শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ০৭:৪১ অপরাহ্ন

উত্তেজনা ছড়াচ্ছে জাতীয় ঐক্য মঞ্চ

উত্তেজনা ছড়াচ্ছে জাতীয় ঐক্য মঞ্চ

শীর্ষকাগজের সৌজন্যে: প্রথমদিকে অনেকেই দ্বিধাদ্বন্দ্বে থাকলেও এখন সবাই বুঝতে পারছেন, একটা সাফল্যজনক প্রক্রিয়ার দিকে এগোচ্ছে জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়া। আর এটাকে নিয়েই সরকারের বড় চিন্তা। বিএনপি-জামায়াত নয়, সরকারের বড় মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়া। তাই এটাকে কীভাবে ঠেকানো যায় তা নিয়ে নানাভাবে চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে। জাতীয় ঐক্যের সমাবেশের ডাক দেওয়া হয়েছে আগামী ২২ সেপ্টেম্বর। ওই মঞ্চের জন্য সরকারের অনুমোদন চাওয়া হয়েছে। এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত জাতীয় ঐক্য মঞ্চের অনুমতি মেলেনি। এ ব্যাপারে ড. কামাল, রবসহ সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অনুমতি না পেলে দরকার নেই, বসে পড়বেন। সংবিধানের কোথাও লেখা নেই যে, সমাবেশের জন্য অনুমতি নিতে হবে। বরং সংবিধানে এটা বলা আছে, গণতান্ত্রিক অধিকার নিশ্চিত করার জন্য সভা-সমাবেশ করার সুযোগ দিতে হবে। আওয়ামী লীগ সংবিধানের দোহাই দেয় কথায় কথায়। সংবিধানের এই অধিকার নিশ্চিত করার বিধান লঙ্ঘন করলে এরজন্য অবশ্যই তাদের মাশুল দিতে হবে।
ড. কামাল, আ স ম রব, বি চৌধুরী, মাহমুদুর রহমান মান্নাদের বড় সমাবেশ করার মতো জনসমর্থন নেই। কিন্তু এই সমাবেশ সফল করার দায়িত্ব নিয়েছে বিএনপি। এটাই বড় চিন্তার কারণ। সরকার মনে করছে, গত দু’বছরে বিরোধী জোট বিশেষ করে বিএনপি-জামায়াত ঢাকা নগরীর আশপাশে লাখ লাখ মানুষের ঘাঁটি করেছে। এদের প্রস্তুত রাখা হয়েছে যে কোনো পরিস্থিতি সৃষ্টির জন্য। এর সঙ্গে যুক্ত হবে কোটা সংস্কার ও নিরাপদ সড়ক আন্দোলন ইস্যুতে বিক্ষুব্দ শিক্ষার্থীরা।
গত শনিবার ১ সেপ্টেম্বর বিএনপির সমাবেশ মাথা ঘুরিয়ে দিয়েছে। কোনো মিছিল ছাড়াই এতো বিপুল সংখ্যক লোকের সমাবেশ! তার পর থেকেই ধর-পাকড় শুরু হয়েছে সারা দেশে। কিন্তু এতে খুব একটা সফলতা পাওয়ার সম্ভাবনা নেই।
সরকার যে সব ক্ষেত্রে সফল হতে পারছে না এবং অনেক কিছুই প্রকৃত তথ্য সরকারের হাতে নেই তার বড় প্রমাণ হলো গত ফেব্রুয়ারি বেগম খালেদা জিয়া জেলে যাবার দিনের অপ্রতিরোধ্য শোডাউন, এপ্রিলের কোটা আন্দোলন এবং তারপর আগস্টের নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের অভাবিত পরিস্থিতি। বিরোধীদের দাবি, এরপর যা ঘটবে সেটি নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা সরকারের থাকবে না।
বিদেশি কূটনৈতিকরা নিজেদের মধ্যে ঘন ঘন বৈঠক করছেন। সরকার অভিযোগ করছে, বিদেশি কূটনৈতিকরা তাদের বিরুদ্ধে সুগভীর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। বলা হচ্ছে, আওয়ামী লীগের ভেতর থেকেও সরকার পতনের ষড়যন্ত্র হচ্ছে। এর সঙ্গে বিদেশিরা জড়িত।
নির্ভরযোগ্য সূত্র জানিয়েছে, ড. কামালের নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐক্যের প্রতি বিদেশিদের প্রায় সবারই সমর্থন রয়েছে। এই ঐক্য সফল করার প্রচেষ্টায় কূটনৈতিকরা নিজেরা ছাড়াও রাজনীতিবিদ, সুশীল সমাজসহ বিভিন্নজনের সঙ্গে আলাদা আলাদা বৈঠক করছেন।
প্রথমদিকে জাতীয় ঐক্য নিয়ে ধোঁয়াশা দেখা দিয়েছিল মূলত চারটি ইস্যুতে। ১. জাতীয় ঐক্যের নেতৃত্ব কার হাতে থাকবে ২. নতুন সরকার কার নেতৃত্বে গঠিত হবে বা কারা চালাবে ৩. স্বাধীনতা বিরোধী বা জামায়াত ইস্যু ৪. খালেদা জিয়া ও তারেক রহমান ইস্যু। এই চারটি ইস্যুর যে কোনোটি ছাড় দেওয়া বিএনপির জন্য কঠিন ছিল। সরকারের ধারণা ছিল- এই চারটির কোনোটিতেই বিএনপি ছাড় দিতে পারবে না। কিন্তু না, ড. কামালদের সব ক’টি দাবিই মেনে নিয়েছে বিএনপি। বিএনপি এখন পুরো নেত্বত্বই ড. কামালদের হাতে ছেড়ে দিয়েছে। আন্দোলন সফল হলে পরবর্তী নতুন সরকার ড. কামালের নেতৃত্বেই গঠিত ও পরিচালিত হবে। বলা হচ্ছে, এ ব্যাপারে লিখিত প্রতিশ্রুতিও নাকি দেয়া হয়েছে। যদিও লিখিতের বিষয়ে সত্যতা নিশ্চিত করা যায়নি।
এদিকে কথা অনুযায়ী জামায়াতের সঙ্গে বিএনপি বেশ কিছুটা দূরত্ব ভাব বজায় রেখে চলেছে। সিলেট সিটি নির্বাচনের মধ্য দিয়ে এই দূরত্বের প্রমাণ দেয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, জাতীয় ঐক্যেও কোনো প্রক্রিয়ার সঙ্গে জামায়াতকে রাখা হবে না। এমনকি খালেদা জিয়ার মুক্তির ব্যাপারেও জাতীয় ঐক্য মঞ্চের সহায়তা চাওয়া হবে না বলে মেনে নেয়া হয়েছে বিএনপির পক্ষ থেকে। তারেক রহমানসহ বিএনপির জুনিয়র-সিনিয়র নেতারা সবাই এখন জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়াকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিচ্ছেন। তারা সবকিছু ছাড় দিয়ে হলেও জাতীয় ঐক্য চাচ্ছেন। আর এটাই সরকারের জন্য মাথাব্যথার বড় কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
তবে এর চেয়ে বড় টেনশন সরকারের মধ্যে দেখা দিয়েছে নিজেদের মধ্যকার অবিশ্বাস ও অনাস্থা নিয়ে। তারা আশঙ্কা করছেন, আওয়ামী লীগেরই একটি অংশ ড. কামালের প্রক্রিয়ার সঙ্গে গোপনে জড়িত রয়েছে। বিশেষ করে যেসব আওয়ামী লীগ নেতা বিগত সময়ে ক্ষুব্দ ও বঞ্চিত হয়েছেন অথবা আশানুরূপ সুযোগ-সুবিধা পাননি। আবার যারা এবারের প্রার্থী তালিকায় নাম লেখানো থেকে বাদ পড়তে পারেন তাদেরও একটি অংশ নেপথ্যে ড. কামালদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করছেন বলে জানা গেছে। এছাড়া পুনরায় আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় না এলে কী হতে পারে- এই আতঙ্কেও অনেক নেতা ড. কামালের ঐক্য প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত হতে পারেন বলে মনে করা হচ্ছে।
বিশেষ করে  ড. কামাল এক সময় আওয়ামী লীগের শীর্ষ পর্যায়ের বরেণ্য নেতা ছিলেন। ১৯৮১ সালের ১৫ নভেম্বর দেশে যে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, তাতে বিএনপির প্রার্থী বিচারপতি আবদুস সাত্তারের বিপরীতে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন ড. কামাল হোসেন। বঙ্গবন্ধুর একান্ত অনুসারী ও সহচর হিসেবে দেশের প্রধান আইনবিদ ড. কামাল হোসেন আওয়ামী লীগের প্রবীণ নেতাকর্মীদের কাছে এখনো শ্রদ্ধার পাত্র। তিনি স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়ন কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন। স্বাধীনতা পরবর্তীতে আওয়ামী লীগের এমপি হয়ে আইনমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্বও পালন করেছেন ড. কামাল। শুধু তাই নয়, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর আওয়ামী লীগকে সংগঠিত রাখতে ভূমিকা পালন করেন। পরবর্তীতে আওয়ামী লীগ থেকে বের হয়ে গিয়ে ড. কামাল হোসেন গণফোরাম দল গঠন করেন। কিন্তু আওয়ামী লীগের শীর্ষনেতাদের সঙ্গে বরাবরই তার ভালো সম্পর্ক রয়েছে। ব্যক্তিগত জীবনে তাকে নিয়ে কোনো বিতর্কও নেই। বরং ক্লিন ইমেজের রাজনীতিবিদ হিসেবে পরিচিতি রয়েছে তার। দেশের প্রধান আইনবিদ হিসেবে তিনি নতুন প্রজন্ম ও নানা শ্রেণি পেশার মানুষের কাছেও শ্রদ্ধাভাজন ব্যক্তি। এসব কারণে ড. কামালের নেতৃত্বে জাতীয় ঐক্য হলে ভবিষ্যতে তার নেতৃত্বে বিকল্প আওয়ামী লীগও গঠিত হতে পারে বলে সরকারের কেউ কেউ মনে করছেন। তাই সরকার যেকোনো মূল্যে জাতীয় ঐক্য মঞ্চ ঠেকাতে সর্বাত্তক প্রচেষ্টা চালাচ্ছে বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে।
কিন্তু এরই মধ্যে জাতীয় প্রেসক্লাবে একমঞ্চে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, ড. কামাল হোসেন, আ স ম আবদুর রব, মাহমুদুর রহমান মান্নাসহ সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক অন্যান্য নেতৃবৃন্দ মিলিত হয়েছিলেন। কথা বলেছেন সবাই একই সুরে। জাতীয় ঐক্য সফল করার পক্ষে সবাই একাট্টা। তারা কেবল নির্ধারিত ডেটলাইন তথা ২২ সেপ্টেম্বরের অপেক্ষায় আছেন। সেদিন জাতীয় ঐক্য মঞ্চ তৈরির পরিকল্পনা করা হয়েছে দেশের স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রিক আন্দোলনের ঐতিহাসিক স্থান- সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে।
রাজনৈতিক নানা সূত্রের তথ্যে আশঙ্কা আছে নির্ধারিত সময়ে নির্বাচন নিয়েও। জাতীয় ঐক্যর প্রক্রিয়ার প্রধান ও গণফোরাম সভাপতি এ শঙ্কার কথা জানিয়েছেন। ইভিএম ব্যবহারে নির্বাচন কমিশনের তোড়জোড়ের প্রেক্ষিতে বিএনপির এক নেতা বলেছেন, ‘কীসের ইভিএম, ইসির ঠ্যাং ভেঙ্গে দেওয়া হবে।’ দলটির একাধিক নেতা বারবার বলছেন, ‘খালেদা জিয়ার মুক্তি ছাড়া কোনো নির্বাচন হবে না, হতে দেয়া হবে না।’ তাছাড়া জাতীয় নির্বাচনের আগে নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠনের দাবি ক্ষমতাসীন ছাড়া সব রাজনৈতিক দলের। এসব কারণে যথা সময়ে নির্বাচন নিয়ে স্বাভাবিকভাবেই দেশবাসীর মধ্যে শঙ্কা তৈরি হয়েছে। ওয়ান ইলেভেন পুনঃরায় নিয়ে আসার চক্রান্ত চলছে বলে দীর্ঘদিন ধরে সরকারের এমপি-মন্ত্রীরাও বারবার আশঙ্কার কথা বলছেন।
যদিও প্রধানমন্ত্রী সেই আশঙ্কা নাকোচ করে দিয়ে বলেছেন, ‘নির্বাচন ঠেকানোর ক্ষমতা কারো নেই। নির্বাচন যথা সময়েই হবে।’ একই সাথে গত ২ সেপ্টেম্বর গণভবনে সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী এও বলেছেন, কিছু হলেই সবাই ‘উত্তরপাড়ার’ দিকে তাকিয়ে থাকে। পুরো সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী ‘উত্তরপাড়া’ শব্দটি ৭ বার ব্যবহার করেছেন। যা নিয়ে নানা আলোচনা পর্যালোচনা হচ্ছে।
অবশ্য, নির্বাচন নিয়ে নানা মহলের সন্দেহ সংশয়ের প্রেক্ষিতে আওয়ামী লীগ বলছে, গণতান্ত্রিক ধারা বজায় রাখতে হবে। অগণতান্ত্রিক কোনো শক্তিকে ক্ষমতায় আসতে দেওয়া হবে না। অপরদিকে, জাতীয় ঐক্যের নেতারাসহ বিএনপি বলছে, গণতন্ত্রকে ফিরিয়ে আনতে অবশ্যই নিরপেক্ষ নির্দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। কিন্তু আওয়ামী ক্ষমতা ছেড়ে নির্বাচন দিতে এ মুহূর্তে কোনোভাবেই সম্মত নয়। এমনকি বিএনপির সঙ্গে নির্বাচন বা কোনো ইস্যুতেই আলোচনায় রাজি নয় বলে সভা-সমাবেশে বক্তব্য রাখছেন আওয়ামী লীগ নেতারা। যদিও ভেতরে ভেতরে উভয় দলের মধ্যে নানা বিষয়ে আলোচনা হচ্ছে বলে গুঞ্জন আছে।
অবশ্য আওয়ামী লীগের চাওয়া যেমন বিএনপির পুরণ করা সম্ভব নয়। ঠিক একইভাবে বিএনপির দাবিও আওয়ামী লীগের পক্ষে মেনে নেয়া অসম্ভব। কারণ এক্ষেত্রে একদল চায় ক্ষমতায় আসতে। অপর দল চায় ক্ষমতায় থাকতে। তাছাড়া বিএনপির দাবি অনুযায়ী, নির্দলীয় কোনো সরকারের কাছে ক্ষমতা দিয়ে নিরপেক্ষ নির্বাচন দিলে আওয়ামী লীগের ক্ষমতায় ফেরা যে আর সম্ভব নয়, সেটা ভালো করেই বুঝে ক্ষমতাসীনরা। ফলে প্রধান দু’দলের পর্দার অন্তরালে আলোচনা হলেও এর কোনো সুফলের আশা করছেন না কেউ-ই।
এসবের মাঝে অনেকের মধ্যে প্রশ্ন তৈরি হয়েছে, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থেকে নির্বাচন দেয়ার চেষ্টা করলে এর পরিণতি কী হতে পারে? ক্ষমতাসীনরা এ মুহূর্তে বিকল্প কী ভাবছে? কোনোভাবে নির্ধারিত সময়ে নির্বাচন না হলে দেশে কী হতে পারে? এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে অনেকেই নানা শঙ্কার কথা বলছেন। তবে পরিস্থিতি সরকারের নিয়ন্ত্রণে রাখা কঠিন চ্যালেঞ্জ হলে শেষ পর্যন্ত রাষ্ট্রপতির নেতৃত্বে নির্বাচনকালীন সরকার গঠন করে সংকট সমাধানের উদ্যোগ নেওয়া হতে পারে বলে কেউ কেউ ধারণা করছেন। সেটি হলে হয়তো বড় ধরনের সংকটে দেশকে পড়তে হবে না। এতে গণতান্ত্রিক ধারাও বজায় থাকবে। যদিও এমনটি ক্ষমতাসীনদের বিবেচনায় এ মুহূর্তে নেই বলে সরকার ঘনিষ্ঠজনদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে।
এদিকে ভারত থেকে আওয়ামী লীগ আর আগের মতো সুবিধা পাচ্ছে না। দেশটি বাংলাদেশের নির্বাচন নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক করার পক্ষে তাদের মতামত স্পষ্ট করে জানিয়ে দিয়েছে। আর ড. কামাল হোসেনের সঙ্গে ভারতের দীর্ঘদিনের গভীর সম্পর্ক রয়েছে। বলা হচ্ছে, আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তা হারানোর কারণে ভারতও ড. কামালের নেতৃত্বে নতুন জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ায় নেপথ্যে থেকে সমর্থন দিচ্ছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের ভূমিকা ও দৃষ্টিভঙ্গি একেবারেই স্পষ্ট। ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়া সংগঠিত করার পক্ষে তারা বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখছে বলেই বিভিন্ন সূত্র থেকে তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। চীন এ মুহূর্তে অনেকটা নিরপেক্ষ ভূমিকায় রয়েছে বলেই মনে করা হচ্ছে। এর মধ্যে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে আওয়ামী লীগ সরকার ভালো সম্পর্ক তৈরি করতে সক্ষম হলেও তাদেরকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখতে রাশিয়ার খুব একটা সহযোগিতার সুযোগ নেই বলে বিশ্লেষকদের মত। রাজনৈতিক একাধিক সূত্র ও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আওয়ামী লীগ যে ধরনের সমর্থন চাচ্ছে তা কোনো দেশই এখন আর দিতে চাচ্ছে না। যা আওয়ামী লীগের নীতি নির্ধারকদের মধ্যে হতাশা তৈরি করেছে। এর মধ্যে নেপালে বিমসটেক শীর্ষ সম্মেলনের সাইডলাইন বৈঠকে মিলিত হয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। ৩০ আগস্ট ভারতীয় সংবাদমাধ্যম এনডিটিভি এ খবর জানিয়েছে। এর আগে ২৯ আগস্ট পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত এক সংবাদ সম্মেলনেও ২ নেতার বৈঠকের কর্মসূচির কথা জানান পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম। তবে বৈঠকে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় রাখতে মোদীর জোরালো সমর্থন দেওয়ার কোনো ইঙ্গিত মেলেনি বলে কূটনৈতিক সূত্রে জানা গেছে।
ফলে ইভিএম ইস্যুতেও ইউটার্ন নিয়েছে সরকার ও ইসি। সূত্রমতে, সরকারের নির্দেশেই হঠাৎ করে নির্বাচন কমিশন (ইসি) আগামী একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ইলেক্ট্রোনিক ভোটিং মেশিন বা ইভিএম ব্যবহারে আরপিও পরিবর্তনের তোড়জোড় শুরু করেছিল। যা বেশ বিতর্ক সৃষ্টি করেছে। অবশ্য এরই মধ্যে আবার সরকারের ইশারায় থমকে গেছে সেই উদ্যোগ। ইউটার্ন নিয়েছে ইসি। এতে নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা আরেকবার প্রশ্নবিদ্ধ হলো। এর আগে সিটি নির্বাচনে চরম ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে কেএম নুরুল হুদার নেতৃত্বাধীন ইসি। এসব কারণে কোনোভাবেই হুদা কমিশনের অধীনে বিএনপিসহ জাতীয় ঐক্যের নেতারা নির্বাচনে না যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। তারা এই নির্বাচন কমিশন পুনঃগঠনের দাবি তুলেছেন।
একই কথা বলছেন সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরাও। দেশের সুশীল সমাজের সঙ্গে আওয়ামী লীগের সম্পর্ক যে ভালো যাচ্ছে না তা ইতিমধ্যে প্রকাশ্যে এসেছে খোদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বক্তৃতা-বিবৃতিতেই। সাম্প্রতিক সময়ে দেখা গেছে, প্রধানমন্ত্রী সুযোগ পেলেই সুশীল সমাজকে তুলোধুনো করছেন। তাই সুশীল সমাজও এ মুহ’র্তে ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়া সফল করার পক্ষে কাজ করছেন বলে তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। সর্বশেষ গত ৮ সেপ্টেম্বর জাতীয় প্রেসক্লাবে দি ঢাকা ফোরামের ব্যানারে সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা মিলিত হন। সেখানে সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য দেশবাসীকে আন্দোলনে নামার আহ্বানও জানিয়েছেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন সভাপতি হাফিজ উদ্দিন আহমেদ। তিনি দেশবাসীকে ৫২, ৬৯ ও ৭১ সালের মতো আন্দোলন করার আহ্বান জানিয়েছেন। জাতীয় ঐক্য ও বিএনপি নেতাদের মতো একইভাবে হাফিজ উদ্দিন আহমেদ গোলটেবিল বৈঠকে বলেছেন, ‘আগে সংসদ ভেঙ্গে দিয়ে নির্বাচন করার বিধান ছিল। এখন আইন করে সেটি বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। নির্বাচন কমিশনও সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করছে না। তারা এখন ইভিএম প্রকল্প হাতে নিয়ে আছে। প্রকল্প পাস হওয়ার আগেই একটি প্রতিষ্ঠানকে ইভিএম কিনতে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। যারা ইতিমধ্যে এলসিও খুলে ফেলেছে। কাজের অর্ডার পাবার আগেই কীভাবে এলসি খোলা হলো- তা প্রশ্নের সৃষ্টি করেছে।’ বিতর্কিত ইসির চলে যাওয়া উচিত বলেও মন্তব্য করেছেন সুশীল সমাজের এই প্রতিনিধি।
‘উন্নয়ন, গণতন্ত্র ও সুশাসন’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে সেখানে সরকারের কঠোর সমালোচনা করে আরও বক্তব্য রেখেছেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ব্যারিস্টার মঈনুল হোসেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ, ওয়ান ইলেভেন সরকারের সময়ের মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ড. দিলারা চৌধুরী, অর্থনীতিবিদ ড. রাশেদ তিতুমীর, অধ্যাপক আবু আহমেদ, পানি উন্নয়ন বোর্ডের সাবেক মহাপরিচালক ড. ম. ইনামুল হকের মতো বিশিষ্ট ব্যক্তিরা। হঠাৎ তাদের নতুন ব্যানারে একমঞ্চে উপস্থিতি ও আন্দোলনের আহ্বান সরকারের ভেতর ভয়কে আরও বাড়িয়ে দিবে বলে কেউ কেউ মন্তব্য করছেন।
এসবের বাইরে জেলখানার ভেতর আদালত বসিয়ে খালেদা জিয়ার বিচার করার প্রক্রিয়া নিয়েও নানা বিতর্ক তৈরি হয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে- এমন আদালত বসানোর বৈধতা ও যৌক্তিকতা নিয়ে। কারণ, খালেদা জিয়া দীর্ঘদিন ধরে শারীরিকভাবে অসুস্থ। বর্তমানে তিনি স্বাভাবিক হাটা-চলা করতে পারেন না। শরীরের একাংশ প্রায় প্যারালাইসড। তার জীবন নিয়ে শঙ্কা তৈরি হয়েছে। অথচ তার চিকিৎসার কোনো উদ্যোগ নেই। কারাবন্দী বয়োবৃদ্ধ সাবেক এই প্রধানমন্ত্রীকে শাস্তি দিতে কেন এতো তৎপরতা- তা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন দলটির কেন্দ্রীয় নেতারা। বিএনপির তৃণমূল নেতাকর্মীসহ দেশের সাধারণ মানুষের মধ্যেও এ নিয়ে ক্ষোভ আছে। যা এ মুহূর্তে জাতীয় ঐক্যে হাওয়া যোগাচ্ছে। দিন যত যাচ্ছে সঙ্গত কারণেই ক্ষমতা হারানোর আতঙ্ক সরকারি দলের মধ্যে ততই বাড়ছে। তবে নতুন নতুন কৌশল অবলম্বন করে সরকার টিকে থাকতে জোরালো তৎপরতা চালাচ্ছে বলে আওয়ামী লীগ ঘনিষ্ঠ একাধিক সূত্রে জানা গেছে। দেশে চলমান রাজনৈতিক উত্তাপ শেষ পর্যন্ত কোথায় পৌঁছাবে এবং কোন পথে এর সমাধান- তা নিয়ে নিশ্চিত করে কিছু বলতে পারছেন না বিশ্লেষকরা। সবার আশা সংকটের সুষ্ঠু সমাধান।
(সাপ্তাহিক শীর্ষকাগজে ১০ সেপ্টেম্বর ২০১৮ প্রকাশিত)

ভালো লাগলে নিউজটি শেয়ার করুন

© All rights reserved © 2011 VisionBangla24.Com
Desing & Developed BY ThemesBazar.Com