সোমবার, ২৫ মার্চ ২০২৪, ০৩:১৯ পূর্বাহ্ন

লিফটে আটকে মা-বাবার সামনে প্রাণ গেল ছোট্ট আলভিরার

লিফটে আটকে মা-বাবার সামনে প্রাণ গেল ছোট্ট আলভিরার

নিজস্ব প্রতিবেদক: ত্রুটিপূর্ণ লিফটের দরজায় চাপা পড়ে মা-বাবার সামনেই প্রাণ হারাল নয় বছরের ছোট্ট শিশু আলভিরা রহমান। বৃহস্পতিবার রাতে রাজধানীর শান্তিনগরের আঠারো তলার একটি ভবনে এ ঘটনা ঘটে। ভবনের বাসিন্দাদের অভিযোগ, দীর্ঘদিন ধরেই ত্রুটিপূর্ণ অবস্থায় ছিল ওই লিফটটি। এর আগে ছোটখাটো বেশ কয়েকটি দুর্ঘটনা ঘটলেও কর্তৃপক্ষ তাতে কর্ণপাত করেনি। আর জীবন দিয়ে এর খেসারত দিতে হল ফুটফুটে শিশুকে। মর্মান্তিক এ মৃত্যুর পর ওই রাতেই ভবনের অন্য একটি লিফটে পনেরো মিনিট আটকে ছিলেন আরও এক বাসিন্দা।

দায় স্বীকার করে ভবন ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি মোহাম্মদ আলমগীর মিয়া বলেন, নিম্নমানের লিফটের কারণেই এ দুর্ঘটনা ঘটেছে। লিফটের সেন্সর ঠিকমতো কাজ করছিল না। লিফটের ত্রুটি সারানোর বিষয়ে বৃহস্পতিবার দুর্ঘটনা ঘটার কিছুক্ষণ আগেও আলোচনা হয়েছিল। তিনি বলেন, লিফটের বয়স ৭-৮ বছর হয়ে গেছে। লিফটের সার্ভিসিং ঠিক ছিল, লিফটম্যানও ছিল। কিন্তু এটা একটা দুর্ঘটনা।

রাজধানীর শান্তিনগর মোড়ে আমিন মোহাম্মদ ফাউন্ডেশনের আঠারো তলা ভবন। নাম গ্রিন পিস অ্যাপার্টমেন্ট (৪১ চামেলীবাগ, পপুলার ডায়াগনস্টিকের বিপরীতে)। এখানেই ১৫ তলায় শিপলুর রহমান ও উম্মে সালমা দম্পতি তাদের নয় বছর বয়সী মেয়ে উম্মে আলভিরা রহমানকে নিয়ে থাকতেন। আলিবাবা ডোরের স্বত্বাধিকারী মোহাম্মদ আলী শিশুটির দাদা।

আলভিরার পরিবার সূত্রে জানা যায়, বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে নয়টার দিকে বাবা-মায়ের সঙ্গে বাইরে যেতে ১৫ তলা থেকে লিফটে উঠছিল আলভিরা। শিশুটির হাত পরম স্নেহে ধরে রেখেছিলেন বাবা শিপলু। লিফটের সেন্সর কাজ না করায় এর মধ্যেই বন্ধ হয়ে যায় দরজাটি। আলভিরার এক হাত বা এক পা আটকে যায় এর মধ্যে। আবার এর মধ্যেই উঠতে শুরু করে লিফটটি। ছাদে ধাক্কা খেয়ে শিশুটির মাথা থেঁতলে যায়। এভাবেই ঝুলে থাকে শিশুটি। আলভিরার শরীরের গরম রক্ত ফিনকি দিয়ে পড়ে তার বাবা-মায়ের গায়ে।

১৫-২০ মিনিট আটকে থেকে ধীরে ধীরে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে আলভিরা। বাঁচানোর আশায় পরিবারের পক্ষ থেকে অ্যাপার্টমেন্টের অফিসে ফোন করলেও কেউ রিসিভ করেনি। পরে উদ্ধার করে রাজধানীর স্কয়ার হাসপাতালে নেয়া হলে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। উত্তরার ১২ নম্বর সেক্টরে আলভিরাকে সমাহিত করা হয়।

ভবনের ক্ষুব্ধ বাসিন্দারা বলছেন, লিফট ত্রুটিপূর্ণ থাকার পরও কোনো ব্যবস্থা নেয়নি ভবন পরিচালনা পর্ষদ। অ্যাপার্টমেন্টের বাসিন্দা মোশাররফ হোসেন বলেন, কখনও লিফটের বাটন কাজ করে না। কখনও সেন্সর কাজ করে না। হঠাৎ করে মাঝপথে আটকে যায়। তখন বের হওয়ার উপায়ও থাকে না। অন্যদিকে সেখানে মাঝে মধ্যেই লিফটম্যান থাকে না। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে লিফট ব্যবহার করতে হচ্ছে অ্যাপার্টমেন্টটির হাজারও বাসিন্দাকে। ঝুঁকিপূর্ণ একটি লিফট নিষ্পাপ শিশু আলভিরার প্রাণ কেড়ে নেয়ার পরও টনক নড়েনি অ্যাপার্টমেন্ট মালিকপক্ষের। রেজাউল করিম নামে অপর বাসিন্দা বলেন, প্রতি ইউনিট থেকে চার হাজার টাকার সার্ভিস চার্জ হিসেবে মাসে সাত লাখ টাকা সার্ভিস চার্জ উঠলেও লিফট রক্ষণাবেক্ষণের উদ্যোগ নেই। ভবনে নেই পর্যাপ্ত সিকিউরিটি গার্ড ও লিফটম্যান। লিফটম্যানকে দিয়ে কমিটির লোকজন নিজেদের বাজার করিয়ে নেয়। যে কারণে সময়মতো লিফটম্যানদেরও ডাকলে পাওয়া যায় না।

স্থপতি ও নগর পরিকল্পনাবিদরা বলছেন, বিদেশে আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে লিফট কিংবা চলন্ত সিঁড়ির নিয়মিত পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হলেও দেশে তা হচ্ছে না। কোনো সার্টিফিকেশন নেই। তদারকিও নেই। লিফটসংক্রান্ত খোঁজখবর রাখার যথোপযুক্ত প্রক্রিয়াও নেই। কে, কোথায়, কিভাবে দুর্ঘটনার শিকার হলেন তার কেউ খোঁজ রাখে না। লিফট দুর্ঘটনায় মৃত্যু অবহেলাজনিত হত্যাকাণ্ডের শামিল।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ১৮০টি ফ্ল্যাটের এ বিশাল এপার্টমেন্টে হাজারের বেশি মানুষের বসবাস। পাশপাশি তিনটি বিল্ডিংয়ের জন্য রয়েছে ছয়টি লিফট। তবে সব সময় চালু থাকে মাত্র একটি। আগে তিনজন লিফটম্যান কাজ করলেও এখন কাজ করছেন একজন।

আলভিরার চাচা পিয়াল জানান, আলভিরার মৃত্যু আমাদের টনক নড়িয়ে দিলেও ওদের (ভবন ব্যবস্থাপনা কমিটি) নড়াতে পারেনি। গত রাতে ওই ঘটনার পর একাধিকবার ফোন করেও কর্তৃপক্ষের সাড়া মেলেনি। তিনি বলেন, ওই ঘটনার পর রাত ৩টার দিকে ফের আটকে যায় আরেকটি লিফট। আমাদেরই আরেক আÍীয় আটকে থাকেন ১৫ মিনিট। লিফটের বাটন কাজ করছিল না। পরে বৈদ্যুতিক লাইন বন্ধ করে লিফট চেপে ধরে তাকে বের করে আনা হয়।

ভবন পরিচালনা পর্ষদের প্রধান আলমগীর মিয়া জানান, লিফটে ক্রটি থাকায় লিফটটি কাজ করছিল না। ঠিক কতদিন ধরে এ সমস্যা চলছিল তা জানি না। সেন্সর কেন কাজ করছিল না তা আমি খতিয়ে দেখছি।

পল্টন থানার উপ-পরিদর্শক রেজাউল করিম বলেন, বৃহস্পতিবার রাতে খবর পেয়ে শান্তিনগরে আমিন মোহাম্মদ ফাউন্ডেশনের গ্রিন পিস অ্যাপার্টমেন্টের ওই বাসায় ছুটে যাই। পরে শিশুটিকে উদ্ধার করে স্কয়ার হাসপাতালে পাঠানো হয়। কিন্তু চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। তিনি বলেন, নিহতের পরিবার মামলা করলে আমরা আইনি পদক্ষেপ নেব। প্রাথমিকভাবে আমরা জেনেছি, লিফটের ত্রুটির কারণেই ওই শিশু আঘাত পেয়ে মারা গেছে। অ্যাপার্টমেন্টের একাধিক বাসিন্দাও মৌখিকভাবে একই অভিযোগ করেছেন।

প্রকৌশলী ও নগর পরিকল্পনাবিদ ইকবাল হাবীব বলেন, পৃথিবীর যে কোনো সভ্য দেশে আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে লিফট কিংবা চলন্ত সিঁড়ি (এক্সেলেটর) নিয়মিত পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়। প্রতি বছর সার্টিফিকেশন করা হয়। লিখে রাখা হয় কোনটি কত তারিখে পরিদর্শিত হয়েছে। কবে কোনটি মেরামত কিংবা পরিবর্তন করতে হবে। কিন্তু বাংলাদেশে সেটি হচ্ছে না। তিনি বলেন, লিফট দুর্ঘটনা বাংলাদেশে নতুন কোনো ঘটনা নয়। টেলিভিশনের একটি অনুষ্ঠানে যোগ দিতে গিয়ে সরকারের দুই মন্ত্রী লিফটে আটকা পড়েছিলেন। এরপরেও আমাদের টনক নড়েনি। তিনি বলেন, ‘কোনো তদারকি নেই। লিফট সংক্রান্ত খোঁজখবর রাখার যথোপযুক্ত প্রক্রিয়াও নেই। কে কোথায় কিভাবে দুর্ঘটনার শিকার হলেন তা আমরা খোঁজ রাখি না। গরিব হলে তো কথাই নেই। এ ধরনের ঘটনাকে আমরা দুর্ঘটনা না বলে অবহেলাজনিত হত্যাকাণ্ড বলতে পারি’- বলেন তিনি।

ভালো লাগলে নিউজটি শেয়ার করুন

© All rights reserved © 2011 VisionBangla24.Com
Desing & Developed BY ThemesBazar.Com