চাকরি প্রত্যাশী অসহায় নারীদের সাথে ভয়ংকর প্রতারণার পদ্মা লাইফের বিরুদ্ধে। নিয়োগের নামে টাকার লেনদেন, মিথ্যা প্রতিশ্রুতি, অনুমতি ছাড়া পলিসি ইস্যু এবং প্রতারণার অভিযোগে আবারও আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে এসেছে পদ্মা ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি। “সম্ভব অ্যাপস” নামের একটি অনলাইন প্ল্যাটফর্মে চাকরির বিজ্ঞাপন দেখে আবেদনকারীরা যখন সরাসরি প্রতিষ্ঠানের বাংলা মোটরস্থ প্রধান কার্যালয়ে উপস্থিত হন, তখন তাদের সামনে উন্মোচিত হয় আরও ভয়াবহ বাস্তবতা। কোম্পানির ডেপুটি ম্যানেজিং ডিরেক্টর সাজ্জাদ হোসেন ও জেনারেল ম্যানেজার মো. জিল্লুর রহমানের বিরুদ্ধে প্রতিশ্রুত বেতনের চাকরি না দিয়ে উল্টো লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেওয়া এবং টাকা ফেরত চাইলে জোর করে পলিসি ধরিয়ে দেওয়ার অভিযোগ এখন পুরো বীমা খাতে আলোড়ন তুলেছে। নারীদের সাথে প্রতারণার বিষয়ে ভিডিও প্রতিবেদন আসছে শিঘ্রই। এছাড়া পদ্মা লাইফের নানা প্রতারণা-অনিয়ম-দুর্নীতি নিয়ে ৫ পর্বের ধারাবাহীক প্রতিবেদনের আজ থাকছে ১ম পর্ব…

প্রতারণার শিকার প্রথম আবেদনকারী নিগার সুলতানা জানান, বিজ্ঞাপন দেখে তিনি বাংলা মোটরের প্রধান কার্যালয়ে গেলে দুই শীর্ষ কর্মকর্তা তাকে ব্রাঞ্চ ম্যানেজার পদে নিয়োগের আশ্বাস দেন। মাসিক ৪০ হাজার টাকা ফিক্সড বেতনের কথা বলে ৩ লাখ ৫০ হাজার টাকা দাবি করা হয়। দরকষাকষির পর তিনি নগদ ২ লাখ ৩২ হাজার টাকা পরিশোধ করেন। কিন্তু টাকা নেওয়ার পর তাকে জানানো হয় পদটি কমিশনভিত্তিক—প্রতিমাসে ১০ লাখ টাকার পলিসি না আনলে কোনো আয় নেই। পরিস্থিতি বুঝে টাকা ফেরত চাইলে তার অনুমতি ছাড়াই দুটি পলিসি ইস্যু করে জোর করে তুলে দেওয়া হয়। নিজেকে একজন গৃহিণী হিসেবে উল্লেখ করে নিগার সুলতানা বলেন, কোনো আয় না থাকায় এসব পলিসি চালিয়ে যাওয়া তার পক্ষে অসম্ভব।
একই অভিজ্ঞতার শিকার শাহনাজ পারভীনও। তিনিও “সম্ভব অ্যাপস”-এর বিজ্ঞপ্তি দেখে কোম্পানির কার্যালয়ে যান এবং একই দুই কর্মকর্তা তাকে ৩ লাখ ৫০ হাজার টাকার বিনিময়ে ব্রাঞ্চ ম্যানেজার পদে নিয়োগের আশ্বাস দেন। দরকষাকষির পর শাহনাজ ১ লাখ ৫০ হাজার টাকা প্রদান করেন। কিন্তু একই পদ্ধতিতে তাকে কোনো নিয়োগপত্র দেওয়া হয়নি; বরং জানানো হয় চাকরিটি কমিশনভিত্তিক। টাকা ফেরত চাইলে তার নামে একটি পলিসি ইস্যু করে দায় এড়ানোর চেষ্টা করা হয়।
তৃতীয় আবেদনকারী নদীয়া আক্তারের অভিযোগেও একই প্রতারণার ছাপ। তাকে ৩০ হাজার টাকা ফিক্সড বেতনের ইউনিট ম্যানেজার পদে নিয়োগের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ৪৪ হাজার টাকা দাবি করা হয়। দরকষাকষির পর নদীয়া ২২ হাজার ২৬০ টাকা পরিশোধ করেন। পরে জানানো হয় যে মাসিক ২ লাখ টাকার পলিসি সংগ্রহ না করলে কোনো বেতন পাওয়া সম্ভব নয়। টাকা ফেরত চাইলে তার নামে ইচ্ছেমতো একটি পলিসি করে হাতে ধরিয়ে দেওয়া হয়।

এই তিন নারী সোমবার আইডিআরএ চেয়ারম্যানের কাছে পৃথক লিখিত অভিযোগ জমা দিয়েছেন। আবেদনকারীরা তাদের আত্মসাৎ হওয়া অর্থ ফেরত এবং অভিযুক্ত দুই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে কঠোর আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানান। আইডিআরএ-এর এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন—সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পাওয়া গেলে অবশ্যই তদন্ত হবে এবং অনিয়ম প্রমাণিত হলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তিন নারীর আবেদন আইডিআরএ-তে জমা পড়ার পর বিষয়টি এখন নিয়ন্ত্রক সংস্থার বিশেষ নজরদারিতে এসেছে।
নিয়োগ প্রতারণার পাশাপাশি পদ্মা ইসলামী লাইফের বিরুদ্ধে গ্রাহকের দাবি পরিশোধে অনিয়ম, অর্থ আত্মসাৎ এবং মৃত্যুদাবি নিষ্পত্তিতে টালবাহানার অভিযোগও দীর্ঘদিনের। দাবি পরিশোধ না করায় কোম্পানির চেয়ারম্যান, সিইও ও আরও কয়েকজন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে আদালত গ্রেফতারি পরোয়ানাও জারি করেছে। শুধু তাই নয়, কোম্পানির আর্থিক স্বাস্থ্যও দিনে দিনে অবনতির দিকে। সর্বশেষ প্রকাশিত দ্বিতীয় প্রান্তিকের রাজস্ব হিসাব বলছে—২০২৫ সালের এপ্রিল থেকে জুন তিন মাসে প্রতিষ্ঠানটির আয়-ব্যয়ের ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৬ কোটি টাকারও বেশি, যা আগের বছরের তুলনায় আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ছয় মাসে মোট ঘাটতি ১৪ কোটি ৫৭ লাখ টাকা ছুঁয়েছে। ক্রমাগত এই ঘাটতি কোম্পানির জীবনবীমা তহবিলকেও মারাত্মকভাবে খর্ব করেছে, যা বিনিয়োগকারী এবং গ্রাহক উভয়ের জন্য উদ্বেগজনক সংকেত।

সমস্যা শুধু পদ্মা ইসলামী লাইফেই সীমাবদ্ধ নয়—সারা দেশের ইসলামি বীমা খাতই চরম সংকটে। আইডিআরএ-এর তথ্য অনুযায়ী, পদ্মা ইসলামী লাইফের বকেয়া দাবি প্রায় ২৪৬ কোটি টাকা। দীর্ঘদিন ধরে ইসলামি বীমা কোম্পানিগুলোর আর্থিক অনিয়ম, তহবিল আত্মসাৎ, দাবি-বিলম্ব, মিথ্যা বিনিয়োগ এবং শিথিল তদারকির অভিযোগ থাকলেও কার্যকর ব্যবস্থা না থাকায় ভেঙে পড়ছে গ্রাহকদের আস্থা। শরীয়াহ কাউন্সিলের কার্যকারিতা নিয়েও প্রশ্ন উঠছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন—সঠিক তদারকি, আর্থিক স্বচ্ছতা এবং নিয়োগ প্রক্রিয়ায় কঠোর নিয়ন্ত্রণ ছাড়া এই খাতের দুর্নীতি বন্ধ করা সম্ভব নয়।
প্রতারিত তিন নারী আক্ষেপের সঙ্গে জানিয়েছেন—“আমরা নিরীহ মানুষ। চাকরির আশায় গিয়েছিলাম, এখন টাকা ফেরত পাওয়ার জন্য ধুঁকছি। যারা আমাদের টাকা নিয়ে ভোগবিলাস করছে, তাদের মুখোশ উন্মোচন হোক—এটাই চাই।” অভিযুক্ত কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে কেউ কোনো মন্তব্য দিতে রাজি হয়নি।
ধারাবাহিক এই অনুসন্ধানের প্রথম পর্বে উঠে এল পদ্মা ইসলামী লাইফে নিয়োগের নামে ভয়াবহ প্রতারণার চিত্র। পরবর্তী পর্বে প্রকাশ করা হবে কোম্পানির আর্থিক অনিয়ম, তহবিল সঙ্কট, গ্রাহকের দাবি বকেয়া এবং শরীয়াহ কাউন্সিলের অকার্যকারিতার গভীরতর বিশ্লেষণ।