সোমবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ০৪:৫৩ অপরাহ্ন
দিলীপ কুমার দাস (জেলা প্রতিনিধি): পঁচিশ বছর আগের কথা। তখন আমার বয়স পাঁচ বছর। গ্রামের সমবয়সীরা স্কুলে যায়। কিন্তু আমি প্রতিবন্ধী হওয়ায় স্কুলে যেতে পারতাম না। একদিন হামিদ ভাইজানকে বললাম-আমি স্কুলে যাবো, লেখাপড়া শিখবো। একদিন ভাইজান আমাকে গ্রামের বেসরকারি স্কুলে নিয়ে গেলেন। কিন্তু প্রধান শিক্ষক বললেন আমার স্কুলে কোনো প্রতিবন্ধীকে ভর্তি করা হবে না। তখন থেকেই লেখাপড়ার জন্য মনে জেদ চেপে বসে। ভর্তি হই পাশের গ্রামের মাদরাসায়। এরপর নানা প্রতিকূলতার মুখোমুখি হয়ে ময়মনসিংহের আনন্দ মোহন কলেজ থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিষয়ে মার্স্টাস সম্পন্ন করি। পড়াশোনা শেষে গ্রামেই প্রতিষ্ঠা করি ‘এম আর শিক্ষা সংবাদ বিদ্যালয়’ নামে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়। এখন সেখানে প্রধান শিক্ষকের দায়িত্বে আছি”।
এই প্রতিনিধির কাছে নিজের বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার গল্পটা বলছিলেন প্রতিবন্ধী যুবক ফারুক আহমেদ (৩১)। তার বাড়ি ময়মনসিংহের তারাকান্দার সাধুপাড়া গ্রামে। বাবা-মৃত আব্দুর রহমান। তিন ভাই ও পাঁচ বোনের মধ্যে ফারুক ৬ষ্ঠ।
পরিবারের সদস্যরা জানান, ফারুক জন্ম থেকে প্রতিবন্ধী ছিলেন না। ১৮ মাস বয়সে পোলিও রোগে আক্রান্ত হয়ে তার দুটো পা নিশ্চল হয়ে যায়। বয়স বাড়ার সাথে সাথে দু হাতে ভর দিয়ে চলাফেরা শুরু করেন। তবে এখন বিশেষ রিকশায় চলাচল করেন তিনি।
মঙ্গলবার সকালে সাধুপাড়া গ্রামে ফারুকের বাড়িতে প্রবেশ করতেই বিদ্যালয়ের টিনশেড ঘর থেকে শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার কলরব ভেসে আসছিলো। ভেতরে গিয়ে পায়ে ভর দিয়ে ফারুক আহমেদ শ্রেণিকক্ষে ঘুরে ঘুরে পাঠদান করাচ্ছেন। পাঠদান শেষে এই প্রতিনিধির সাথে কথা হয় তার। তিনি বলেন, “অনার্স পাশ করার পর চাকরির জন্য বিসিএস সহ সরকারি বেসরকারি বিভিন্ন পরীক্ষায় অংশ নিলেও ভালো করতে পারিনি। দু-এক জায়গায় হলেও চাকরির ধরণ পছন্দ হয়নি। এরই মাঝে জাতীয় একটি দৈনিকে ‘কোনো বাঁধায় দমে যাননি ফারুক’ শিরোনামে খবর প্রকাশ হলে চ্যানেল আইয়ের সাংবাদিক মোস্তফা মল্লিক ও ঢাকার ক্যামব্রিয়ান স্কুল এন্ড কলেজের প্রতিষ্ঠাতা ও অধ্যক্ষ লায়ন এম কে বাশার আমার বাড়িতে আসেন। পরে তাদের অনুপ্রেরণা ও সহযোগিতায় গ্রামেই ২০১৭ সালের ১৮ জানুয়ারি একটি টিনশেড ঘরে এম.আর. শিক্ষা সংবাদ বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠা করি।
বিদ্যালয়টিতে প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত শাখা রয়েছে। শুরুর দিকে ৫০ জন শিক্ষার্থী নিয়ে যাত্রা শুরু করলেও এখন শিক্ষার্থীর সংখ্যা ১২০ জন। কর্মরত ৭ জন সহকারি শিক্ষক স্বপ্রণোদিতো হয়েই এখানে পাঠদান করাচ্ছেন নাম মাত্র বেতনে।
প্রথম দিকে শিক্ষার্থীদের বিদ্যালয়ের মেঝেতে চট বিছিয়ে পাঠদান দেয়া হলেও এখন বেঞ্চ-টেবিল পেয়েছেন। তবে শিক্ষকদের জন্য কোনো অফিস কক্ষ না থাকায় খোলা আকাশের নিচে দাপ্তরিক কাজ করতে হয়। এছাড়াও ভবন সঙ্কট, শিক্ষা সরঞ্জামাদির অভাব, চিত্তবিনোদন ও বিদ্যুৎ ব্যবস্থা না থাকা সহ নানা সঙ্কট রয়েছে।
সাধুপাড়া গ্রামের বাসিন্দা আব্দুর রশিদ বলেন, ফারুক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করার পর গ্রামের দরিদ্র শিক্ষার্থীরা পড়াশোনার সুযোগ পেয়েছে। কিন্তু শিক্ষার্থীরা বিস্কুট ও উপবৃত্তি সুবিধা পাচ্ছেনা। ফ্যান না থাকায় গরমে শিক্ষার্থীদের কষ্ট হচ্ছে। এ বিষয়ে কর্তৃপক্ষের একটু নজর দেয়া প্রয়োজন।
ফারুক আহমেদ বলেন, আমার সব স্বপ্ন এই বিদ্যালয়টিকে ঘিরেই। কিন্তু আর্থিক সঙ্কট ও সরকারি ভাবে অবকাঠামোগত সুযোগ সুবিধা না পাওয়ায় সেই স্বপ্ন মুখ থুবড়ে পড়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। তারপরও নানা সঙ্কট মোকাবিলা করে পাঠদান চালিয়ে যাচ্ছি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে আমার দাবি বিদ্যালয়টিকে দ্রুত জাতীয়করণ করা হোক।
জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার মোফাজ্জল হোসেন বলেন, “প্রতিবন্ধী ফারুকের বিদ্যালয়টি প্রাইভেট হওয়ায় এখানকার শিক্ষার্থীদের সরকারি ভাবে বিস্কুট ও উপবৃত্তি দেয়ার সুযোগ নেই। পাশাপাশি অবকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধাও আমাদের পক্ষ থেকে দেয়া সম্ভব নয়। তারপরও বিষটি আমি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানাবো”।