বীমার সম্ভাবনাময় ব্যাংকাসুরেন্স ধ্বংস করছে গার্ডিয়ান লাইফ
বাংলাদেশের বীমা খাতে ব্যাংকাসুরেন্স একটি সম্ভাবনাময় নতুন দিগন্ত হিসেবে যাত্রা শুরু করেছিল। ব্যাংকের মাধ্যমে স্বল্প ব্যয়ে, স্বচ্ছতা বজায় রেখে ও পেশাদারিত্বের সঙ্গে বীমা পলিসি বিক্রির যে লক্ষ্য নিয়ে এ ব্যবস্থার সূচনা হয়েছিল- তা আজ মারাত্মকভাবে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে গার্ডিয়ান লাইফ ইন্স্যুরেন্সের অতি আগ্রাসী ও অনিয়মতান্ত্রিক কর্মকাণ্ডের কারণে। নীতিমালায় তিনটি ব্যাংকের সঙ্গে অংশীদারিত্ব, কমিশন সর্বোচ্চ ৩৫ শতাংশ এবং ব্যাংকের বাইরে কোনো ধরনের বাড়তি সুবিধা না দেওয়ার যে শর্ত স্পষ্ট করে দেওয়া আছে—গার্ডিয়ান লাইফ তা উপেক্ষা করছে বলেই অভিযোগ উঠেছে।
ব্যাংকিং সূত্রে জানা যায়, প্রতিষ্ঠানটি ব্যাংক কর্মকর্তাদের নির্ধারিত কমিশন ছাড়াও অতিরিক্ত ইনসেনটিভ, নগদ অর্থ, আইফোন, মোটরসাইকেল থেকে শুরু করে বিদেশ ভ্রমণের অফার পর্যন্ত দিয়েছে শুধুমাত্র তাদের পণ্য বিক্রির লক্ষ্যে। আরও উদ্বেগজনক বিষয় হলো—গার্ডিয়ান লাইফ তাদের নিজস্ব কর্মকর্তা ও সেলস স্টাফদের ব্যাংকের ভেতরে বসিয়ে পলিসি বিক্রির কাজ করছে- যা ব্যাংকাসুরেন্সের মূলনীতির পরিপন্থী।
খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ব্যাংকাসুরেন্সের কনসেপ্ট গ্রহণ করা হয়েছে ব্যাংকারদের মাধ্যমে বীমা বিক্রির জন্য। তারা গ্রাহকদের ব্যাংকিং সেবার পাশাপাশি বীমার প্রতি আগ্রহী করে তুলবেন। ব্যাংক এবং বীমা খাত এক সাথে এগিয়ে যাবে।
অথচ সম্ভাবনার এই নতুন দিগন্ত অতিরিক্ত লোভে ধ্বংস করছে গার্ডিয়ান লাইফ। ব্যাংকের শাখাগুলোতে গার্ডিয়ানের কর্মকর্তাদের দিয়ে বীমা ব্যবসা করায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ব্যাংকাসুরেন্সের মূলনীতি। এ ধরনের অনৈতিক প্রতিযোগিতা শুধু আর্থিক পরিবেশকে দূষিত করছে না, বরং ব্যাংকের স্বাভাবিক প্রশাসনিক কাঠামোতেও বিরুপ প্রভাব পরছে। এমনকি গার্ডিয়ানের দেয়া অতিরিক্ত সুযোগ-সুবিধার প্রলোভন ব্যাংকারদেরও লোভী করে তুলছে। এই অসম প্রতিযোগীতায় অন্য বীমা কোম্পানী জড়িয়ে পরলে হুমকীর মুখে পরবে পুরো বীমা খাত।
এই পরিস্থিতিতে নিয়ম মেনে চলা অন্য বীমা কোম্পানিগুলোও প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ছে। ব্যাংকের ভেতরে বীমা কোম্পানির স্টাফ বসানোর ফলে ব্যাংক কর্মকর্তাদের প্রয়োজনীয় দক্ষতা উন্নত হচ্ছে না, বরং ব্যাংকের কর্মপরিবেশে এক ধরনের অস্বচ্ছতা তৈরি হচ্ছে। গ্রাহকও বুঝতে পারছেন না, তিনি একটি নিরপেক্ষ পরামর্শ পাচ্ছেন, নাকি অতিরিক্ত সুবিধা প্রাপ্তির লোভে কোনো প্রতিষ্ঠানের পণ্য তাকে চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এতে ব্যাংকাসুরেন্স খাতে গ্রাহকের আস্থা মারাত্মকভাবে ক্ষুণ্ন হচ্ছে।
গার্ডিয়ান লাইফের বিরুদ্ধে ওঠা অনিয়ম শুধুমাত্র ব্যাংকাসুরেন্সেই সীমাবদ্ধ নয়। প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) নিয়োগেও বিধি লঙ্ঘনের প্রমাণ পাওয়ার পর নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইডিআরএ প্রতিষ্ঠানটিকে পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা করেছে। নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে বিধি অনুযায়ী নিয়োগ সম্পন্ন করতে। তবে আইডিআরএ’র একটি সূত্র জানায়, এ ধরনের জরিমানার টাকা কোম্পানির ব্যবস্থাপনা বা পরিচালনা পর্ষদ নয়, বরং গ্রাহকের টাকাই দিয়ে পরিশোধ করা হয়, ফলে শাস্তির কোনো বাস্তব প্রভাব তাদের ওপর পড়ে না। একইভাবে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হওয়ার বিষয়েও প্রতিষ্ঠানটি বছরের পর বছর আইন অমান্য করে যাচ্ছে। ২০১৪ সালে ব্যবসা শুরু করলেও এখনো তালিকাভুক্ত না হওয়ায় প্রতিদিন পাঁচ হাজার টাকা করে জরিমানা প্রাপ্য হিসেবে জমা হচ্ছে, যা ইতিমধ্যে কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। এখানেও শেষ পর্যন্ত ক্ষতির বোঝা গ্রাহকের ওপরই বর্তায়।
গার্ডিয়ান লাইফের পরিচালনা পর্ষদের বিরুদ্ধে কর্মী হয়রানি ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে আর্থিক ক্ষতিসাধনের অভিযোগ উঠেছে। একজন এরিয়া ম্যানেজারের ওপর অযৌক্তিক চাপ তৈরি, টার্গেট ছাড়া আর্থিক ক্ষতির সিদ্ধান্ত, এমনকি কিছু লিগ্যাল নোটিশকে মিথ্যা ও বিভ্রান্তিকর হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। অভিযোগ আছে, আইডিআরএ কিছু ক্ষেত্রে ছোট কোম্পানির ওপর কঠোর হলেও গার্ডিয়ান লাইফের প্রতি রহস্যজনকভাবে নমনীয় থেকেছে, যা “অনিয়মই নিয়ম”—এ ধারণাকে শক্তিশালী করছে।
উল্লেখ্য, প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) নিয়োগে অনিয়ম করায় জীবন বিমা কোম্পানি গার্ডিয়ান লাইফ ইন্স্যুরেন্সকে পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা করেছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ)। একই সঙ্গে ৬০ দিনের মধ্যে সিইও নিয়োগ দিতে কোম্পানিটিকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
প্রায় চার বছর ধরে সিইও নিয়োগ না দিয়ে বিমা কোম্পানিটি বিমা আইন-২০১০ এর ৮০ ধারা লঙ্ঘন করায় সম্প্রতি এ জারিমনা করা হয়েছে। এ সংক্রান্ত একটি চিঠি গার্ডিয়ান লাইফের চেয়ারম্যানকে পাঠানো হয়েছে।
চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে, ২০২১ সালের ১ জানুয়ারি থেকে প্রায় চার বছর ধরে গার্ডিয়ান লাইফে সিইও নিয়োগ দেওয়া হয়নি। এতে বিমা আইন-২০১০ এর ৮০ ধারা লঙ্ঘন করায় বিমা আইন-২০১০ এর ১৩০(খ) ধারা মোতাবেক কর্তৃপক্ষের (আইডিআরএ) ১৭৮তম সভায় পাঁচ লাখ টাকা জারিমানা সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
জরিমানার পাশাপাশি আগামী ৬০ দিনের মধ্যে কোম্পানিটিতে প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা নিয়োগ দিতে হবে। ৬০ দিনের মধ্যে নিয়োগ করা না হলে কোম্পানিকে আবারও পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা করা হবে- বলে চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, অনুমোদনহীন সিইওর বেপরোয়া কর্মকান্ড আর গার্ডিয়ান লাইফের অনিয়মতান্ত্রিক আগ্রাসী কৌশল অব্যাহত থাকলে ব্যাংকাসুরেন্সের মতো সম্ভাবনাময় একটি ধারণা নৈতিকতার সংকটে পড়ে বাংলাদেশে ব্যর্থ হয়ে যেতে পারে, ঠিক যেমন নন-লাইফ বীমা খাত বহু বছর ধরে গ্রাহকের আস্থা হারিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এখনই বাংলাদেশ ব্যাংক ও আইডিআরএকে কড়া পদক্ষেপ নিতে বলা হয়েছে—প্রয়োজন হলে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। কারণ নিয়ন্ত্রণে শৃঙ্খলা না ফিরলে ব্যাংকাসুরেন্সের উন্নয়ন তো দূরের কথা, এর অস্তিত্বই ঝুঁকির মুখে পড়বে।
বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ)-এর এক কর্মকর্তা বলেন, বীমা খাতে কোনো ধরনের অনিয়ম বরদাশত করা হবে না এবং সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এসব অভিযোগের ব্যাপারে গার্ডিয়ান লাইফ ইন্স্যুরেন্সের চেয়ারম্যানকে ফোন করা হলে পাওয়া যায় নি।
সিইও (চলতি দায়িত্ব) শেখ রাকিবুল করিম বলেন, আমরা আইডিআরএ’র নির্ধারিত ব্যায়সীমার মধ্যেই ব্যবসা করে আসছি। ব্যাংকাসুরেন্সের জন্য দেয়া বিভিন্ন অবৈধ অতিরিক্ত সুযোগ-সুবিধা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, সবকিছুই আমরা নিয়মের মধ্যেই করছি। আর এভাবে ধরা হলে অনেক কোম্পানিই আটকে যাবে। সিইও হিসেবে দীর্ঘদিন চলতি দায়িত্বে থাকা প্রসঙ্গে তার মন্তব্য হলো, আমিও চাই বিষয়টি দ্রুত সমাধান হোক। এটি আমার কর্মজীবনের জন্য চরম বিব্রতকর। প্রতিষ্ঠানটি পুঁজিবাজারে না-আসার ব্যাপারে তিনি করোনাকালীক সঙ্কট ও ব্যবসায়ীক ক্ষতির বিষয়টি তুলে ধরেন।