শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ০৮:৩৭ পূর্বাহ্ন
গত ২০১৬-১৭ অর্থবছরের শুরুতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২ লাখ তিন হাজার কোটি টাকা। অর্থবছরের শেষ দিকে তা কমিয়ে ১ লাখ ৮৫ হাজার কোটি টাকা করার সিদ্ধান্ত নেয় অর্থমন্ত্রণালয়। অর্থবছরের শেষে এনবিআর ওই লক্ষ্যমাত্রা অর্জন হয়েছে বলে জানিয়েছে। এনবিআরের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, আলোচ্য সময়ে আদায় হয়েছে ১ লাখ ৮৫ হাজার ৩ কোটি টাকা। অথচ সরকারি হিসাব সংরক্ষণকারী প্রতিষ্ঠান হিসাব মহা নিয়ন্ত্রকের (সিজিএ) কার্যালয় বলছে, তারা পেয়েছে ১ লাখ ৭১ হাজার ৫১০ কোটি টাকা। অর্থাত্ এনবিআর ও সিজিএ অফিসের মধ্যে রাজস্ব আদায়ের পরিসংখ্যানে ব্যবধান ১৩ হাজার ৪৯২ কোটি টাকা!
অতীতেও সিজিএ অফিসের সঙ্গে এনবিআরের রাজস্ব আদায়ের হিসাবে গরমিল ছিল। তবে গত অর্থবছর তা সব রেকর্ড ছাড়িয়েছে। ২০১০-১১ অর্থবছরে এ গড়মিল ছিল ২ হাজার ৯২৩ কোটি টাকা। সর্বশেষ ২০১৪-১৫ অর্থবছরে এ পার্থক ১২ হাজার ৬৪৫ কোটি হলেও পরবর্তী অর্থবছরে এটি কমে ৭ হাজার ৩৭৩ কোটি হয়। কিন্তু এক বছরের ব্যবধানে ৬ হাজার ১১৯ কোটি টাকা বেড়ে এ ব্যবধান দাঁড়িয়েছে প্রায় সাড়ে ১৩ হাজার কোটি টাকায়।
অতীতে এ ইস্যুতে উভয় পক্ষ নিজেদের হিসাবকে সঠিক দাবি করলেও এবার বিষয়টি নিয়ে বিব্রত ও চিন্তিত এনবিআরের শীর্ষ প্রশাসন। কেননা এত বেশি রাজস্বের গরমিলে নিজেদের অর্জন নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। অন্যদিকে সত্যি সত্যি সিজিএ অফিসের পরিসংখ্যান সঠিক হলে এবার রাজস্ব আদায়ের প্রকৃত লক্ষ্যমাত্রাও অনেক বেড়ে যাচ্ছে। চলতি অর্থবছর এনবিআরের রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করা হয়েছে ২ লাখ ৪৮ হাজার কোটি টাকার কিছু বেশি। এনবিআরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী চলতি বছর প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ৩৪ শতাংশ। কিন্তু সিজিএ’র হিসাব অনুযায়ী, (আদায় ১ লাখ ৭১ হাজার ৫১০ কোটি টাকা) এনবিআরকে বাড়তি আদায় করতে হবে প্রায় ৪৫ শতাংশ!
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, এনবিআরের পরিসংখ্যান বিভাগ থেকে আয়কর, ভ্যাট ও শুল্ক আদায়কারী সব অফিসকে সম্প্রতি চিঠি পাঠানো হয়েছে। চিঠিতে চলতি মাসের মধ্যে গত অর্থবছরের রাজস্ব আদায়ের প্রকৃত চিত্র পাঠাতে বলা হয়েছে। সম্প্রতি এনবিআর চেয়ারম্যান মোশাররফ হোসেন ভুঁইয়া মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে ইস্যুটি নিয়ে বৈঠক করেছেন। বৈঠকে কর্মকর্তাদের এ বিষয়ে কড়া বার্তা দিয়েছেন। সিজিএ অফিসের সঙ্গে আলোচনা করে নিজ নিজ অফিসের রাজস্ব পরিসংখ্যানের ব্যবধান কমানোর নির্দেশও দিয়েছেন। ইত্তেফাককে তিনি বলেন, গত অর্থবছর রাজস্ব আদায়ের প্রকৃত তথ্য কী ছিল, তা বের করার চেষ্টা করছি আমরা। আমরা অর্থবিভাগসহ সংশ্লিষ্ট অফিস এবং সিজিএ অফিসের সঙ্গেও বসবো।
সূত্র জানিয়েছে, গত অর্থবছর ঢাকার কর অঞ্চল-২ এর সঙ্গেই সিজিএ অফিসের হিসাবের গড়মিল প্রায় ৮ হাজার কোটি টাকা! ওই অফিস রাজস্ব আদায় ১২ হাজার কোটি টাকা দেখালেও সিজিএ বলছে ৪ হাজার কোটি টাকা। এছাড়া বৃহত্ করদাতা ইউনিট বা এলটিইউ-ভ্যাট অফিসের সঙ্গে এক হাজার কোটি টাকা, ঢাকা দক্ষিণ ভ্যাট অফিসের সঙ্গে ৭৫০ কোটি টাকার ব্যবধান। এর বাইরে অন্যান্য অফিসের সঙ্গেও সিজিএ অফিসের হিসাবের সঙ্গে ভালো অঙ্কের গরমিল রয়েছে।
এনবিআরের একজন ঊর্দ্ধতন কর্মকর্তা বলেন, অনেক সময় একই আদায় দুই দফা হিসাব হওয়ার ফলে রাজস্ব আদায় বেশি দেখা যায়। ভুল কোডে জমা দেওয়ার কারনেও একই অর্থ দুইবার হিসাব হতে পারে। আবার জমা দেওয়ার পর সংশ্লিষ্ট অফিসে ট্রেজারি চালান সময়মত জমা না হওয়া কিংবা পরবর্তী মাসের রাজস্বকে আগেই আদায় হিসেবে দেখানোর কারণেও হিসাবে ভুল হতে পারে। সাধারনত ট্রেজারি চালান সিজিএ অফিসে পৌঁছানোর পর সিজিএ অফিস রাজস্বের হিসাব করে থাকে। এ জন্য মাস শেষে ১৫ দিনের বেশি সময় লাগতে পারে। কিন্তু এনবিআরের সংশ্লিষ্ট অফিস লক্ষ্যমাত্রা অর্জন দেখানোর জন্য টাকা জমা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই হিসাব দেখায়। এছাড়া কোন কোন ক্ষেত্রে আদায় বেশি দেখানোর জন্যও কৃত্রিম হিসাব বানিয়ে রাজস্ব দেখানো হয়ে থাকে।
দীর্ঘদিন ধরে এ গরমিল বাড়তে থাকায় সরকারের রাজস্ব আদায়ের প্রকৃত চিত্র যেমন জানা যাচ্ছে না, অন্যদিকে সমস্যার কারন চিহ্নিত করে কার্যকর সমাধানও মিলছে না। ফলে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে সরকারের সংশ্লিষ্ট অফিসের হিসাব সংক্রান্ত অদক্ষতা। সেই সঙ্গে একই মন্ত্রণালয়ের দুই বিভাগের দুই রকম হিসাবের ফলে অর্থ মন্ত্রণালয়েও অস্বস্তি তৈরি হয়েছে।
অবশ্য এনবিআর কর্মকর্তারা বলছেন, অনেক সময় সিজিএ অফিসও সঠিক হিসাব না করার কারনে এ সমস্যা হয়ে থাকে। ঢাকা দক্ষিণের ভ্যাট কমিশনার কাজী মোস্তাফিজুর রহমান ইবলেন ভ্যাট আদায়ের সব প্রমাণ আমাদের কাছে আছে। সিজিএ অফিসকে চিঠি পাঠাবো।