রবিবার, ১৩ এপ্রিল ২০২৫, ০৩:৩৭ পূর্বাহ্ন
ফালু মিয়া বিশেষ প্রতিনিধি:
নরসিংদী, ৮ এপ্রিল ২০২৫: ভোক্তা অধিকারের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে ও ভেজাল প্রতিরোধে জেলা প্রশাসন, নরসিংদী এবং বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশন (বিএসটিআই) আঞ্চলিক অফিস, নরসিংদীর যৌথ উদ্যোগে পরিচালিত মোবাইল কোর্ট অভিযানে দুটি বেকারি প্রতিষ্ঠানকে ‘ওজন ও পরিমাপ মানদণ্ড আইন, ২০১৮’ লঙ্ঘনের দায়ে জরিমানা করা হয়েছে। জেলার সদর উপজেলার বড়বাজার ও কান্দাপাড়া এলাকায় পরিচালিত এই অভিযান জনস্বার্থে একটি উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
মোবাইল কোর্টের পটভূমি
বাংলাদেশে ওজন ও পরিমাপ সংক্রান্ত অনিয়ম অনেকদিন ধরেই জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি হিসেবে দেখা দিচ্ছে। অপরিকল্পিতভাবে এবং সরকার নির্ধারিত মানদণ্ড না মেনে খাদ্যপণ্য উৎপাদন, মোড়কজাতকরণ ও বাজারজাতকরণের ফলে প্রতারিত হচ্ছেন সাধারণ ভোক্তারা। এসব অনিয়ম প্রতিরোধে সরকার মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে নিয়মিতভাবে অভিযান পরিচালনা করে আসছে।
তারই ধারাবাহিকতায়, ৮ এপ্রিল ২০২৫ খ্রিঃ তারিখে জেলা প্রশাসন ও বিএসটিআই’র যৌথ টিম নরসিংদীর সদর উপজেলার বড়বাজার ও পূর্ব কান্দাপাড়া এলাকায় অভিযান পরিচালনা করে। অভিযানে নেতৃত্ব দেন জেলা প্রশাসনের সহকারী কমিশনার ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট জনাবা আসমাউল হুসনা পিংকি। প্রসিকিউটর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন বিএসটিআই আঞ্চলিক অফিস, নরসিংদীর পরিদর্শক (মেট) মো: আরিফ হোসেন আসিফ।
প্রথম প্রতিষ্ঠান: জনতা বেকারী অ্যান্ড কনফেকশনারী
মোবাইল কোর্ট প্রথমে অভিযান চালায় ‘মেসার্স জনতা বেকারী অ্যান্ড কনফেকশনারী’ নামক একটি বেকারি প্রতিষ্ঠানে, যার ঠিকানা ৯৫/১, সিএনবি রোড, বাজার, সদর, নরসিংদী। বিএসটিআই-এর তদন্তে দেখা যায়, প্রতিষ্ঠানটি কোনও ধরনের পণ্য মোড়কজাত সনদ গ্রহণ না করেই বাজারে বিস্কুট, পাউরুটি ও কেক প্রস্তুত এবং বাজারজাত করে আসছিল।
পণ্যের মোড়কে নির্ধারিত ওজন ও পরিমাপ, উৎপাদনের তারিখ, মেয়াদ, প্রস্তুতকারকের নাম ও সনদ নম্বর উল্লেখ না থাকায় এটি ‘ওজন ও পরিমাপ মানদণ্ড আইন, ২০১৮’ এর স্পষ্ট লঙ্ঘন। প্রাথমিকভাবে প্রতিষ্ঠানটির মালিক পিন্টু কুমার সাহার বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয় এবং তাকে তাৎক্ষণিকভাবে মোবাইল কোর্টে তলব করা হয়।
অপরাধ স্বীকার এবং বিচারিক নিষ্পত্তি
অভিযুক্ত ব্যক্তি পিন্টু কুমার সাহা অভিযোগ স্বীকার করে বলেন, তিনি বিষয়টি জানতেন না এবং ভবিষ্যতে এমন কাজ আর করবেন না। আদালতে দুঃখ প্রকাশ করে ক্ষমা প্রার্থনা করলে, বিজ্ঞ নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট জনাবা আসমাউল হুসনা পিংকি আইনানুযায়ী তাকে ‘ওজন ও পরিমাপ মানদণ্ড আইন, ২০১৮’-এর ২৪/৪১ ধারায় ৫,০০০ (পাঁচ হাজার) টাকা অর্থদণ্ড প্রদান করেন। সেই সঙ্গে জরিমানার অর্থ আদায় সাপেক্ষে মামলাটি নিষ্পত্তি করা হয়।
দ্বিতীয় প্রতিষ্ঠান: হাজী ফুড প্রোডাক্টস
পরবর্তী পর্যায়ে মোবাইল কোর্ট অভিযান পরিচালনা করে ‘মেসার্স হাজী ফুড প্রোডাক্টস’ নামক আরেকটি প্রতিষ্ঠানে, যার অবস্থান ১/১, পূর্ব কান্দাপাড়া, বাজার, সদর, নরসিংদী। এখানেও একই ধরনের অপরাধ পরিলক্ষিত হয়। প্রতিষ্ঠানটি বিস্কুট, পাউরুটি ও কেক প্রস্তুত এবং বাজারজাত করলেও কোনো ধরনের মোড়কজাত সনদ গ্রহণ করেনি।
বিএসটিআই-এর নিয়ম অনুযায়ী, খাদ্যপণ্য বাজারজাত করার পূর্বে নির্দিষ্ট ফরম্যাটে মোড়ক ব্যবহার বাধ্যতামূলক, যাতে পণ্যের বিশদ বিবরণ থাকে এবং ভোক্তা তা যাচাই করতে পারে। কিন্তু হাজী ফুড প্রোডাক্টস সেই নিয়মকে সম্পূর্ণরূপে উপেক্ষা করে ব্যবসা পরিচালনা করে আসছিল। প্রতিষ্ঠানটির মালিক ইসহাক সরকারকেও অভিযোগের ভিত্তিতে আদালতে হাজির করা হয়।
স্বীকারোক্তি ও দণ্ডাদেশ
মোবাইল কোর্টে অভিযুক্ত ইসহাক সরকারও অপরাধ স্বীকার করে ক্ষমা চান। তিনি বলেন, ব্যবসার চাপ ও নিয়ম না জানার কারণে এমনটি হয়েছে এবং ভবিষ্যতে তিনি বিএসটিআই-এর সকল নিয়ম অনুসরণ করবেন। নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট জনাবা আসমাউল হুসনা পিংকি তাকেও ‘ওজন ও পরিমাপ মানদণ্ড আইন, ২০১৮’-এর ২৪/৪১ ধারায় ৫,০০০ টাকা অর্থদণ্ড প্রদান করেন এবং জরিমানার অর্থ আদায় করে মামলা নিষ্পত্তি করেন।
বিএসটিআই ও প্রশাসনের ভূমিকা
উক্ত মোবাইল কোর্টে প্রসিকিউটর হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বিএসটিআই-এর পরিদর্শক মো: আরিফ হোসেন আসিফ, যিনি অভিযানের পূর্ব প্রস্তুতি এবং অপরাধ উদঘাটনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তিনি বলেন, “পণ্যের গুণগত মান এবং সঠিক পরিমাপ নিশ্চিত করার মাধ্যমে আমরা সাধারণ ভোক্তার অধিকার রক্ষা করতে চাই। যারা নিয়ম মেনে ব্যবসা করছেন না, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে।”
অভিযান শেষে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট জানান, “ভোক্তা অধিকার ও জনস্বাস্থ্যের কথা বিবেচনায় রেখে আমরা নিয়মিতভাবে এমন অভিযান পরিচালনা করছি এবং করবো। সাধারণ মানুষ যাতে প্রতারিত না হন, সেদিকে খেয়াল রেখেই প্রশাসনের এই কার্যক্রম।”
জনসচেতনতা বাড়াতে আহ্বান
এ ধরনের মোবাইল কোর্ট পরিচালনার অন্যতম উদ্দেশ্য শুধু আইন প্রয়োগ নয়, বরং জনসচেতনতা সৃষ্টি করা। যাতে ব্যবসায়ীরা নিজেরাই আইন সম্পর্কে সচেতন হন এবং আইন মেনে ব্যবসা পরিচালনা করেন। প্রশাসন ও বিএসটিআই একযোগে কাজ করে যাচ্ছেন যাতে সাধারণ ভোক্তা নিরাপদ, সঠিক ও নির্ভরযোগ্য পণ্য পান।
একই সঙ্গে ব্যবসায়ীদের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে, যেন তারা উৎপাদনের পূর্বেই প্রয়োজনীয় লাইসেন্স, অনুমোদন ও সনদ গ্রহণ করেন এবং পণ্যের গায়ে স্পষ্টভাবে সব তথ্য লিপিবদ্ধ করেন।
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
বিএসটিআই ও জেলা প্রশাসনের যৌথ উদ্যোগে আগামীতে আরও অভিযান পরিচালনার পরিকল্পনা রয়েছে। বিশেষ করে খাদ্য, ওষুধ ও ভোগ্যপণ্যের ক্ষেত্রে যারা ভেজাল ও অননুমোদিত উপায়ে পণ্য বাজারজাত করছে, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের কথা জানানো হয়েছে।
প্রশাসনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, নিয়মিত নজরদারির মাধ্যমে অনিয়ম রোধ করা হবে এবং জনস্বার্থে পরিচালিত এই কার্যক্রমে কোনো ধরনের আপস করা হবে না।
নরসিংদীর এই মোবাইল কোর্ট অভিযান শুধু দুটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণেই সীমাবদ্ধ ছিল না; এটি একটি বড় বার্তা দিয়েছে—যারা আইন উপেক্ষা করে ব্যবসা পরিচালনা করছেন, তাদের জন্য এটাই সতর্কবার্তা। প্রশাসন এবং বিএসটিআই’র এই উদ্যোগ প্রশংসনীয় এবং ভবিষ্যতে দেশের অন্যান্য স্থানে এ ধরনের অভিযান বাড়ানোর মাধ্যমে একটি সুসংগঠিত ও নিয়মতান্ত্রিক বাজার ব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব হবে বলে মনে করেন সচেতন নাগরিকরা।