রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ০২:২০ পূর্বাহ্ন
নিজস্ব প্রতিবেদক: বাংলাদেশের অপরাজনীতির নিকৃষ্ট উদাহরণ পিরোজপুরের ভান্ডারিয়ার মহিউদ্দিন মহারাজ ও তার ছোট ভাই মো. মিরাজুল ইসলাম (মিরাজ)। ‘টাকায় বাঘের চোখ মেলে’ -এই প্রবাদ বাক্যটি বাস্তব করেছে মিরাজ-মহারাজ সহোদর। আওয়ামী লীগের রাজনীতিকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে গড়েছেন অবৈধ সম্পদের পাহাড়। বাংলাদেশে স্বৈরাচারী আওয়ামী সরকারের পতন হলেও পিরোজপুরের ভান্ডারিয়ার চিত্র ভিন্ন। সেখানে মিরাজ-মহারাজের টাকায় বিক্রি হয়ে বিএনপি আর পুলিশ প্রশাসন চলছে স্বৈরাচারী আদলে। তাদের চোরাচালান, মাদক ব্যবসা, টেন্ডারবাজী ও বিলাসী জীবনযাপনের কথা স্থানীয় লোকজন জানলেও আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পরেও ভয়ে মুখ খুলতে রাজি নয় কেউ। অন্যদিকে বিএনপির নেতৃস্থানীয় ও সাংবাদিকদের টাকা ও গাড়ী দিয়ে ম্যানেজ করেছে বলেও অভিযোগ উঠেছে। কারণ সরকার পতনের পর দেশের বিভিন্ন স্থানে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা হলেও ভান্ডারিয়া থানায় মামলা দায়ের হয়েছে বিএনপির নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে। যা নিয়ে সাধারণ মানুষের মাঝে ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে।
সারাদেশে পুলিশ প্রশাসনে ব্যাপক রদবদল হলেও পিরোজপুরের ভান্ডারিয়ায় রয়েছে বহাল তবিয়তে। মিরাজ-মহারাজের নির্দেশনার বাইরে কোনো দাপ্তরিক কাজই হয় না এই সংসদীয় আসনে। তাদের টাকার কাছে বিক্রি হয়ে আছে প্রত্যেকটি দাপ্তরিক চেয়ার।
ভারত, দুবাই সিঙ্গাপুরসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সাথে রয়েছে আন্তর্জাতিক চোরাচালান চক্র। সাম্প্রতিক সাবেক সাংসদ আনার হত্যাকান্ডেও রয়েছে মহিউদ্দিন মহারাজের সম্পৃক্ততার অভিযোগ উঠেছে।
মহারাজকে সরাসরি মদদ দিতেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সাবেক সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এবং প্রধানমন্ত্রীর মূখ্য সচিব তোফাজ্জল হোসেন রিপন মিয়া। এ ছাড়া আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ শীর্ষস্থানীয় একাধিক মন্ত্রী ও সংসদ সদস্য এই সিন্ডিকেট থেকে নিয়মিত মাসোহারা নিতেন। সম্পৃক্ততা ছিল আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কর্তাব্যক্তিদেরও। দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) তাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগ উঠলেও শেষ পর্যন্ত টাকা ও ক্ষমতার কাছে থমকে যায় সেই তদন্ত কার্যক্রম।
তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, মিরাজ-মহারাজ সহোদরের আকাশচুম্বী উত্থানের নেপথ্যে আছে ভয়ংকর চোরাকারবার ও প্রতারণার গল্প। পিরোজপুরের ভান্ডারিয়ায় সরেজমিনে অনুসন্ধানকালেও নানা অবিশ্বাস্য কাহিনি বেরিয়ে এসেছে। স্থানীয় বাসিন্দারাও মিরাজ-মহারাজের এত ক্ষমতার ঘটনাকে রীতিমতো আলাদিনের চেরাগ হাতে পাওয়া বলেই মনে করছে।
ঐ এলাকার স্থানীয় বাসিন্দা ও সাবেক চেয়ারম্যান বাবু তালুকদার জানান, পিরোজপুর জেলায় জামায়াতে ইসলামীর নেতা কর্মীদের মারধর, ঘুম, খুন ও জেলে পাঠিয়েছেন যারা তাদের মধ্যে অন্যতম হলো পিরোজপুর-১ আসনের আওয়ামীলীগ সরকারের সাবেক এমপি আউয়াল, মহিউদ্দিন মহারাজ, তার ছোট ভাই ভান্ডারিয়া উপজেরা চেয়ারম্যান মিরাজুল ইসলাম।
বাবু তালুকদার দাবী করেন, আল্লামা দেলওয়ার হোসেন সাঈদীকে রাজাকার ও যুদ্ধাপরাধীর নাটক সাজানোর মূল পরিকল্পনাকারী ছিলেন সাবেক এম পি আউয়াল এবং সহায়তাকারী মহিউদ্দিন মহারাজ। এছাড়া বর্তমান অন্তবর্তী সরকারের পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন এবং পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানের স্বামীকে অপহরণ করার অভিযোগ করেন মহিউদ্দিন মহারাজের বিরুদ্ধে।
পিরোজপুরের বিভিন্ন প্রত্যন্ত এলাকায় সরেজমিন অনুসন্ধানকালে এই প্রতিবেদকের সঙ্গে একান্ত আলাপচারিতায় অংশ নেন ভান্ডারিয়া-মঠবাড়ীয়াসহ বিভিন্ন উপজেলার বীর মুক্তিযোদ্ধা, শিক্ষক, সাংবাদিকসহ বিভিন্ন শ্রেণীপেশার অসংখ্য ভূক্তভোগী। মহারাজের দুর্নীতি ও রাজনৈতিক আধিপত্যের বিরুদ্ধে তারা সকলেই ছিলেন সোচ্চার। সকলেরই অভিযোগ, মহিউদ্দিন মহারাজ মানুষকে মানুষ বলে গণ্য করছে না, ধরাকে রীতিমতো সরা জ্ঞান করছেন তিনি।
একসময়ের স্বমিল ম্যানেজার রাজাকার শাহাদাৎ হোসেনের সন্তান মহিউদ্দীন মহারাজ কোন আলাদীনের চেরাগ পেয়ে আঙুল ফুলে কলাগাছ হলেন তা দেশের বিষ্ময! দক্ষিণাঞ্চলের ভাণ্ডারিয়ার মনি জমাদ্দারের মালিকানা কাঠ চেরাই স্বমীলের ম্যানেজার ছিলেন মহারাজের বাবা শাহাদাৎ হোসেন আর ছেলে মহারাজ ছিলেন আবাসিক হোটেলের দায়িত্বে। সেখানে বসে নিয়ন্ত্রণ করতো পিরোজপুরের ভয়ঙ্কর ডাকাত বাহীনি। যার নেতৃত্বে ছিলে মহারাজের মেজোভাই মিরাজুল ইসলাম ওরফে মোসলেউদ্দীন। সময়ের পরিক্রমায় আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর ছত্রছায়ায় আসেন এই মহারাজ। এক সময়ে আনোয়ার হোসেন মঞ্জু সাহেবের পিএস হিসেবে যোগদান করেন মহারাজ। আনোয়ার হোসেন মঞ্জু বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী থাকাকালীন সময়ে মহারাজ নানা অনিয়ম দুর্নীতি করে গড়ে তোলেন অবৈধ সম্পদের পাহাড়। মঞ্জু সাহেবের ক্ষমতার প্রভাবে জেলা এলজিআরডি ঠিকাদারির ব্যবসা শুরু করে এই মহারাজ। কাজের ৮০ শতাংশ বিল নিজেই হাতিয়ে নিয়ে শুরু করেন অনিয়মের সাম্রাজ্য। মঞ্জু সাহেবের পিএস থাকার সুবাধে একে-৪৭ এর মতো ভারি অস্ত্রের লাইসেন্স করিয়ে নেন মহারাজ তার নিজ নামে। পিরোজপুর জেলাজুড়ে গড়ে তোলেন একাধীক সন্ত্রাসী বাহিনি। জড়িয়ে পরে আন্তর্জাতিক স্বর্ণ চোরাচালান ও মাদক ব্যবসার সাথে। মহারাজের সীমাহীন অপরাধ, অনিয়ম আর দুর্নীতির কারণে আনোয়ার হোসেন মঞ্জু সাহেবের সাথে দূরত্ব বাড়তে থাকে।
একজন রাজাকারের সন্তান হয়েও টাকা আর ক্ষমতার জোরে পিরোজপুর জেলা আওয়ামী লীগের গুরুত্বপূর্ণ পদ দখল করেন এই মহিউদ্দীন মহারাজ। অবৈধ টাকা আর ক্ষমতার জোরে অনেক ত্যাগী নেতাদের পিছনে ফেলে দলীয় পদ পাওয়ায় ক্ষোভের পাহাড় জমে পিরোজপুরের আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের মধ্যে। তবুও প্রকাশ্যে তাদের বিরুদ্ধে কেউ কথা বলার সাহস পায় না। কারণ তাদের বিপক্ষে দাড়ালে অস্তিত্বের সংকটে পরে যায় যে-কেউ। নানা মিথ্যা মামলা আর হামলায় জর্জরীত হয়ে পরে বিরোধী পক্ষ।
পিরোজপুর জেলা চেয়ারম্যান হিসেবে নির্বাচিত হন এই মহারাজ। অবৈধ টাকা আর ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে পিরোজপুর জেলার প্রতিটি থানায় তাদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত করতে থাকেন। বিভিন্ন কূটকৌশলে ভাণ্ডারিয়া আওয়ামীলীগের ত্যাগী নেতাদের সরিয়ে মিরাজুল ইসলামকে উপজেলা চেয়ারম্যান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন।
টাকায় যে বাঘের চোখ মেলে এই প্রবাদ বাক্যের জ¦লন্ত প্রমাণ মহিউদ্দীন মহারাজ। শখ করে জীবন্ত বাঘ পোষেন মহারাজের ভাই মিরাজুল ইসলাম।
মিরাজ-মহারাজের প্রভাবের একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা মঠবাড়ীয়া উপজেলার ২নং ধানীসাফা ইউনিয়ন নির্বাচন। এই নির্বাচনে মিরাজ-মহারাজের পছন্দের প্রার্থীকে নির্বাচিত করতে তাদের পরিকল্পনাতে নিজস্ব বাহিনী আর বিজিবির হামলায় নিহত হয়েছিল একাধীক ব্যক্তি। নিহতদের মধ্যে বেশিরভাগই ছিল তেলিখালী ইউনিয়নের বাসিন্দা।
সাম্প্রতিক সময়ে ভান্ডারিয়া উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে মিরাজুল ইসলামের প্রতিদন্দ্বীকে মিথ্যা মামলায় ফাসিয়ে ফাকা মাঠে বিনা-প্রতিদন্দ্বীতায় পুনরায় চেয়ারম্যান হন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধীক প্রবীণ ব্যক্তি বলেন, “মিরাজ-মহারাজ মিল্লা, পিরোজপুর খাইলো গিল্লা”। “আমাগো এহানে হেরাই যেন রাজা, বাকীরা সব প্রজা। মন্ত্রী-সচিব-দুদক-ডিসি-এসপি সব হ্যাগো টাহায় চলে। হ্যাগো এতো টাহা যে, সাগর-নদী শুকিয়ে যাবে কিন্তু তাগো টাহা ফুরাইবে না। হ্যাগো লগে নাকি রাষ্ট্রপতি-প্রধানমন্ত্রীর লগে হট কালেকশন। আর কয়দিন সময় পাইলে মনে হয় পুরা দ্যাশটাই হ্যারা কিন্না হালাইবে।”
টিনের ঝুপরী ঘরে বসবাস করে বর্তমানে তারা গুলশান-বনানীর মতো বিলাশবহুল বাড়ী-গাড়ী আলীশান জীবন-যাপন করেন। তাদের বাড়ীতে গেলে মনে হয়, এটা যেন স্বপ্ন রাজ্য। মিরাজুল ইসলামের জীবন-যাপন দেখলে মনে হয়, সে যেনো আরব্য রাজ্যের রাজপুত্র।
তেলিখালী ইউনিয়নকে উপজেলা পরিষদে রূপান্তর করতে মঠবাড়ীয়ার সাবেক এমপি ডাক্তার রুস্তম আলী ফরাজীকে হাত করেন। কিন্তু সে পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়। ১নং তুষখালী ইউনিয়ন ও ২নং ধানীশাফা ইউনিয়নকে অন্তর্ভূক্ত করার জন্য দূর্ধর্ষ ডাকাত ও মিথ্যা মামলার মহা-নায়ক সগির মেম্বার ও ধানীশাফার চেয়ারম্যান হারুন তালুকদারকে নিজেদের লোক হিসেবে ব্যবহার করেন।
যুদ্ধকালীন তুষখালী পিসকমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন রাজাকার জুলফিকার আলী শরীফ। তার ছেলে রাজাকার নজরুল ইসলাম শরীফের কনিষ্ট সুন্দরী কন্যা ঝুমু ইসলামকে বিয়ে করে আরেক রাজাকার পুত্র মহিউদ্দীন মহারাজ। এই বিয়ের মাধ্যমে দুই ইউনিয়নের রাজাকার পরিবার মিলিত হয় এক সুত্রে।
সূত্রে জানাযায়, হিন্দু এলাকায় রাজাকার নজরুল ইসলাম শরীফ নানাভাবে হিন্দুদের সম্পদ লুটপাট করে এলাকায় নৈরাজ্য সৃষ্টি করে।
রাজাকার মোঃ শাহাদাত হোসেন দফাদার পিতাঃ খবির উদ্দিন দফাদার (পিস কমিটির চেয়ারম্যান, তেলিখালী ইউনিয়ন), গ্রামঃ হরিনপালা, ডাকঘরঃ তেলিখালী, উপজেলাঃ ভান্ডরিয়া, জেলাঃ পিরোজপুর, বাংলাদেশ। বিগত ১৯৭১ সালের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর সহযোগী প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত রাজাকার ও মুক্তিযোদ্ধা হত্যায় নেতৃত্বদানকারী একজন ঘাতক ছিল। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের ৯ম সেক্টরের সাব সেক্টর সুন্দরবন অঞ্চলের আওতাধীন তুষখালী সরকারী (পাকিস্তানী) গোডাউন হইতে আগষ্ট মাসের শেষ সপ্তাহে যুদ্ধরত মুক্তিযোদ্ধারা তাদের খাবার চাল সংগ্রহ করতে গেলে মুক্তিযোদ্ধা ও রাজাকারদের মধ্যে তুষখালীতে মুখোমূখি যুদ্ধ সংঘটিত হয়। সেই সম্মুখ যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে রাজাকার বাহিনী পরাজিত হয়ে পালিয়ে যায়। পরাজিত রাজাকার বাহিনী পলায়নকালে ভারতের বিহারে প্রশিক্ষন প্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা বিমল কৃষ্ণ দেঊরীকে তুলে নিয়ে যান এবং পরবর্তীতে রাজাকার শাহাদাত হোসেন হাওলাদার ও রাজাকার শরিফ নজরুল ইসলামের নেতৃত্বে অমানুষিক নির্যাতন চালায়ে বিমল কৃষ্ণ দেঊরীর চোখ উৎপাটনসহ শরীরকে ক্ষতবিক্ষত করে নির্মম ভাবে হত্যা করে। রাজাকার মোঃ শাহাদাত হোসেন হাওলাদার এর ৪(চার) ছেলে (১) মহিউদ্দিন মহারাজ, (২) মিরাজুল ইসলাম, উপজেলা চেয়ারম্যান, ভান্ডারিয়া উপজেলা। (৩) সালাউদ্দিন হাওলাদার ও (৪) শামসুদ্দিন হাওলাদার, চেয়ারম্যান, তেলিখালী ইউনিয়ন, ভান্ডারিয়া।
বিগত সরকারের সময়ে এলজিইডির বিভিন্ন উন্নয়ন কাজের মান খারাপ হওয়ার জন্যও দায়ী এই মহারাজের ভাই মিরাজুল।
এলজিইডি সূত্রে জানা গেছে, মিরাজের সাথে এলজিইডির সকল দুর্নীতিগ্রস্থ কর্মকর্তার সম্পর্ক আছে। পিরোজপুর জেলায় এলজিইডির নির্বাহী প্রকৌশলীর পোষ্টিং হতো এই দুই ভাইয়ের ইচ্ছানুযায়ী। বিগত ১৫ বছরে এলজিইডির দুর্নীতিগ্রস্থ অফিসারদের খুঁজে বের করে পোষ্টিং দেওয়া হয়। প্রথমদিকে নির্বাহী প্রকৌশলী হিসেবে নিয়ে আসেন আব্দুল হাইকে। তার সাথে মতবিরোধ হলে নিয়ে আসেন নির্বাহী প্রকৌশলী রফিকুল হাসানকে। তিনি সেখানে প্রায় চার বছর ছিলেন, তার সময়ের এলজিইডি পিরোজপুরের কাজের মান খুব খারাপ হলে তাকে প্রধান প্রকৌশলী তুলে নিয়ে আসেন। নির্বাহী প্রকৌশলী হিসাবে নিয়ে আসা হয় এলজিইডির সবচেয়ে সমালোচিত প্রকৌশলী জনাব সুশান্ত রঞ্জন রায়কে। তিনি টেন্ডারবাজি, অপ্রয়োজনীয় রিভাইস, ওভারপেমেন্ট, ডুপিকেশন (একই স্কীম একের অধিক প্রকল্প থেকে টেন্ডারকরণ) ইত্যাদি অনেক ভয়ানক অপরাধে সম্পৃক্ত। সুশান্তের বিরুদ্ধে অভিযোগের পাল্লা ভারী হলে কর্তৃপক্ষ তাকে সরানোর উদ্যোগ নেয়, আরেক দুর্নীতিপরায়ন নির্বাহী প্রকৌশলী আব্দুস সাত্তার হাওলাদারকে নিয়ে আসা হয়। তিনি গত জুন মাসে অবসরে গিয়েছেন। এরপর নিয়ে আসা হয় অনৈতিক কাজের মাস্টারমাইন্ড বর্তমান নির্বাহী প্রকৌশলী রনজিত দেকে।
পরবর্তীতে মিরাজুল ইসলাম তৎকালীন মন্ত্রী তাজুল ইসলাম, প্রধান প্রকৌশলী রশীদের সহযোগীতায় (কোটি টাকার বিনিময়ে) সুশান্ত রঞ্জন রায়কে ‘বরিশাল-ঝালকাঠী-পিরোজপুর’ প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক হিসাবে নিয়োগ পাইয়ে দেন। এই প্রকল্পের আওতায় পিরোজপুর জেলায় ইফতি. ইটিসিএল (প্রাঃ) লিমিটেড কাজ পায়। যাহার প্রোপ্রাইটর মিরাজুল ইসলাম। দেশের দক্ষিণাঞ্চলে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতির জন্য (ওইজচ) নামে একটি প্রকল্প চালু হয়। এই প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক ছিলেন আহমদ আলী। তাকে এই প্রকল্পের দায়িত্ব থেকে সরিয়ে সুশান্ত রঞ্জন রায়কে অতিরিক্ত দায়িত্ব দেওয়া হয়। কারণ আহমেদ আলী জানতে পারেন তার প্রকল্পের প্রায় ১৫/২০টি ব্রীজের কাজ শুরু হয়নি। অথচ ৮৫% পেমেন্টের জন্য চাপ প্রয়োগ করেন। এই কাজগুলো করার জন্য নির্বাচিত হয়েছিলেন ইফতি. ইটিসিএল (প্রাঃ) লিমিটেড। কাজগুলোর ওভারপেমেন্ট, ডুপিকেশন, টেন্ডারিং ইত্যাদি ঘাপলাসহ আহমেদ আণলীর বিষয়টি পুণঃতদন্ত করে দেখা উচিত বলে সংশিষ্টরা জানান।
পিরোজপুরে একটি প্রকল্প এর কাজ শুরু হয় ২০২২ সালে। শুরুতেই এই প্রকল্প থেকে প্রায় ১৫০ কোটি টাকার স্কীম বাস্তবায়নের জন্য দরপত্র আহ্বানের নিমিত্তে অনুমোদন দেয়া হয়। ঐ অর্থ-বছরেই পিরোজপুর জেলায় প্রকল্প পরিচালক ১১০ কোটি টাকা ছাড় করেন। কাজগুলোর বেশিরভাগই নামে-বেনামে বাস্তবায়ন করছে ইফতি. ইটিসিএল (প্রাঃ) লিমিটেড। তাদেরকে বরাদ্দকৃত টাকার প্রায় পুরোটাই দিয়ে দেওয়া হয়। অথচ তখন পর্যন্ত মাঠে ৫% কাজও বাস্তবায়িত হয়নি। তাকে প্রকল্প পরিচালক নিয়োগ করার জন্য মিরাজ কোটি টাকার বেশি মন্ত্রীকে প্রদান করেন। ওই প্রকল্পের দায়িত্বে ছিলেন মো. সেলিম মিয়া। এ প্রকল্পের অধীনে পিরোজপুর জেলায় ১৮টি ব্রীজ নির্মাণের জন্য অনুমোদন দেয়া হয়। প্রায় সবগুলোর কাজ করার দায়িত্ব পায় ইফতি. ইটিসিএল (প্রাঃ) লিমিটেড। এসব স্কীমের ১৪টি তারা নিজে করছে। এই ১৪টি কাজের কোনো কাজই শুরু হয়নি অথচ পরিশোধ করা হয় চুক্তিমূল্যের প্রায় ৮৫% টাকা । ছ্যাফড্রিপ প্রকল্পের মাধ্যমে পিরোজপুর জেলায় ৭০ এর অধিক স্কীম বাস্তবায়িত হচ্ছে। এই প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক মো. রফিকুল হাসান। আশ্চর্যজনক হলেও সত্য এর মধ্যে প্রায় ৬৫টি স্কীম ইফতি. ইটিসিএল (প্রাঃ) লিমিটেড পেয়েছে। এ প্রকল্পের কাজগুলোর টেন্ডারিং প্রক্রিয়াসহ গুণগতমান নির্ধারণেের জন্য সংশিষ্ট কর্তৃপক্ষ সরেজমিনে পরিদর্শন করলে আসল রহস্য বেরিয়ে আসবে।
এদিকে পিরোজপুর জেলার পল্লী অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক মো. ইব্রাহীম। মিরাজের ইচ্ছে অনুযায়ী তাকে নিয়োগ দেয়া হয়। মিরাজের সাথে সাবেক মন্ত্রী তাজুল ইসলাম ও ভান্ডারিয়া নিবাসী সাবেক প্রধানমন্ত্রীর মূখ্যসচিব তোফাজ্জেল হোসেনের দহরম-মহরম সম্পর্ক। মূলত এদেরকে ব্যবহার করে বরিশাল বিভাগের সমস্ত প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালকদের নিয়োগে মুখ্য ভূমিকা পালন করেন।
এলজিইডি সূত্র জানায়, দেশের পরিবর্তীত সর্বত্র সংস্কার হলেও এখানকার বিতর্কিত কর্মকর্তারা এলজিইডি মন্ত্রণালয়সহ সর্বত্র দাবড়িয়ে বেড়াচ্ছেন। তাদের এই দৌরাত্বের সীমা শুরু বরিশাল বিভাগের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না। এলজিইডির আওতাধীন বাংলাদেশের সমস্ত প্রকল্পের পরিচালক নিয়োগে মন্ত্রীর সাথে কাজ করেছেন। এ অবস্থায় অনতিবিলম্বে বরিশাল বিভাগের সমস্ত প্রকল্প পরিচালদেরকে দায়িত্ব থেকে অপসারন করে দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের নিয়োগদানের পরামর্শ সংশিষ্টদের।
মাঠপর্যায়ের ব্যাপক অনুসন্ধানে জানা গেছে, ২০০৮ সালে নবম সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার ক্ষমতায় এলে আবারও রাজনৈতিক পরিচয় পাল্টানোর সিদ্ধান্ত নেয় মহিউদ্দিন মহারাজ। ইতোমধ্যে টেন্ডারবাজির মাধ্যমে প্রচুর কালোটাকার মালিক বনে যাওয়া কুখ্যাত এই ক্যাডারকে সরকারি দল আওয়ামী লীগে ঢুকার সুযোগ করে দেন পিরোজপুর সদর আসনের নবনির্বাচিত সংসদ সদস্য একেএমএ আওয়াল ওরফে সাইদুর রহমান। বছর দুয়েক আগে, নতুন রাজনৈতিক অভিভাবক এমপি আওয়ালের হাতে সোনার নৌকো তুলে দিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে জেপি (মঞ্জু) থেকে ভান্ডারিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগে যোগ দেয় মহিউদ্দিন মহারাজ। পিরোজপুর জেলা আওয়ামী লীগ-এর ত্যাগী নেতাকর্মীদের অভিযোগ, মূলত ভান্ডারিয়ার রাজনীতিতে নিজের প্রভাববলয় বিস্তারের কুটিল উদ্দেশ্যেই মহিউদ্দিন মহারাজের মতো একজন আপাদমস্তক দুর্নীতিবাজ ক্যাডারকে আওয়ামী রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত করার বিতর্কিত সিদ্ধান্ত নেন এমপি একেএমএ আওয়াল। এই সিদ্ধান্তের জের ধরে আওয়ামী লীগের স্থানীয় পর্যায়ের নেতাকর্মীদের মধ্যে ব্যাপক অসন্তোষ ছড়িয়ে পড়ে। মহারাজের মতোন চিহ্নিত ক্যাডারকে দলের গুরুত্বপূর্ণ পদে বরণ করে নেয়ার প্রতিবাদে চরম হতাশ ও ক্ষুব্ধ বহু ত্যাগী নেতাকর্মী চিরতরে আওয়ামী লীগের রাজনীতি ছেড়ে দেয়ার চিন্তাভাবনা শুরু করেন। তবে জেলা আওয়ামী লীগের সম্পাদক পদে থাকা এমপি আওয়ালের সরাসরি আশীর্বাদ থাকায় সাংগঠনিক সব প্রতিকূলতা সামলে সুকৌশলে ভান্ডারিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগে শক্তিশালী অবস্থান তৈরি করে নেয় মহিউদ্দিন মহারাজ। একসময় আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের এবং সাবেক প্রধানমন্ত্রীর মূখ্য সচিব তোফাজ্জল হোসেন রিপন মিয়ার আর্শিবাদে হয়ে যান সংসদ সদস্য।
নিজের বিভিন্ন অপকর্মের শাস্তি হতে পারে এমন ভয়ে সরকার পতনের পর থেকেই পলাতক এই মিরাজুল। বিগত সরকারের সময়ে নেওয়া বিভিন্ন কাজ কৌশলে শেষ করার জন্য বিএনপির নেতাদের উৎকোচ দিয়ে আড়ালে থেকেই কাজ উদ্ধার করতে চান তিনি। এরই মধ্যে পিরোজপুর জেলার বিএনপির দুই শীর্ষ নেতাকে দুইটি হেরিয়ার জিপ গাড়ি এবং এক কোটি করে টাকা দিয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। জানা গেছে নিজের স্ত্রীর মাধ্যমে এই লেনদেন করেছেন মিরাজুল। বিগত আওয়ামী লীগ সরকার পতনের প্রায় দেড় মাস অতিবাহিত হলেও ধরাছোঁয়ার বাইরে আছে বিতর্কিত মহিউদ্দিন মহারাজ ও মিরাজুল ইসলাম। দুইজনকে দ্রুত গ্রেপ্তারের দাবি এলাকাবাসীর।
মহিউদ্দিন মহারাজের ব্যবহৃত মুঠোফোন বন্ধ থাকায় ও তার ভাই মিরাজুল ইসলাম ফোন রিসিভ না করায় উপরে উল্লেখিত অভিযোগের বিষয়ে তাদের বক্তব্য নেয়া সম্ভব হয়নি।