শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ১০:৩০ পূর্বাহ্ন
‘বুকের ভিতর বয়ে চলে পাহাড় নামের নদী।’ আর সেই নদীতেই আপাতত ‘ডুব’ দিয়েছেন ভারত, বাংলাদেশ ও অস্ট্রেলিয়ার মানুষজন। আর সেই নদীতে ‘ডুব’ দিতে দর্শককে যিনি নিয়ে যাচ্ছেন তিনি পরিচালক মোস্তফা সরওয়ার ফারুকি। ‘ডুব’ নিয়ে চলা দীর্ঘ দিনের সমস্যা, হুমায়ুন আহমেদ বিতর্ক, ফিকশন-ফ্যাক্টের ফারাক, মুক্তির পর দর্শকের প্রতিক্রিয়া, সব কিছু নিয়েই নির্ভেজাল আড্ডা দিলেন আমাদের সঙ্গে।
একটা সময় ছিল যখন আপনি ছিলেন বাতিলের খাতায়। ‘ডুব’ আজ ভারত, বাংলাদেশের এতগুলো হলে মুক্তি পেয়েছে। অস্ট্রেলিয়াতেও মুক্তি পেয়েছে। কিছু দিনের মধ্যে আমেরিকা, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, ফ্রান্সেও মুক্তি পাবে। কেমন লাগছে?
ফারুকি- শুধু একটা সময় নয়, আমার প্রথম ছবি ‘ব্যাচেলর’ থেকে এখনও অবধি দেখেছি ছবি রিলিজের সময় বাংলাদেশ দু’ভাগে ভাগ হয়ে যায়। এর কারণ, প্রায় প্রত্যেক ছবিতেই আমি নিজেকে নতুন নতুন চ্যালেঞ্জের মুখে ছুড়ে দিই। ফলে প্রত্যেকটা ছবিই দর্শকের কাছে একটা আলাদা জার্নি হয়ে দাঁড়ায়। এক দল মানুষ যাঁরা পুরনো থার্মোমিটারে আমাকে মাপতে চান, তাঁরা এর বিপক্ষে বলতে শুরু করেন। আরেক দল, যাঁরা সব সময়েই নতুন রাস্তার যাত্রী হতে চায়, তাঁরা এর পক্ষে বলতে শুরু করেন। আর এই পক্ষে-বিপক্ষে আলোচনার মধ্যে দিয়ে বাংলাদেশ-এর সিনেমা নতুন বাঁকে এগোতে থাকে। এই ভাবে এগোতে থাকলে আশা করছি, আগামী ৫-১০ বছরে বাংলাদেশের সিনেমা একটা নিউ ওয়েভের জন্ম দিতে পারবে। তবে এটা তখনই সম্ভব, যদি আমরা নির্দিষ্ট ফর্মুলার বাইরে ছবি বানানোয় বিশ্বাস করি। কারণ, কবিতা আর উপন্যাসের ক্ষেত্রে কেউ নির্দিষ্ট ছাঁচ বলে দিতে পারে না। তা হলে সিনেমা কেন শুধুই মেনস্ট্রিমের চেনা গণ্ডির মধ্যে আবদ্ধ থাকবে? আর এতগুলো সিনেমা হলে ‘ডুব’ দেখা যাবে সেটা খুবই আনন্দের বিষয়। কিন্তু আমার কাছে আমার কটা ছবি হলে মুক্তি পেল বা কতটা টাকা পেলাম, সেটা খুব একটা বড় কিছু নয়। বরং একজন চলচ্চিত্রকার হিসেবে আমার কণ্ঠে আর কি কি সুর বাজতে পারে, সেটা খুঁজে বের করাটা আরও আনন্দের।
‘থার্ড পার্সন সিঙ্গুলার নম্বর’-এর পর ‘ব্র্যান্ড ফারুকি’র জন্ম হয়েছে। ‘পিঁপড়াবিদ্যা’, ‘টেলিভিশন’-ও গ্লোবাল দর্শক খুঁজে পেয়েছে। ‘ডুব’ এর পর কি এই পরিধিটা আরও বিস্তৃত হল?
ফারুকি- জানি না আমি ব্র্যান্ড কি না। তবে এটুকু বলতে পারি, ফারুকির ছবি দেখলে একটা সিগ্নেচার মার্কের টের পাওয়া যায়। আরও নানান ঢঙের ছবির মধ্যে দিয়ে, নানান ঘরানার ছবির মধ্যে এই সিগ্নেচারটাকে নিয়েই একটা ভাঙা-গড়ার খেলা খেলতে চাই। এটা সত্যি যে ‘থার্ড পার্সন সিঙ্গুলার নম্বর’ আমাকে আন্তর্জাতিক স্তরে একটা জায়গা তৈরি করে দিয়েছে। ছবিটা নিয়ে প্রচুর বিতর্কও হয়। কিন্তু ‘টেলিভিশন’ আমাকে ফেস্টিভ্যাল সার্কিটে একটা আলাদা পরিচিতি দেয়। ‘পিঁপড়াবিদ্যা’ও অনেক ফেস্টিভ্যাল ঘুরেছে। ‘ডুব’ও দক্ষিণ এশিয়ার ছবি হিসেবে ফেস্টিভ্যাল সার্কিটে প্রচুর প্রশংসিত হয়েছে। সে দিক থেকে আমার দর্শক তো বেড়েছে বলব।
‘ডুব: নো বেড রোসেস’ নির্মাণের সময় যাত্রাপথটা কি গোলাপে বিছানো ছিল?
ফারুকি- এক্কেবারেই না। ছবিটা আমি যখন থেকে কনসিভ করি, তখন থেকেই এটা ছিল আমার কাছে একটা বিরাট চ্যালেঞ্জ। প্রথম চ্যালেঞ্জ ছিল যেখান থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে গল্পটা আমি ভেবেছি, সেখানে একটা পুরোদস্তুর নাটকীয় মুহূর্তের আভাস ছিল। ছবিতে জাভেদ হাসানের যখন প্রথম পরিবারের সঙ্গে বিচ্ছেদ হয়, সকলে তখন পাহাড়ের মতো স্থবির হয়ে যায়। তাঁদের জীবনের দিকে তাকালে আমি যেন শুধুই নৈঃশব্দ দেখি। এই নৈঃশব্দের মধ্যে এক অদ্ভুত কাব্যিক ব্যাপার আছে। তাই প্রথম থেকেই আমি জানতাম যে আমার অন্যান্য ছবির মতো এই ছবিটা প্রোজেইক হবে না, একই সঙ্গে অন্যান্য ছবির মতো সঙ্ঘাতও থাকবে না। এটা অনেক বেশি গোপন অনুভূতির কথা বলবে, বলবে অনেক অসহায় মুহূর্তের কথা।
দ্বিতীয় চ্যালেঞ্জ ছিল, ছবিটা তৈরির পর এই যে বিতর্ক, এই যে রিলিজ না হতে দেওয়ার একটা প্রচেষ্টা, ফিকশন না ফ্যাক্ট— এই নিয়ে বিস্তর আলোচনা, এগুলো আমার কাছে এক সময় পীড়াদায়ক ঠেকছিল। তাই ছবিটি নির্মাণের সময় আমরা গোলাপে বিছানো পথ যে পাইনি, তা বোঝাই যায়।
‘ডুব’ যে আবার আপনার প্রিয় পরিচালক আন্দ্রেই তারকভস্কির দেশে ঘুরে পুরস্কার নিয়ে এল, সেও তো এক বিশাল প্রাপ্তি।
ফারুকি- হ্যাঁ। ‘ডুব’ তারকভস্কির দেশ মস্কোতে ‘কমারজ্যান্ট জুরি’ পুরস্কার জিতে এসেছে। এর থেকেও বড় মাপের পুরস্কার আমি পেয়েছি। কিন্তু আমার প্রিয় পরিচালক, যাঁকে এক সময় অনুপ্রেরণা হিসেবে মেনেছি, তাঁর দেশ থেকে একটা পুরস্কার জেতা অবশ্যই স্পেশাল।
এই যে ‘ডুব’ নিয়ে এতদিনের একটা যুদ্ধাবস্থার মধ্যে দিয়ে যেতে হল, এটা কি আপনাকে কোণঠাসা করে দেওয়ার একটা ফন্দি?
ফারুকি- এর পিছনে একটা বিরাট প্রোপাগান্ডা কাজ করছে। কিন্তু আমি এখন আর পিছন ফিরে তাকাতে চাই না। এই নিয়ে কথাও বলতে চাই না। এখন শুধুই কবিতাটার দিকে তাকাতে চাই। আর দর্শকের প্রতিক্রিয়া জানতে চাই, রিভিউ পড়তে চাই। আর বার বার ওই নৈশঃব্দটাকে অনুভব করতে চাই।
ইরফানের সঙ্গে যে দিন মুম্বইতে দেখা করতে গেলেন, সে দিনের অভিজ্ঞতা কেমন ছিল?
ফারুকি- ইরফানের সঙ্গে আমার পরিচয় ছিল না। কিন্তু জাভেদ হাসানের চরিত্রটা তৈরি করার সময় ওঁর মধ্যে ইরফানের চোখ দুটো দেখতে পাচ্ছিলাম। আমার মুম্বইয়ের এক পরিচালক বন্ধু অনুপ সিংহ ইরফানের সঙ্গে কাজ করেছেন। আমি অনুপ দা’কে একটা ইমেল করি। বেশ কিছু দিন কেটে যায়, কোনও উত্তর আসে না। আমি দিশেহারা হয়ে অন্য অভিনেতাদের খোঁজে নেমে পড়ি। দিন পনেরো পর হঠাৎই অনুপদা উত্তর দেয়। অনুপদা বলেন, “আমি ইরফানকে তোমার কথা বলেছি। ইরফান তোমার ছবিও দেখে ফেলেছে। ওঁকে দ্রুত তোমার স্ক্রিপ্ট পাঠাও।” ইরফানকে স্ক্রিপ্ট পাঠানোর পর উনি আমাকে মুম্বইতে ডাকেন। মুম্বইতে এক জায়গায় বসে আছি। একটা ইংরেজি দৈনিকে দেখি যে ইরফান নাকি স্টিভেন স্পিলবার্গের ছবিতে না করে দিয়েছেন। সেদিন মনে হয়েছিল আমি মুম্বইতে কি করছি? (হাসতে হাসতে)
ইরফান তো এই ছবির ক্রিয়েটিভ প্রোডিউসারও বটে! ওঁর উপস্থিতি ছবিটাকে কতটা সাহায্য করেছে?
ফারুকি- ইরফান না থাকলে হয়তো ছবিটাই হতো না। সহ-প্রযোজক হিসেবে উনি দুর্দান্ত। আর জাভেদ হাসান চরিত্রটার জন্য এমন এক জনের দরকার ছিল, যাঁর ব্যক্তিত্ব ও বিরাট একই সঙ্গে তিনি খুব অসহায় একজন মানুষ। সেই দিক থেকে দেখতে গেলে তাঁর উপস্থিতি এই ছবিতে একটা প্রাণ সংযোজন।
আপনি বলছেন ‘ডুব’ হুমায়ুন আহমেদের বায়োপিক নয়। কেবলই ইন্সপিরেশন মাত্র। ছবিটি নির্মাণের ক্ষেত্রে কতটা জায়গা জুড়ে ছিলেন হুমায়ুন আহমেদ?
ফারুকি- আমরা বড় হয়েছি বঙ্গবন্ধুর লেখা পড়ে। তাঁর লেখা, তাঁর অনুপ্রেরণা আমার জীবনে তীব্র ভাবে ছিল। তীব্রতা কতটা ছিল তার টের পাইনি কোনও দিন। হুমায়ুন সাহেব যে দিন মারা গেলেন, সে দিন আমি সিউলে একটি রেস্তোঁরায়। আমার সঙ্গে অনেক বন্ধুবান্ধব। আমি তখন ‘টেলিভিশন’ ছবিটির পোস্ট-প্রোডাকশেনর কাজ করছি। বাইরে তখন মুশল ধারে বৃষ্টি। রেস্তোঁরার কাঁচে তখন টুপ টুপ করে জল পড়ছে। তাঁর মৃত্যুর খবরটা কানে এল। আর তখনই টের পেতে থাকি যে আমার চোখটাও কিরকম যেন রেস্তোঁরার কাঁচের মতো ভিজে যাচ্ছে। কখনও কিন্তু দেখা হয়নি ওঁর সঙ্গে। আর তখন এও টের পেতে থাকি যে, অজান্তেই হুমায়ুন আহমেদ আমার মধ্যে আসন গেড়ে বসে আছেন। সেদিনের সেই বৃষ্টির অনুপ্রেরণা আমার কাজে থাকতে পারে। তখন গাড়িতে যেতে যেতে বিটল্স-এর একটা গান খুব শুনতাম ‘হোয়াইল মাই গিটার জেন্টলি উইপস্’— সেই গানের অনুপ্রেরণা, গাড়ির ভিতর গানটা অনুভব করা এই সবই আমার অনুপ্রেরণা। এই নিয়েই আমি ছবি তৈরি করি। ফিকশন তো আর আকাশ থেকে পড়ে না।
যদি ‘ডুব’ কে একটা পুরোদস্তুর বায়োপিক বলতেন কি এসে যেত? দুনিয়ায় তো হাজার হাজার বায়োপিক তৈরি হচ্ছে যা মিথ্যায় ঠাসা।
ফারুকি- না সেটা করলে দর্শককে মিস গাইড করা হত। হ্যাঁ, এটা ঠিক যে প্রচুর বায়োপিকেই মিথ্যে কথা বলা হয়। যেমন মার্ক জুকারবার্গ-কে নিয়ে যে বায়োপিক তৈরি হয়েছে— তা দেখার পর মার্ক বলছেন এই ছবিতে আমার টিশার্ট ছাড়া আর কিছুই স্বাভাবিক নয়। আর এখানেই তো ফিকশন আর ফ্যাক্টের ফারাক। ফিকশন মানেই তো মিথ্যের বানোয়াট। কিন্তু আমি ওই পথে যেতে চাইনি। বায়োপিক বললেই মানুষ তার মধ্যে সত্য অনুধাবনের চেষ্টা করতেন।
আপনার ফেসবুক পেজেই ডুব সম্পর্কে একজন লিখছেন ‘হুমায়ুনের চরিত্রে ইরফান দুরন্ত। তবে মেহের আফরোজ শাওনের চরিত্রে পার্ণোকে আরও একটু বেশি দেখা গেলে ভাল হত।’ কী বলছেন এই বিষয়ে?
ফারুকি- এখানেই আমার ঘোর আপত্তি। এই ছবিটি দেখতে আসার আগে হুমায়ুন আহমেদকে মাথা থেকে সরিয়ে ফেলুন। দেখার পর যদি কিছু মনে হয় তাতে আমার কিস্সু করার নেই। কিন্তু হুমায়ুন কে মাথায় করে ‘ডুব’ দেখতে এলে অনেক কিছু মিস করবেন। অনেক নীরব মুহূর্ত মিস করবেন, অনেক অসহায়ত্ব মিস করবেন।
আরেক জন তো লিখেছেন, ‘পৃথিবীতে খারাপ মানুষ অনেক আছেন, খারাপ বাবা একজনও নেই।’
ফারুকি- হ্যাঁ! ‘ডুব’ এক বাবা ও মেয়ের ভালবাসার গল্প। আর সেই গল্প দেখতেই দর্শক হলে আসুক আমি সেটাই চাই।
এই নিয়ে স্ত্রী তিশার সঙ্গে তৃতীয় ছবি। ‘থার্ড পার্সন সিঙ্গুলার নম্বর’, ‘টেলিভিশন’ আর এখন ‘ডুব’ । এই বার বাংলাদেশের অভিনেত্রীরা যদি আপনার বিরুদ্ধে স্বজনপোষণের অভিযোগ করেন?
ফারুকি- সে করুক। নিজের স্ত্রীয়ের প্রশংসা আমার মুখে মানায় না। তবে তিশার মতো শক্তিশালী অভিনেত্রী এই মুহূর্তে বাংলাদেশে নেই বললেই চলে।
আর পার্ণো?
ফারুকি- পার্ণো দুর্দান্ত। এই ছবিতে ওঁর অবদানও বিরাট। ওঁর কয়েকটা ছবির ট্রেলার দেখেই আমি ঠিক করে ফেলি যে, পার্ণোর সঙ্গে কাজ করব। আর স্ক্রিন টেস্টের দিন ঘন্টার পর ঘন্টা আড্ডা। পার্ণো তো ভেবেছিল বিরাট কিছু একটা ব্যাপার। কিন্তু আমি আড্ডা দিতে দিতেই এভাবেই স্ক্রিন টেস্ট করে থাকি।
পরের ছবিতে নওয়াজ আছেন?
ফারুকি- না, নওয়াজের সঙ্গে কাজ করব তার পরের ছবিতে। ‘নো ল্যান্ডস ম্যান’ বলে ছবিতে।
পরের পরের ছবিরও প্ল্যান তৈরি?
ফারুকি- হ্যাঁ। এমনকী তার পরের ছবিরও। আসলে একটা ট্রিলজি তৈরি করব। প্রথমেরটা ‘শনিবার বিকেলবেলা’ বা ‘স্যাটারডে আফ্টারনুন’, যেখানে তিশা আছেন ও প্যালেস্তাইনের অভিনেতা ইয়াদ হুরানি থাকবেন। তার পর নওয়াজের সঙ্গে ‘নো ল্যান্ডস ম্যান’। এবং সবশেষে রোহিঙ্গা সমস্যা নিয়ে একটা ছবি করব। নাম ঠিক করিনি। ডিসেম্বর থেকে ‘শনিবার বিকেলবেলা’র শুটিং শুরু করব।
একেবারে প্যালেস্তাইনের অভিনেতা?
ফারুকি- শুধু প্যালেস্তাইন নয়, আরও নানান দেশের অভিনেতাদের সঙ্গে কাজ করতে চাই এবং ভবিষ্যতে করবও। এর নামই তো জীবন………আহারে জীবন।।