শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ০১:২১ পূর্বাহ্ন
অন্যান্য গৃহপালিত পশুর মতো ছাগলও বিভিন্ন ধরনের রোগে আক্রান্ত হয়। এই রোগ জীবাণু (ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস, মাইকোপ্লাজমা ইত্যাদি), পরজীবী (কৃমি, প্রোটোজোয়া, উঁকুন, আঠালি ইত্যাদি), অপুষ্টি, বংশগত অস্বাভাবিকতা, বিপাকীয় সমস্যা এবং বিষাক্ত পদার্থের কারণে হতে পারে।
নিম্নে ছাগলের ব্যাকটেরিয়াজনিত বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ রোগ, এদের লক্ষণ, চিকিৎসা এবং প্রতিরোধের উপায় আলোচনা করা হলো-
১. তড়কা বা অ্যানথ্রাক্স
গ্রীষ্ম প্রধান দেশে তড়কা ছাগলের একটি মারাত্মক রোগ। স্যাঁতস্যাঁতে পরিবেশে ছাগল এই রোগে বেশি আক্রান্ত হয়। রোগটি এতই মারাত্মক যে, তড়কার জীবাণু ছাগলে প্রবেশ করার ১২-১৮ ঘণ্টার মধ্যেই লক্ষণ প্রকাশ পায়। এমনকি লক্ষণ দেখা দেওয়ার আগেই ছাগল মারা যেতে পারে। ব্যাসিলাস অ্যানথ্রাসিস নামক জীবাণু দ্বারা রোগটি হয়ে থাকে।
লক্ষণসমূহ
প্রবল জ্বর হয়। ক্ষুধা থাকে না এবং জাবর কাটে না। পশু অস্থির হয়ে ওঠে এবং পেট ব্যথা আরম্ভ হয়। বার বার রক্ত মিশ্রিত পায়খানা হয়। রোগাক্রান্ত ছাগল খুব তাড়াতাড়ি অজ্ঞান হয়ে পড়ে এবং মারা যায়।
প্রতিরোধ
পালের কোন ছাগল হঠাৎ মারা গেলে বা তড়কা হয়েছে বলে সন্দেহ হলে অন্য ছাগলকে দ্রুত শুষ্ক ও উঁচু স্থানে সরিয়ে ফেলতে হবে। আক্রান্ত ছাগলের দ্রুত মৃত্যু হলে কোন নির্জন স্থানে ৬ ফুট গভীর গর্ত করে মৃতদেহ ও অন্যান্য জিনিসপত্র মাটিতে পুঁতে ফেলতে হবে।
প্রতিকার
তড়কা হয়েছে বুঝতে পারলে ৫ লাখ প্রোকেইন পেনিসিলিন রানের মাংসে বা ৫ মিলিলিটার টেরামাইসিন মাংসপেশীতে ইনজেকশন করতে পারলে উপকার পাওয়া যায়।
২. ওলান পাকা বা ম্যাসটাইটিস
গরু, মহিষ বা ভেড়ার মতো ছাগলেরও ওলান পাকা রোগ হয়। বাচ্চা দেওয়ার কিছুদিন আগে বা পরে এ রোগ দেখা দেয়। কোন সময় ছোটখাট ক্ষতের সংক্রমণ থেকে এ রোগ হয়। ছাগলের বিভিন্ন ধরনের ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণ এ রোগের কারণ।
লক্ষণসমূহ
গায়ে জ্বর থাকে, নাড়ির গতি দ্রুত হয়। ওলান শক্ত হয় ও বাঁটসহ ফুলে ওঠে। বাঁট দিয়ে পাতলা কখনও জমাট বাঁধা দুধ বেরিয়ে আসে এবং হঠাৎ মৃত্যু ঘটতে পারে। কখনও দুধের সঙ্গে রক্তও বেরিয়ে আসে।
প্রতিরোধ
দুধ দোহনের সময় বা বাচ্চাকে দুধ খাওয়ানোর সময় যাতে কোন ক্ষত সৃষ্টি না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। ক্ষত সৃষ্টি হলেও সঙ্গে সঙ্গে ক্ষতের জায়গাটি পরিষ্কার করার ব্যবস্থা করতে হবে। বাচ্চা ছাগলকে অন্য ছাগলের দুধ খাওয়ানোর ব্যবস্থা করতে হবে।
প্রতিকার
প্রথমত, পরিচ্ছন্ন জায়গায় স্থানান্তর করতে হবে। সংক্রমিত ওলান থেকে দুধ দিনে ২-৩ বার বের করে আয়োডিন দ্রবণ দিয়ে ধুয়ে দিতে হবে। সম্ভব হলে ক্যানুলা দিয়ে আয়োডিন দ্রবণ ওলানে ঢোকাতে হবে। এছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক দিয়ে চিকিৎসা করা যেতে পারে। এমপিসিলিন প্রতি ৮ ঘণ্টা পর পর ৩ মিলিগ্রাম বা কেজি ইনজেকশন প্রয়োগ করলে ভালো ফল পাওয়া যায়। সঙ্গে কিটোপ্রোফেন ১.৪ মিলিগ্রাম বা কেজি হিসেবে ৩৬-৪৮ ঘণ্টা পর পর শিরায় ইনজেকশন দিলে দ্রুত সেরে ওঠে।
৩. এন্টেরোটক্সিমিয়া বা পাল্পি কিডনি ডিজিজ
কোল্ডসট্রিডিয়াম পারফ্রিনজেন্স টাইপ-ডি নামক ব্যাকটেরিয়া দ্বারা এ রোগে আক্রান্ত হয়। কিডনি অত্যাধিক নরম এবং ফুলে যাওয়ার জন্য এ রোগকে পাল্পি কিডনি ডিজিজও বলা হয়। অতিরিক্ত দানাদার খাদ্য একসঙ্গে খেলে ছাগলের ক্ষুদ্রান্ত্রে বিদ্যমান কোল্ডসট্রিডিয়াম জীবাণু দ্রুত বৃদ্ধি পায় এবং তীব্র বিষ উৎপাদন করে। ফলে আক্রান্ত ছাগল কিছুক্ষণের মধ্যে মারা যায়। এ রোগ সাধারণত স্বাস্থ্যবান বাড়ন্ত ছাগলের বেশি হয়, তবে স্বাস্থ্যবান বয়স্ক ছাগলও এ রোগে আক্রান্ত হতে পারে।
লক্ষণসমূহ
সাধারণত কোন উপসর্গ বা লক্ষণ দেখা দেওয়ার আগেই ছাগল হঠাৎ মারা যায়। আক্রান্ত ছাগল প্রথমে দাঁড়ানো অবস্থায় চতুর্দিকে ঘুরতে থাকে, শরীর কাঁপতে থাকে, শরীরের তাপমাত্রা কমে যায়, পেট ব্যথার কারণে শুয়ে পা ছোড়াছুড়ি করতে থাকে, পাতলা পায়খানা হয়, অত্যাধিক দুর্বল হয়ে পড়ে এবং কম সময়ের মধ্যেই মারা যায়। মারা যাওয়ার পর পরই শরীরের চামড়ার রং বিবর্ণ হয়ে মৃতদেহে পচন ধরে।
প্রতিরোধ
অসুস্থ ছাগলকে সুস্থ্য ছাগল থেকে আলাদা করা এবং এদের মল-মূত্র ভালো করে পরিষ্কার করা। প্রয়োজনের অতিরিক্ত দানাদার খাদ্য সরবরাহ না করা বিশেষত স্বাস্থ্যবান ছাগলকে অতিরিক্ত খাদ্য গ্রহণ থেকে নিবারণ করা।
প্রতিকার
যেহেতু হঠাৎ করে মারা যায়, সে জন্য সাধারণত কোন চিকিৎসা করা যায় না। তবে প্রাথমিক অবস্থায় এ রোগ শনাক্ত করা গেলে এট্রোফিন সালফেট ইনজেকশন (৩ মিলিলিটার ৬ ঘণ্টা পর পর) এবং শিরায় স্যালাইন দিলে অনেক ক্ষেত্রে ভালো ফল পাওয়া যায়।
৪. ব্রুসেলোসিস
এক ধরনের ব্যাকটেরিয়া দ্বারা ছাগলে এ রোগ হয়ে থাকে। গর্ভের শেষের দিকে এ রোগের কারণে ছাগলের গর্ভপাত হয়। কিন্তু গর্ভাবস্থা ছাড়াও সাধারণ অবস্থাতেও এ রোগ হতে পারে।
লক্ষণসমূহ
গর্ভাবস্থায় এ ব্যাকটেরিয়া ছাগলের জরায়ু ও গর্ভফুলকে আক্রান্ত করে গর্ভপাত ঘটায়। আক্রান্ত ছাগল বহুদিন পর্যন্ত গর্ভধারণ করতে পারে না। পুরুষ ছাগলের অণ্ডকোষ ফুলে যায় এবং অনেক সময় ছাগলের যৌনক্ষমতা নষ্ট হয়ে যায়।
প্রতিকার
অ্যান্টিবায়োটিক দ্বারা দীর্ঘমেয়াদী চিকিৎসা করে অনেক সময় সুফল পাওয়া যায়, তবে আক্রান্ত ছাগলকে পাল থেকে সরিয়ে দেওয়াই উত্তম।