শনিবার, ২৮ Jun ২০২৫, ০৯:২৫ অপরাহ্ন
নিজস্ব প্রতিবেদক, নীলফামারী:
জমিজমা সংক্রান্ত পারিবারিক বিরোধ থেকে শুরু। শেষ পর্যন্ত অভিযোগ গিয়ে ঠেকে পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে ঘুষ আদায়ের গুরুতর অভিযোগে। নীলফামারী জেলার ডোমার উপজেলার এক নাগরিক রশিদুল ইসলাম সম্প্রতি অভিযোগ তুলেছেন, ডোমার থানার এসআই শরিফুল ইসলাম তার কাছ থেকে জোরপূর্বক ৪৫ হাজার টাকা আদায় করেছেন। অভিযোগ উঠেছে, তদন্ত রিপোর্ট ‘পক্ষপাতহীন’ না রাখার হুমকি দিয়ে এই টাকা আদায় করা হয়। এতে ন্যায়বিচারের প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থা আরও একবার প্রশ্নবিদ্ধ হলো।
জমিজমা নিয়ে ভাইদের সঙ্গে বিরোধ
রশিদুল ইসলাম ডোমার পৌরসভার বাসিন্দা। দীর্ঘদিন ধরে তার এবং তার ভাইদের মধ্যে পারিবারিক কিছু জমি নিয়ে বিরোধ চলে আসছে। পারিবারিক এই বিবাদের অবসান ঘটাতে একাধিকবার তিনি আইনি সহায়তা নেন। রশিদুলের দাবি, তার ভাইয়েরা জোরপূর্বকভাবে জমির একাংশ দখলের চেষ্টা করলে তিনি স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, থানায় ও নির্বাহী কর্মকর্তার দপ্তরে লিখিত অভিযোগ করেন।
রশিদুল বলেন, “আমি আইনের আশ্রয় নিয়েছিলাম কারণ আমি চাইনি বিষয়টি মারামারি বা সংঘর্ষ পর্যন্ত গড়াক। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে থানার যে কর্মকর্তার কাছে আমার অভিযোগের তদন্তভার পড়ে, তিনি নিজেই আমার বিপক্ষে অবস্থান নেন।”
তদন্ত কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ঘুষের অভিযোগ
রশিদুল ইসলামের অভিযোগ অনুযায়ী, ডোমার থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) শরিফুল ইসলাম প্রথমে তাকে আশ্বস্ত করেন যে, সঠিক তদন্ত হবে। কিন্তু কিছুদিন পরেই তার অবস্থান পাল্টাতে থাকে। তদন্ত কর্মকর্তার ঘন ঘন ফোন কল, সরেজমিনে গিয়ে ‘ঘনিষ্ঠ আলাপ’, এবং পরে আর্থিক দাবি বিষয়টিকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তোলে।
রশিদুল বলেন, “প্রথমে ১০ হাজার টাকা চান তিনি। বলেন, বিষয়টা যাতে আমার পক্ষে যায় তার জন্য কিছু খরচ আছে। আমি তখন বলেছিলাম, আমি গরিব মানুষ, এত টাকা কই পাবো? তখন তিনি বলেন, না দিলে রিপোর্ট ভাইদের পক্ষে যাবে।”
পরবর্তীতে রশিদুলের অভিযোগ, এসআই শরিফুল ইসলাম ধাপে ধাপে মোট ৪৫ হাজার টাকা আদায় করেন। প্রতিবারই তিনি ‘তদন্ত রিপোর্ট’ কিংবা ‘উপরে জমা দিতে হয়’ ইত্যাদি বলে চাপ প্রয়োগ করেন। রশিদুলের অভিযোগ, পুলিশের এই ভয় দেখানো এবং রিপোর্ট বিপক্ষে দেওয়ার হুমকিতে তিনি আতঙ্কিত হয়ে অর্থ দিতে বাধ্য হন।
ভয়ভীতি ও হুমকির অভিযোগ
রশিদুলের বক্তব্য অনুযায়ী, এসআই শরিফুল শুধু ঘুষ দাবি করেই ক্ষান্ত হননি, বরং কয়েক দফা সরাসরি হুমকিও দেন। তিনি বলেন, “শেষবার টাকা দিতে অস্বীকার করলে উনি বলেন, ‘ঠিক আছে, রিপোর্ট আমি তোমার ভাইয়ের পক্ষে দিয়া দিমু, তখন কইয়ো না কইছি না’। আমি থানা-মহল্লার লোকজনের মুখ দেখে টেনশন আর ভয়ে ছিলাম।”
এই ঘটনায় রশিদুল বর্তমানে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত বলে জানান। তার দাবি, পুলিশের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা যখন ঘুষ নিয়ে তদন্তের মোড় ঘোরাতে চান, তখন একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে আইনের আশ্রয় নেওয়া কঠিন হয়ে পড়ে।
দুর্নীতি দমন কমিশনে অভিযোগ দায়েরের প্রস্তুতি
এখন পর্যন্ত কোনো লিখিত অভিযোগ থানার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ বা জেলা পুলিশ সুপারের কাছে জমা না দিলেও, রশিদুল ইসলাম জানিয়েছেন, তিনি এ বিষয়ে আইনি ব্যবস্থা নিতে চান। ইতোমধ্যে তিনি ঘুষ প্রদান সংক্রান্ত আর্থিক লেনদেনের কিছু প্রমাণ সংরক্ষণ করেছেন, যা তিনি দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) এবং মানবাধিকার কমিশনে জমা দিতে প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
তিনি বলেন, “প্রমাণ ছাড়াই আমি অভিযোগ করিনি। আমার কাছে কিছু ফোন রেকর্ডিং এবং টাকা দেওয়ার সময়ের মেসেজ আছে, যা থেকে প্রমাণ হবে কিভাবে টাকা চাওয়া হয়েছিল এবং কিভাবে আমি বাধ্য হয়েছিলাম তা দিতে।”
স্থানীয়দের প্রতিক্রিয়া
ডোমার থানা এলাকায় এই অভিযোগ ছড়িয়ে পড়লে স্থানীয়দের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করা গেছে। কেউ কেউ বলছেন, পুলিশের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ নতুন নয়। আবার কেউ কেউ বলেন, বিষয়টি নিরপেক্ষ তদন্ত সাপেক্ষে প্রমাণিত হলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।
স্থানীয় এক ব্যবসায়ী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “আমরাও অনেক সময় থানায় গেলে বুঝি কে কোন জায়গায় টাকা চায়। ওরা সরাসরি না চাইলেও এমনভাবে কথা বলে যাতে বুঝতে পারি, টাকা ছাড়া কিছু হয় না।”
এসআই শরিফুল ইসলামের বক্তব্য
এই বিষয়ে জানতে চাইলে অভিযুক্ত এসআই শরিফুল ইসলাম ফোনে বলেন, “এই ধরনের কোনো অভিযোগ আমি জানি না। কেউ যদি আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ করে, সেটা আমার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ দেখবে। আমি সবসময় নিয়ম মেনেই কাজ করি।”
তবে ঘুষ নেওয়া, ভয়ভীতি প্রদর্শনের বিষয়ে প্রশ্ন করলে তিনি সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন এবং এরপর ফোন ধরেননি।
পেশাদারিত্ব ও জবাবদিহিতা প্রশ্নবিদ্ধ
এই অভিযোগ আবারও মনে করিয়ে দেয় দেশের থানাগুলোর বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা ঘুষ, দুর্নীতি ও প্রভাবিত তদন্তের অভিযোগগুলোকে। একদিকে জনসাধারণ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে ন্যায়বিচার প্রত্যাশা করে, অন্যদিকে পুলিশ সদস্যদের একাংশের এই ধরনের আচরণ সেই বিশ্বাসকে চরমভাবে আঘাত করে।
মানবাধিকার সংগঠনগুলোর উদ্বেগ
মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলছে, এ ধরনের ঘটনার তদন্ত স্বচ্ছ না হলে সাধারণ মানুষের পুলিশে আস্থা আরও কমবে। ‘অধিকার’ নামের একটি মানবাধিকার সংগঠনের স্থানীয় প্রতিনিধি বলেন, “নিচের স্তরে দুর্নীতি দূর করতে হলে আইজিপির পর্যায়ে কঠোর নির্দেশনা এবং স্থানীয়ভাবে সৎ কর্মকর্তাদের দায়িত্ব দিতে হবে।”
রশিদুল ইসলামের অভিযোগ যদি সত্য হয়, তাহলে এটি শুধু ব্যক্তিগত দুর্ভাগ্যের ঘটনা নয়—এটি একটি বড় কাঠামোগত ব্যর্থতার প্রতিচ্ছবি। যেখানে একজন নাগরিক ন্যায়বিচারের আশায় পুলিশের কাছে যায়, সেখানেই যদি তাকে ঘুষ দিতে হয়, তাহলে প্রশ্ন ওঠে, বিচারপথ কতটা সুরক্ষিত? এখন দেখার বিষয়—ডোমার থানা ও জেলা পুলিশ এই অভিযোগকে কীভাবে গ্রহণ করে এবং কতটা নিরপেক্ষ ও স্বচ্ছ তদন্ত হয়।