সোমবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ১২:৫৫ পূর্বাহ্ন
নরসিংদী প্রতিনিধি:
পরকীয়া সম্পর্ক ও প্রতিপক্ষকে ফাঁসাতে নরসিংদীর বেলাবোতে স্ত্রী ও দুই সন্তানকে হত্যা করেছেন গিয়াস শেখ নামে এক ব্যক্তি। হত্যার পর ঘটনা ভিন্নখাতে প্রবাহিত করতে গল্প সাজান তিনি। দিনভর নানা রহস্য থাকলেও বেলা গড়াতেই খুলতে শুরু করে রহস্যের জট। সর্বশেষ গিয়াসকে আটকের পর স্ত্রী-সন্তানসহ একে একে তিনজনকে হত্যার দায় স্বীকার করেছেন। পরে তার দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত ছুরি ও ক্রিকেট ব্যাট জব্দ করা হয়।
নিহতরা হলেন- গিয়াস শেখের স্ত্রী রহিমা বেগম (৩৫), তার ছেলে রাব্বি (১৩) ও মেয়ে রাকিবা আক্তার (৬)।
জানা গেছে, গিয়াস শেখ পেশায় রং মিস্ত্রি। একইসঙ্গে মাদকাসক্ত ও জুয়ারি।
রোববার (২২ মে) দুপুরে বেলাবো উপজেলার পাটুলি ইউনিয়নের বাবলা গ্রামের শেখবাড়ি থেকে নিহতদের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। এ ঘটনায় গিয়াস শেখ, প্রতিবেশী রেনু মিয়া, রিমন শেখ, রাজিবসহ পাঁচজনকে আটক করা হয়।
রোববার সকালে বেলাবোর পাটুলি ইউনিয়নের বাবলা গ্রামে একই পরিবারের তিনজন নিহতের ঘটনায় নরসিংদী জেলা পুলিশ, পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ (ডিবি), বেলাবো থানা পুলিশ ও পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআিই) সদস্যরা ঘটনাস্থলে যান। সেখানে একটি ঘরের মেঝেতে গিয়াসের স্ত্রী রহিমার রক্তাক্ত মরদেহ পড়ে আছে। অন্য একটি ঘরে বিছানার ওপর দুই সন্তানের মরদেহ পড়ে আছে। শুরু হয় তদন্ত।
একপর্যায়ে নিহতের স্বামী পুলিশকে জানান, কাজের সুবাদে স্ত্রী ও দুই সন্তানকে বাড়িতে রেখে শনিবার সন্ধ্যায় গাজীপুরে যান তিনি। এরইমধ্যে সকালে মোবাইল ফোনে স্ত্রী ও সন্তানদের মৃত্যুর খবর পান। পরে পুলিশ এসে নিহতের মরদেহ উদ্ধারের কাজ শুরু করে।
পিবিআই নরসিংদীর পুলিশ সুপার মো. এনায়েত হোসেন মান্নান বলেন, তিনটি হত্যাকাণ্ড সংগঠিত হওয়ার পর নিহতের স্বজনরা কান্নাকাটি শুরু করেন। কিন্তু নিহতের স্বামী গিয়াসের মধ্যে তেমন কোনো ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখা যায়নি। তাই তার প্রতি সন্দেহ ঘনীভূত হয়। পরে তার মোবাইল ট্র্যাক করে এলাকায় থাকার তথ্য পায় পিবিআই। একইসঙ্গে পরকীয়ার বিষয়ে নিশ্চিত হয় পিবিআই। পরে তাকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। একপর্যায়ে তিনি হত্যার কথা স্বীকার করেন। পরে তার দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে বাড়ির কাছের একটি খাল থেকে হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত ছুরি উদ্ধার করা হয় এবং জঙ্গল থেকে রক্তমাখা ক্রিকেট ব্যাট উদ্ধার করা হয়।
পুলিশ সুপার বলেন, ঘাতক গিয়াস শেখের জবানবন্দি মতে, গাজীপুর যাওয়ার কথা বলে সন্ধ্যায় বাড়ি থেকে বের হয়ে গেলেও গভীর রাতে তিনি ফিরে আসেন। তার স্ত্রী ও সন্তানরা ঘুমিয়ে পড়লে রাত আড়াইটার দিকে গিয়াস ক্রিকেট ব্যাট দিয়ে তার স্ত্রীকে উপর্যুপুরি পেটান। পরে তাকে মাটিতে ফেলে মাথায় ও বুকের মাঝখানে ছুরি দিয়ে আঘাত করেন। স্ত্রীকে হত্যার পর পাশের ঘরে ঘুমন্ত ছেলেমেয়েকে ক্রিকেট ব্যাট দিয়ে গলা চেপে ধরে শ্বাসরোধ করে হত্যা করেন।
পুলিশ সুপার এনায়েত আরও বলেন, বাড়ির রাস্তা নিয়ে প্রতিবেশী রেনু মিয়াদের সঙ্গে গিয়াসের বিবাদ ছিল। তাই মূলত প্রতিপক্ষকে ফাঁসাতে এবং পরকীয়ার কারণেই ঠান্ডা মাথায় স্ত্রী সন্তানদের হত্যা করেন তিনি। শুধু তাই নয়, হত্যার পর আইনের চোখ ফাঁকি দিতে পুলিশ, গোয়েন্দা সংস্থা ও পিবিআইকে মিথ্যা তথ্য দিয়ে দুপুর পর্যন্ত বিভ্রান্ত করে রাখেন।
এদিকে, শরীফা আক্তার নামে এক প্রতিবেশী জানিয়েছেন, নিহত রহিমার কাছে জামা সেলাই করতে দিয়েছেন তিনি। সকাল ৭টার দিকে তিনি রহিমাদের বাড়ি আসেন। এসে ঘরের দরজা খোলা দেখতে পান। একইসঙ্গে রহিমাকে মেঝেতে পড়ে থাকতে দেখেন। অনেক ডাকাডাকি করলেও কোন সারা দেননি তিনি। কাছে গিয়ে রহিমাকে রক্তাক্ত দেহ পড়ে থাকতে দেখেন। পাশের ঘরে চৌকির ওপর দুই সন্তানের মরদেহ পড়ে থাকতে দেখেন।
আটক হওয়ার আগে নিহত রহিমার স্বামী গিয়াস জানিয়েছেন, ১৫ দিন আগে বাড়ির পেছন থেকে একটি গাছ বিক্রি করেন তিনি। বাড়ির চারপাশ জুড়ে প্রতিবেশী রেনু মিয়ার জায়গা। এই গাছটি বাড়ির ওপর দিয়ে নিতে গেলে রেনু মিয়া বাধা দেন। এ নিয়ে তাদের সঙ্গে রেনু মিয়ার ঝগড়া হয়। ওই সময় রেনু মিয়া তাদেরকে মেরে ফেলার হুমকি দিয়েছেন বলে অভিযোগ করেন নিহতের স্বামী।
তার ছোট ভাইয়ের স্ত্রী ফরিদা বেগম জানান, গিয়াসের বাড়ির চারদিকের পুরো জায়গা রেনু মিয়ার। রেনুর জায়গা দিয়েই গিয়াসদের চলাচল করতে হয়। জমিজমা নিয়ে রেনুর সঙ্গে তার দীর্ঘদিন ধরে বিরোধ চলছিল। কয়েকদিন আগে গিয়াস বিক্রির জন্য তার বাড়ির কিছু গাছ কাটেন। এই গাছ রেনুর জায়গা দিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করলে রেনু বাধা দেন। এ নিয়ে তাদের মধ্যে বিবাদ শুরু হয়। স্থানীয়রাও তাদের দ্বন্দ্বের বিষয়টি জানতে পারেন।
সরেজমিনে দেখা যায়, বাবলা গ্রামে পাশাপাশি দুইটি মাটির ঘর। একটির মেঝেতে পড়ে আছে রহিমা বেগমের রক্তাক্ত মরদেহ। পাশের আরেকটি ঘরে পাশাপাশি দুইটি শিশুর মরদেহ পড়ে আছে। বাড়ির আঙিনা জুড়ে শতশত উৎসুক জনতা। নরসিংদী জেলা পুলিশ, বেলাবো থানা পুলিশসহ সরকারের বিভিন্ন সংস্থার লোকজন ঘটনাস্থলে গিয়ে তদন্ত শুরু করেছেন। পাশেই নিহতের বড় ভাইয়ের স্ত্রী কান্নাকাটি করছেন। ঘরের পেছনে একটি চেয়ার ঠাঁই বসে আছেন গিয়াস শেখ। স্বজন ও এলাকাবাসীর মধ্যে শোকের ছায়া নেমে আসলেও তার চোখে-মুখে শোকের ছাপ দেখা যায়নি। পরে তার নানা অসঙ্গতিপূর্ণ আচরণে পিবিআই পুলিশ সুপারের সন্দেহ হয়। পরে তাকে আটকের পর জিজ্ঞাসাবাদে বেরিয়ে আসে প্রকৃত রহস্য।