স্টাফ রিপোর্টারঃ দেশে মাদকের বিরুদ্ধে কঠোর অভিযান অত্যন্ত কার্যকরভাবে চললেও মাদকাসক্তদের শনাক্ত করে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের কার্যক্রমে গতি নেই। ডোপ টেস্ট বা পরীক্ষা পুরোপুরি চালু না করায় সরকারি চাকরি ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন পেশায় থাকা মাদকাসক্তরা শনাক্ত হচ্ছে না। মাদকাসক্তরা সহজে চাকরিতেও ঢুকে পড়ছে। যদিও নতুন মাদক নিয়ন্ত্রণ আইনে সন্দেহভাজন সবাইকে ডোপ টেস্ট করা যাবে—এমন বিধান করা হয়েছে। সরকারি চাকরিতে নিয়োগের সময় ডোপ টেস্ট বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। কিন্তু এসব বাস্তবায়নের উদ্যোগ চলছে ঢিমেতালে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার ক্ষেত্রে এতো দিন ডোপ টেস্ট চালু করা না হলেও এবার সরকারি চাকরিতে প্রবেশের আদলে বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ ভর্তিতেও ডোপ টেস্টের ব্যাপারে আসছে কঠোর নির্দেশনা।
এরই মধ্যে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এ সংক্রান্ত পদক্ষেপও গ্রহণ করেছে। সরকারি চাকরিতে কীভাবে মাদকাসক্তদের চিহ্নিত করা হচ্ছে, ঠিক সেভাবেই বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তির ক্ষেত্রেও চিহ্নিত করতে সতর্ক অবস্থানে রয়েছে সরকার। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কীভাবে ডোপ টেস্ট করা হবে সেই বিধিমালার খসড়া তৈরির কাজ চলছে।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ডোপ টেস্টের পদক্ষেপ নেওয়া হলে পরিবার এ ব্যাপারে সতর্ক হবেন বলে মনে করেন সমাজবিজ্ঞানীরা। তাদের মতে, মাদকাসক্তদের চাকরিতে নিয়োগ, বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি, গাড়ি চালনার লাইসেন্সসহ বিভিন্ন সুবিধা থেকে বাদ দিয়ে আইনের আওতায় আনা হলে মাদকের প্রতি সবার ভয় জন্ম নেবে। এতে মাদকের চাহিদাও কমবে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, মাদকের বিরুদ্ধে প্রতিরোধে গড়ে তুলতে অভিযানের মাধ্যমে জোগান কমাতে হবে। একই সঙ্গে চাহিদা ও ঝুঁকি না কমানো গেলে ভালো ফল আসবে না। আর এ লক্ষ্যে মাদকাসক্তদের শনাক্ত করতে হবে। মাদকাসক্তদের চাকরিতে নিয়োগ, বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি, গাড়ি চালনার লাইসেন্স—এ রকম বিভিন্ন সুবিধা থেকে বাদ দিয়ে আইনের আওতায় আনা হলে মাদকের প্রতি সবার ভয় জন্ম নেবে। এতে মাদকের চাহিদাও কমবে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগের সচিব ফরিদ উদ্দিন আহম্মদ চৌধুরী জানান, শিক্ষার্থীরা একেক পরিবার থেকে আসেন। এদের কেউ মাদকাসক্ত অবস্থায় ভর্তি হওয়ার পর তাদের সংস্পর্শে গিয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অন্য সবাই নষ্ট হয়ে যায়।
গত ৫ ডিসেম্বর সব শ্রেণির সরকারি চাকরিতে প্রবেশের সময় ‘ডোপ টেস্ট’ বাধ্যতামূলক করে স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিচালক (প্রশাসন) ডা. আবুল কালাম আজাদ স্বাক্ষরিত একটি পরিপত্র জারি করা হয়। এতে বলা হয়, সব শ্রেণির সরকারি চাকরিতে প্রবেশের সময় বিদ্যমান অন্যান্য ব্যবস্থার সঙ্গে ডোপ টেস্ট অন্তর্ভুক্ত করে এবং প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরীক্ষা শেষে প্রতিবেদন পরিচালকের (হাসপাতাল ও ক্লিনিকসমূহ) কাছে পাঠাতে হবে।
জানা গেছে, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি ও ড্রাইভিং লাইসেন্স দেওয়ার সময় ডোপ টেস্টের জন্য মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের (ডিএনসি) সক্ষমতা বাড়ানোর প্রকল্প অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে। এর আগে তারা গত বছরের অক্টোবর পর্যন্ত অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে। এর আগে তারা গত বছরের অক্টোবর পর্যন্ত সারা দেশের ২৮ হাজার ১৪২টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মাদকবিরোধী কমিটি করে। এসব প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, ইংরেজি মাধ্যমের বিদ্যালয়গুলোকে গুরুত্ব দিয়ে ডোপ টেস্ট বাস্তবায়ন করতে চায় সংস্থাটি। পরীক্ষায় কারও শরীরে মাদকের উপস্থিতি পেলে বাধ্যতামূলক ওই শিক্ষার্থীকে মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রে ছয় মাসের চিকিৎসার জন্য পাঠানোর পরিকল্পনা নিয়েছে।
একই সঙ্গে চালকদের ডোপ টেস্টের বিষয়ে পুলিশকে সরঞ্জাম সরবরাহের পরামর্শ দিয়েছে। কারণ পুলিশই সব সময় রাস্তায় চেকপোস্ট পরিচালনা করে। এ ছাড়া পুলিশ ও ডিএনসিসহ কয়েকটি সংস্থায় নিয়োগের ক্ষেত্রে ডোপ টেস্ট সীমিতভাবে কার্যকর হলেও শনাক্ত ব্যক্তিদের আইন অনুযায়ী নিরাময়কেন্দ্র কিংবা জেলে পাঠানো হচ্ছে না। পুলিশ, জনপ্রশাসন, স্বাস্থ্য খাত এমনকি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কর্মচারী-কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে মাদক গ্রহণের অভিযোগ ওঠার পরই কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। এরই অংশ হিসেবে গত ২৫ ডিসেম্বর কার্যকর করা হয় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন-২০১৮।
এ আইনের ২৪-এর উপধারা ৪-এ বলা হয়েছে, মাদকাসক্ত ব্যক্তি শনাক্ত করবার প্রয়োজনে বিধি দ্বারা নির্ধারিত পদ্ধতিতে ডোপ টেস্ট করা যাবে। ডোপ টেস্ট পজিটিভ হলে ধারা ৩৬(৪) অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাবে। ৩৬ ধারার ৪ উপধারায় বলা আছে যে- অভিযুক্ত ব্যক্তিকে মাদক সেবনের জন্য আদালত তাকে যে কোনো মাদকাসক্ত চিকিৎসা কেন্দ্রে তার নিজস্ব অথবা পরিবারের ব্যয়ে চিকিৎসার জন্য পাঠাবেন। যদি ওই ব্যক্তি নিরাময় কেন্দ্রে যেতে না চান তাহলে ছয় মাস থেকে সর্বোচ্চ ৫ বছর কারাদণ্ডের কথাও উল্লেখ করা হয়েছে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, দেশে বর্তমানে মাদকাসক্ত ব্যক্তির সংখ্যা প্রায় ৭০ লাখ। বিভিন্ন উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বিপুলসংখ্যক ছাত্রছাত্রী মাদকাসক্ত হয়ে পড়েছেন।
এ বিষয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেন, সরকারি চাকরিতে প্রবেশের সময় ডোপ টেস্টের বিষয়টি কার্যকর করা হয়েছে। এটি সিভিল সার্জনরা মনিটরিং করছেন। আর বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ ভর্তির ক্ষেত্রে পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে, শিগগির তা বাস্তবায়ন করা হবে।
বিভিন্ন পেশাজীবীদের মধ্যেও মাদক ব্যবহারকারীর সংখ্যা বাড়ছে। এতে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের শৃঙ্খলা বিঘ্ন হচ্ছে ও কাজের সুষ্ঠু পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে।
পুলিশ সদর দপ্তর সূত্র জানায়, মাদক ব্যবসায় ও মাদক সেবনের অভিযোগে ২০১৭ সাল থেকে পুলিশের শতাধিক সদস্যের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। কনস্টেবল থেকে শুরু করে পুলিশ পরিদর্শক পদের সদস্যরাই মাদক ব্যবসা এবং মাদক সেবনের সঙ্গে জড়িত। এ ছাড়া এএসপি থেকে শুরু করে ঊর্ধ্বতন পর্যায়েও কিছু কিছু কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মাদক সেবন, মাদক ব্যবসায় সহায়তা এবং মাদক ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে অর্থ নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে।
বিভিন্ন দেশে স্কুলে ড্রাগ টেস্টিং উদ্দেশ্য শাস্তি নয়
ভবিষ্যৎ প্রজন্ম মাদকের ছোবলে ধ্বংস হোক, তা কেউ চায় না। তাই কিশোর বয়স থেকেই তাদের ওপর নজর রাখার চর্চা রয়েছে বিভিন্ন দেশে। স্কুল-কলেজভিত্তিক মাদকাসক্তি পরীক্ষার ব্যবস্থা রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের দেশগুলোতে। দৈবচয়নের ভিত্তিতে এ পরীক্ষা চালানো হয়। তবে শিক্ষার্থীদের শাস্তি দেওয়া বা বহিষ্কার করা এ ধরনের পরীক্ষার উদ্দেশ্য নয়। কিশোর বয়সে মাদকে আসক্তির ঝুঁকি কমানো, সতর্কতা বাড়ানো এবং আসক্তি শনাক্ত হলে সংশোধনের মাধ্যমে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যেই এই ব্যবস্থা রয়েছে।
ফিলিপাইনে শিক্ষার্থীদের মাদকাসক্তি পরীক্ষা হয় দৈবচয়নের ভিত্তিতে। সে দেশে ২০০৫ সালে প্রতি ১৭টি স্কুল থেকে ৩০ জনকে নিয়ে মোট ২৯ হাজার শিক্ষার্থীকে পরীক্ষা করে ৭২ জনের (১ শতাংশের কম) নমুনায় মাদকের উপস্থিতি পাওয়া যায়। মাদকের বিস্তার রোধে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট তাগিদ দেওয়ার পর সে দেশেও পরীক্ষামূলকভাবে স্কুলভিত্তিক মাদকাসক্তি নির্ণয়ের কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশনের হিসাবে দেশটির ২৫ শতাংশ মিডল ও হাই স্কুল ডিস্ট্রিক্টে র্যানডম স্কুল ড্রাগ টেস্টিং (আরএসডিটি) নীতিমালা আছে। অ্যাথলেট বা এ রকম বিশেষ দলভুক্ত শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে এ হার ৫৬ শতাংশ। ২০০৪ সালে যুক্তরাজ্যে এবং ২০০৮ সালে সুইডেনের কয়েকটি বেসরকারি স্কুল নিজেদের উদ্যোগে শিক্ষার্থীদের ড্রাগ টেস্টিং শুরু করে। এখন এই দুই দেশ ছাড়াও বেলজিয়াম, হাঙ্গেরি, ফিনল্যান্ড, নরওয়ে, চেক রিপাবলিকে নিয়মিত স্কুলভিত্তিক মাদক পরীক্ষা করা হয় বলে যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব হেলথের এক গবেষণায় উল্লেখ করা হয়েছে।
অস্ট্রেলিয়ার দু-একটি স্কুলে এ রকম উদ্যোগ নেওয়া হলেও দেশটির মাদক নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ মতামত জানায়, স্কুল পর্যায়ে ড্রাগ টেস্টিং দরকার নেই। স্কুলে এ ধরনের মাদক পরীক্ষার পক্ষে-বিপক্ষে মতামত যুক্তরাষ্ট্রেও আছে। তবু গবেষকরা বলেছেন, মাদকের অপব্যবহারের বিস্তৃতি রোধে স্কুলে নিয়মিত এ ধরনের পরীক্ষা প্রয়োজন।