে তা আর উপহার নয়—তা নিপীড়নেরই মুখোশ।
এই ভয়ংকর প্রথা বন্ধ করতে হলে এখনই সময় সচেতন হওয়ার। প্রয়োজন শিক্ষা, আইন প্রয়োগ এবং সর্বস্তরের মানুষদের সম্মিলিত সামাজিক প্রতিবাদ।