শুক্রবার, ১৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ০২:১৭ পূর্বাহ্ন
তুহিন ভূঁইয়া:
সংস্কারের ধারাবাহীকতায় জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল পুনর্গঠন করেছে সরকার। জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল আইন, ২০২২ অনুসারে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক উপদেষ্টা ফারুক ই আজমকে চেয়ারম্যান করে আগামী তিন বছরের জন্য ১১ সদস্য বিশিষ্ট জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল পুনর্গঠন করেছে সরকার। সদস্য সচিব হিসেবে থাকবেন জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের মহাপরিচালক। বুধবার (২০ নভেম্বর) মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে এ সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে।
এতে বর্তমান সরকার কর্তৃক জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের সদস্য হিসেবে মনোনীত হলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা খ. ম. আমীর আলী। তিনি ন্যাশনাল ফ্রিডম ফাইটার ফাউন্ডেশনের মহাসচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসছেন। ১৯৭৪ সালে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের আমন্ত্রণে বাংলাদেশ থেকে তার নেতৃত্বে ৩০ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল মস্কোতে শুভেচ্ছা ভিজিট করেন। তিনি বিগত সময় থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের নানা প্রতিবন্ধকতা মোকাবেলা ও বৈসম্য দূরীকরণে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করে আসছেন।
জামুকার সদস্য হিসেবে মনোনীত হওয়ায় খ. ম. আমীর আলী তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় তিনি প্রথমেই কোটা সংস্কার আন্দোলনে মর্মান্তিকভাবে নিহতদের প্রতি গভীর শোক এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জ্ঞাপন করেন। আন্দোলনে ক্ষতিগ্রস্থ পরিবারগুলোকে সহায়তা প্রদানের পাশাপাশি নিরপেক্ষ তদন্তের মাধ্যমে সকল মৃত্যুর সুষ্ঠু বিচার নিশ্চিত করার ব্যাপারে সরকারের সংশ্লিষ্ট কতৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।
খ. ম. আমীর আলী জামুকার কার্যক্রমের ব্যাপারে ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, বিগত বছরগুলোতে সরকার বদলের পটপরিবর্তনের সাথে সাথে পাল্লা দিয়ে রাজাকার ও অমুক্তিযোদ্ধাদের রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় গেজেটভূক্ত করা হয়েছে। যা প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য চরম অপমানজণক ও অসাম্মানের শামিল। আমরা সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্তের মাধ্যমে এসকল রাজাকার ও অমুক্তিযোদ্ধাদের গেজেট বালিতের জন্য কার্যকরী পালন করবো। গেজেট বাতিলকৃতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির আওতায় আনার জন্য মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়কে সুপারিশ করবো। এ যাবৎকাল তারা যে সরকারি অনুদান গ্রহণ করেছে তা রাষ্ট্রীয় কোষাগারে ফেরত দেয়ার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করবো। সত্যিকারের মুক্তিযোদ্ধা এবং তাঁদের ত্যাগকে মূল্যায়ন করতে হলে মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় সংস্কার প্রয়োজন। আমরা নিরপেক্ষভাবে কাজ করে মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে বৈসম্য দূর করে উপযুক্ত সম্মান ফিরিয়ে আনতে এমন দৃষ্টান্ত স্থাপন করবো যা ভবিষ্যতে অনূকরণীয় হয়ে থাকবে বলে আশা রাখি।
বিগত দিনে জামুকা থেকে ৩৩ প্রকারের মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা করা হয়েছে। কিন্তু আমরা চাই মুক্তিযোদ্ধা হবে এক প্রকার, যারা ময়দানে অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করেছে তাদেরকেই প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় রাখতে চাই। আর বাকী প্রকারদের স্বাধীনতার সৈনিক, স্বাধীনতার সমর্থক অথবা স্বাধীন বাংলার সৈনিক হিসেবে নামকরণ করতে চাই। কারও অবদানকে আমরা অস্বিকার অথবা ছোট করে করে দেখতে চাই না। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করা সমরযোদ্ধাদের সর্বোচ্চ সম্মান দিয়ে এক দলে, এক গোত্রে আনতে চাই।
বীর মুক্তিযোদ্ধা খ. ম. আমীর আলী অভিমান আর ক্ষোভের সাথে বলেন, বিগত শাসনামলে সাধারণ মুক্তিযোদ্ধারা তালিকাভুক্ত হতে হয়রানির শিকার হলেও মন্ত্রী-এমপি-মেয়রসহ দলীয় প্রভাবশালী ব্যক্তিদের কেউ কেউ জামুকার বিশেষ কমিটির সুপারিশে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তালিকাভুক্তির সুযোগ পেয়েছে।
সাবেক মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী ব্যক্তিগত শুনানির মাধ্যমে সেসব আবেদন বিশেষ কমিটিতে পাঠাতেন, এই বিশেষ সুপারিশপ্রাপ্তদের মধ্যে অনেকেই চিহ্নিত অ-মুক্তিযোদ্ধা। আবার আওয়ামী লীগ ছাড়া ভিন্ন মতাদর্শের লোকজন আবেদন করলেই তাঁদের আবেদন নানা অসিলায় বাতিল করে দেওয়া হতো।
তখন মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাইয়ের নামে সাধারণ মুক্তিযোদ্ধাদের ব্যাপক হয়রানি করা হতো। উপজেলা-জেলা কমিটির সদস্যদের চাহিদা পূরণ করতে না পারলে ইতিবাচক প্রতিবেদন যেত না জামুকায়। আবার জামুকার সদস্য ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের খুশি করার পরই মিলত কাঙ্ক্ষিত সুপারিশ। এ কারণে অনেক নামি-দামি বিখ্যাত মুক্তিযোদ্ধারা সনদের জন্য আর জামুকামুখী হতেন না। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে সরকার বিরোধী মতাদর্শী মুক্তিযোদ্ধারা তালিকায় নাম অন্তর্ভুক্ত করার জন্য আবেদন করার কথা মুখেও আনতেন না। বরং বিগত আমলে বিরোধী মতের যেসব গেজেট হয়েছিল তার একটি বড় অংশ নানা অজুহাতে বা পুনতঃদন্তের নামে বাতিল করা হয়েছিল।
প্রসঙ্গত, বিভিন্ন সরকারের আমলে পাঁচবার মুক্তিযোদ্ধার তালিকা হয়েছে। ১৯৮৬ সালে প্রথম জাতীয় কমিটি এক লাখ দুই হাজার ৪৫৮ জন মুক্তিযোদ্ধার নাম প্রকাশ করেছিল। ১৯৮৮ সালে মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের করা তালিকায় মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ছিল ৭০ হাজার ৮৯২। ১৯৯৪ সালে করা তৃতীয় তালিকায় ৮৬ হাজার মুক্তিযোদ্ধা অন্তর্ভুক্ত হন। ১৯৯৮ থেকে ২০০১ সালে মুক্তিযোদ্ধা কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিল থেকে চতুর্থ তালিকায় এক লাখ ৫৪ হাজার ৪৫২ জনের নাম মুক্তিবার্তায় প্রকাশিত হয়।
বীর মুক্তিযোদ্ধা খ. ম. আমীর আলী তাঁর যুদ্ধকালীন সময়ের বর্ণনায় জানান, ৭ই মার্চ ১৯৭১ সাল রেইসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষন শোনার পর আমি আমাদের হাতে যা ছিল তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেল করার জন্য মুক্তিযুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়ি। প্রথমেই আমি কয়েকজন ছাত্র, সাবেক সেনা সদস্য ও আনছার বাহিনীর সদস্য মিলে ঝিনাইদহের শৈলকুপা উপজেলার গাড়াগঞ্জ বাজারের পাশে পানি উন্নয়ন বোর্ডের পরিত্যক্ত বাসা এবং অফিসে মুক্তিযুদ্ধের ক্যাম্প তৈরি করি এবং মুক্তিযোদ্ধাদের খাওয়া, ট্রেনিং নেওয়া ও রাত্রিযাপনের ব্যবস্থা করি। এই ক্যাম্পে স্থানীয় জনগণ শতস্ফূর্তভাবে চাল, ডাল, কাচা তরকারি ও ডিম সহ শুকনা খাবার সরবহরাহ করতে থাকে। জমাকৃত মালামালের মধ্যে চালের পরিমান ছিল অধিক। অল্প কয়েকদিনের মধ্যে কয়েক মন চাল ক্যাম্পে জমা হয়ে যায়। উপস্থিত মুক্তিবাহিনীদের খাওয়া এবং নাস্তার ব্যবস্থা এই ক্যাম্পেই করা হতো। ক্যাম্পে উপস্থিত মুক্তিবাহিনীর সদস্য সহ আরো বেড় বাড়ি গ্রামের আনসার কমান্ডার গোলাম মস্তফা, শৈলকূপার আনছার কমান্ডার বিশারত ওস্তাদ, আনছার কমান্ডার আবেদ আলী, আনছার কমান্ডার সাইদুর রহমান, সাবেক সেনা সদস্য আলম কাজী, ইউসুফ এ্যাডভোকেট, চন্ডীপুরের সাবেক সেনা সদস্য রফি শাহ সহ স্থানীয় সর্বস্থরের স্বাধীনতার চেতণায় আগ্রহী ব্যক্তিদের সাথে নিয়ে ২৭ শে মার্চ শুক্রবার ১৯৭১ সালে শৈলকূপা থানার অন্তর্গত বড়দা বাসষ্ট্যান্ডের পাশে নদীর উপর নির্মিত নতুন ব্রিজের দক্ষিণ পাশের রাস্তা কেটে চাটাই বিছায়ে তাঁর উপর আলকাতরা দিয়ে অবিকল পিচের রাস্তার মত করে রাখি। গাড়াগঞ্জ বাজার হতে, চন্ডিপুরের মুচিদের নিকট থেকে ১৫ কেজি চালের বিনিময়ে ১৫ খানা চাটাই ক্রয় করি। এবং উপস্থিত ব্যক্তিদের কাছ থেকে চার আনা, আট আনা, এক টাকা করে নগদ অর্থ সংগ্রহ করি তারপর ঐ একই বাজার হতে দশ সের আলকাতরা ক্রয় করি।
৩০ মার্চ রাতে কুষ্টিয়া থেকে যশোর সেনানিবাসে পালানোর সময় এক কোম্পানী পাকসেনা ওই ফাঁদে পড়ে। চারদিকে গগণবিদারী জয় বাংলা স্লোগানে তারা দিশেহারা হয়ে আশেপাশের বনে লুকিয়ে পড়ে। পরদিন সকালে জনতা দেশীও অস্ত্র, দা-কুড়াল দিয়ে প্রায় ৪১ জন পাকসেনাকে কুপিয়ে ও পিটিয়ে জখম ও হত্যা করে। বন্দি হয় পাক লেফটেন্ট আতাউল্লা খান। এ যুদ্ধ জয়ের খবর বিদেশি মিডিয়াতে ব্যাপক প্রচার হয়। আশেপাশের গ্রামে এলোপাথাড়িভাবে পাক আর্মিদের উপর স্থানীয় জনসাধারণ দেশীও অস্ত্র, লাঠি, বল্মম ও ইট-পাথর দিয়ে আঘাত করে এক প্লাটুন সৈন্য হত্যা ও জখম করে। তাদের মধ্যে বিভিন্ন গ্রামে মৃতদের কবর দেওয়া হয়। এর মধ্যে ৭জন পাক সেনাকে জখম করে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য গাড়াগঞ্জের পানি উন্নয়ন বোর্ডে অবস্থিত মুক্তিবাহিনী ক্যাম্পে আমার কাছে পাঠায়। আমি কয়েকজন আনছার সদস্যদের সাথে নিয়ে পাকসেনাদের জিজ্ঞেসাবাদ করে তাদের একের পর এক হত্যা করে গাড়াগঞ্জ বাজারের পাশে খেয়াঘাটে স্থানীয় লেবারদের ৪০ সের চালের বিনিময়ে বড় একটি গর্ত করে তাদের সহায়তায় ৭ জন পাক আর্মিকে নদীর চরে গণকবর দিয়ে রাখি। এই খবর আজ পর্যন্ত সরকারের কোন সংস্থার নিকট পৌছায়নি কারণ আমি ছাড়া কেউই এ খবর জানে না।
এরপর গাড়াগঞ্জ ছেড়ে ঝিনাইদহ শহরে চলে যাই। সেখানে আমাদের সাবেক ঝিনাইদহ মহকুমার এস.ডি..পি.ও জনাব মাহবুব উদ্দিন আহমেদ সাহেবের সাথে দেখা করি। তিনি আমাদের ঝিনাইদহ থেকে অস্ত্র দিয়ে ট্রেনিং দিয়ে সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহনের দায়িত্ব প্রদান করেন।
আমরা তখন ঝিনাইদহ মহকুমার ঝিনাইদহ সদর থানার বিষয়খালি ব্রিজের উত্তর পাশে এবং পাক আর্মিরা দক্ষিণ পাশে সরাসির যুদ্ধ হয়। ঐ যুদ্ধে আমাদের ৫ জন মুক্তিযোদ্ধা শহিদ হন। এরপর পাক আর্মি ঝিনাইদহ শহরের দিকে অগ্রসর হতে থাকে, ঐ সময় উক্ত মাহবুব উদ্দিন আহমেদ এর নেতৃত্বে ট্রাকে করে আমরা ভারতে চলে যাই। ভারতে গিয়ে প্রথমে মাজদিয়া ক্যাম্পে অবস্থান করি। তারপর জনাব তোফায়েল আহমেদ সাহেবের নির্দেশ মোতাবেক মাজদিয়া শহরে হাজারী বাবু নামক এক ব্যক্তির গোডাউনের দ্বিতীয় তলায় রিক্রুটিং ক্যাম্প স্থাপন করে ঝিনাইদহ অঞ্চলের ছেলেদেরকে রিক্রুট করি। তারপর মাঝে মাঝে বাংলাদেশের ভিতরে এসে যে সমস্থ তরুণরা ভারতে যায় নাই তাদেরকে ভারতে নিয়ে যায় এবং রানাঘাট ক্যাম্পে রেখে ট্রেনিং দিয়ে বাংলাদেশের ভিতর পৌছে দেই। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ঝিনাইদহ মহাকুমার মুক্তিযোদ্ধা ও রাজাকারদের সকল অস্ত্র আমি জমা নিয়ে ঝিনাইদহ কে.সি. কলেজের সামনে অবস্থিত আই.বি. (ইন্সেপ্যাকশন বাংলো)-তে রাখি। পরে সরকারের নির্দেশ মত এক সাথে জমা দিয়ে দেই। ঝিনাইদহ দখলের পর পাকসেনারা ক্যাডেট কলেজে ঘাটি গেড়ে বসে। কৌশলগত দিক থেকে তাদের কাছে ঝিনাইদহের অবস্থা ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাদের সহযোগিতায় দালাল জুটে যায়। পাকসেনাদের গণহত্যায় সহযোগী ছিল রাজাকার ও দালালরা। গ্রামে গ্রামে তারা চড়াও হয়ে ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ চালায়, লুটপাট শেষে ঘরবাড়ি জ¦ালিয়ে দেয়। এপ্রিল মাসের শেষদিকে পাকসেনারা শৈলকূপায় এসে বাড়িঘরে লুটপাট চালানোর পর ৬ জনকে এক সাথে গুলি করে হত্যা করে। ১৯৭১-এর ১ জুলাই ভোরে পাকবাহিনী শৈলকূপা থানার বসন্তপুর, জয়ন্তিনগর ও ছোট বোয়ালিয়া গ্রাম ঘিরে ফেলে। মুক্তিযোদ্ধােদর খোঁজে বাড়ি বাড়ি তল্লাশী চালায়, কাউকে না পেয়ে নারী ধর্ষন শুরু করে। পরে তারা লোকজন ধরে এনে ব্রাশ ফায়ার করে, এতে ১৯ জন শহীদ হন। আহত হন আরো ২০-২৫ জন। ২৬ নভেম্বের রাতে শৈলকূপা উপজেলার কামান্না গ্রামেও গণহত্যা চালায়। পাকসেনা ও তাদের দোসর রাজাকাররা হত্যা করে গণকবর দেয় ২৭ জন বীর মুক্তিযোদ্ধাদেরকে। এখনও সেই গণকবর মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি বহন করে চলছে।
২৬ অক্টোবর হরিনাকুন্ড উপজেলার বাগআঁচড়া ঘাট দেখিয়ে দেওয়ার কথা বলে পাবনার একদল মুক্তিযোদ্ধাকে কুষ্টিয়ার বিত্তিপাড়ায় পাকসেনাদের হাতে তুলে দেয় দালালরা। নির্মমভাবে হত্যা করা হয় তাদের। এরকম আরো অনেক গনহত্যার ঘটনা ঘটে গোটা জেলা জুড়ে। সব তথ্য সংগ্রহ করা হয়নি আজও।
এদিকে ভারত থেকে ট্রেনিং নিয়ে দেশে ফিরে মহেশপুর উপজেলার গুগরীপান্তাপাড়াতে আমরা ক্যাম্প স্থাপন করি। আমাদের এই ক্যাম্প থেকে দত্তনগর কৃষি খামারের দোতলায় পাক আর্মিদের ক্যাম্পের পর্যবেক্ষণ টাওয়ার লক্ষ করে এলএমজি দিয়ে গুলি করি। এই অপারেশনের মধ্য দিয়ে ঐ পর্যবেক্ষণ টাওয়ার ধ্বংস করে দেই। এর প্রতিবাদে নিতে পাকসেনারা পান্তাপাড়াতে অভিযান চালালে ঐ স্থানের পানি কাদায় তারা নাস্তানুবাদ হয়ে যায়। সেই সুযোগে আমরা গ্রামবাসীর সহায়তায় তাদের উপর হামলা করে ২৫-৩০ জন পাকসেনা ও রাজাকারদের হত্যা করি।
১৪ অক্টোবর শৈলকূপার আবাইপুরে পাকসেনাদের সাথে মুক্তিযোদ্ধাদের তুমুল যুদ্ধ হয়। এ যুদ্ধে ১৭ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। পাকসেনাদেরও যতেষ্ট ক্ষয়ক্ষতি হয়।
ডিসেম্বর মাসে পুরোপুরি যুদ্ধ শুরু হলে পাকসেনারা আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। ৫ ডিসেম্বর মিত্র বাহিনী ঝিনাইদহ শহরের উপকন্ঠে পৌঁছে যায়। আমরা ও পাশাপাশি অবস্থান নিয়ে শহর ঘেরাও করে ফেলি। ৬ ডিসেম্বর সকালে পাকবাহিনীর অবস্থানগুলোতে মিত্রবাহিনী গোলাবর্ষন শুরু করে।
দুপুর হতেই পাকবাহিনী ঝিনাইদহ ছেড়ে মাগুরার দিকে পালিয়ে যায়। হানাদার মুক্ত হয় ঝিনাইদহ। মুক্তির আনন্দে মানুষ ঘর থেকে বেরিয়ে বিজয় উল্লাস করে।
স্বাধীনতার ৫২ বছর পর আমাদের অনেকেই আজ বেচেঁ নেই। যারা আছেন, বৃদ্ধ হয়ে পড়ায় তেমন কোন কাজ করতে পারেন না, চরম আর্থিক সংকটে হিমশিম খাচ্ছেন। আমার দুঃখ একটাই বর্তমানে সমাজে অমুক্তিযোদ্ধারা মুক্তিযোদ্ধা সেজে সুযোগ সুবিধা ভোগ করছে। আর প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারা বৃদ্ধ বয়সে বিনা চিকিৎসায় চরম সংকটের মধ্যে অনাহারে, অর্ধাহারে দিন যাপন করছে। এই আমার ১৯৭১ সালের বাংলাদেশ স্বাধীনতা সংগ্রামের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস।
আমার উপর অর্পিত দায়িত্ব সুচারুরূপে পালন করে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য ভালোকিছু করার জোর প্রচেষ্টা চালিয়ে যাবো।
জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের কার্যক্রমসমূহের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কার্যক্রম হলো:
মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে জাতীয় পর্যায়সহ জেলা, থানা, ইউনিয়ন ও গ্রাম পর্যায়ে সামাজিক ও অর্থনৈতিক কর্মসূচী গ্রহন।
রাষ্ট্রীয় ও সমাজ জীবনের সকল স্তরে মুক্তিযুদ্ধের আর্দ্শ সমুন্নত রাখা ও কার্যকরী করার লক্ষ্যে সকল শ্রেণীর শিশু-কিশোর, যুবক, ছাত্র, শ্রমিক, শিক্ষক, কৃষক, মহিলা, ব্যবসায়ী, সাংস্কৃতিক কর্মী ও সকল শ্রেণীর পেশাজীবিদের সমন্বয়ে বিভিন্ন পর্যায়ে অংগ সংগঠন গঠন, নিয়ন্ত্রণ ও তত্ত্বাবধান।
মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধা সংশ্লিষ্ট সকল সংগঠন, সংঘ, সমিতি, যে নামে অভিহিত হউক না কেন পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় নীতিমালা প্রণয়ন।
মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধা সংশ্লিষ্ট সকল সংগঠনের নিবন্ধীকরণ।
মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধা সংশ্লিষ্ট সকল সংগঠনের নিবন্ধীকরণ ফিস, নবায়ন ফিস ইত্যাদি নির্ধারণ।
মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও স্মৃতি রক্ষার্থে গৃহীত প্রকল্প পরিচালনা, নিয়ন্ত্রণ ও তত্ত্বাবধান এবং ভবিষ্যৎ প্রকল্প গ্রহন।
সরকারী ও বেসরকারী ব্যক্তি, সংস্থা ও সংগঠন কর্তৃক মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, স্মৃতি, আদশ সংক্রান্ত সৈাধ, ভাস্কয্র্, যাদুঘর ইত্যাদি নির্মাণের অনুমতি প্রদান, রক্ষণাবেক্ষণ, নিয়ন্ত্রণ ও তত্ত্বাবধান।
প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা প্রণয়ন, সনদপত্র ও প্রত্যয়নপত্র প্রদানে এবং জাল ও ভূয়া সনদপত্র ও প্রত্যয়নপত্র বাতিলের জন্য মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের নিকট সুপারিশ প্রেরণ।
মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধা সংশ্লিষ্ট অন্যান্য বিষয় সর্ম্পকিত কার্যাবলী সম্পাদন।