বুধবার, ২৭ নভেম্বর ২০২৪, ০২:৩২ পূর্বাহ্ন
নিজস্ব প্রতিবেদক: ঢাকা-বরিশাল নৌরুটের বিলাশবহুল লঞ্চ সুন্দরবন-১১। লঞ্চটির যাত্রীদের গতিবিধির দিক নজর রাখতে প্রবেশদ্বারে একটি ক্লোজসার্কিট টিভি ক্যামেরা (সিসিটিভি) স্থাপন করা হয়েছে। প্রায় সাড়ে তিন শত ফুট দৈর্ঘ্যের তিন হাজার ধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন তিন তলা বিশিষ্ট এ লঞ্চটির প্রথম, দ্বিতীয় এবং তৃতীয় তলার কোথাও সিটি টিভি ক্যমেরা স্থাপন করা হয়নি। একমাত্র সিসিটিভি ক্যামেরাটও রাতে থাকে বন্ধ। এ অবস্থা শুধু সুন্দরবন-১১ লঞ্চের নয়। এই রুটে চলাচলকারী প্রত্যেকটি লঞ্চেরই। ফলে ঢাকা-বরিশালসহ দক্ষিণাঞ্চলের নৌরুটে চলাচলকারী লঞ্চে সংঘটিত হচ্ছে খুনসহ নানা ধরনের অপরাধ। গত এক বছরে বিভিন্ন লঞ্চ থেকে ছয়জনের লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ।
২০১৫ সালের জানুয়ারি মাসে যাত্রীদের নিরাপত্তা জোরদার ও নজরদারি বৃদ্ধিতে ঢাকা-বরিশাল রুটে চলাচলকারী প্রত্যেকটি লঞ্চের সামনে, প্রথম শ্রেণীর কেবিন এলাকায়, প্রতিটি ডেকে প্রয়োজনীয় সংখ্যক সিসি ক্যামেরা স্থাপনের সিদ্ধান্ত হয়। এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে লঞ্চ মালিকদের নির্দেশও দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু ওই নির্দেশনা কাগজে কলমেই সীমাবদ্ধ রয়ে গেছে।
নিদের্শনার পরে প্রথম দিকে হাতে গোনা কয়েকটি লঞ্চের প্রবেশদ্বারে ও কেবিন জোনে নামেমাত্র সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপন করা হয। তাও দীর্ঘ দিন রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে বেশিরভাগ ক্যামেরা অচল হয়ে পড়ে আছে। যে কয়টি লঞ্চের ক্যামেরা সচল আছে তাও রাতে বন্ধ থাকে। আর এর প্রমাণ মেলে সুন্দরবন-১১ থেকে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) ও পুলিশের পক্ষ থেকে লঞ্চের ভিডিও ফুটেজ সংগ্রহ করতে গিয়ে। এছাড়া কেবিন বুকিং নেওয়া ও লঞ্চে ওঠার সময়ে যাত্রীদের পরিচয়পত্রের ফটোকপি জমা দেওয়াও বাধ্যতামূলক করা হয়েছিল। ওই নিয়ম কয়েক দিন চালু থাকলেও পরে তা বন্ধ হয়ে যায়।
সিআইডি বরিশাল জোনের উপ-পরিদর্শক মো. জাহাঙ্গীর আলম কালের কণ্ঠকে বলেন, খবর পেয়ে ক্রাইমসিন সংগ্রহের সময় লঞ্চের সিসিটিভির ফুটেজ সংগ্রহ করতে গিয়ে দেখা যায় রাত ১২টার পর থেকে ওই ক্যামেরাটি বন্ধ রাখা হয়েছে। এছাড়া এতো বড় লঞ্চের দুইতলা, তিনতলা এবং ছাদে ওঠার সিঁড়ি এবং দুইটি ডেকের কোথাও সিসিটিভি ক্যামের স্থাপন করা হয়নি। লঞ্চের ডেক ও সিঁড়িতে ক্যামেরা থাকলে দ্রুত অপরাধীদের শনাক্ত করা সম্ভব হতো।
গত দেড় বছরে ঢাকা থেকে বরিশালগামী বিভিন্ন লঞ্চ থেকে ৬টি লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। এছাড়া যাত্রীদের নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়া, ঠেলে ফেলে দেয়া এবং লঞ্চে চুরি, টানা পার্টি, মলমপার্টি ও ছিনতাইকারীদের ঘটনা তো রয়েছেই। গত মঙ্গলবার ১৮ নভেম্বর সকালে ঢাকা থেকে বরিশাল নদীবন্দরে আসা এমভি সুন্দরবন-১১ লঞ্চের ছাদ থেকে শামীম নামে এক যুবকের রক্তাক্ত লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। গত ১৪ সেপ্টেম্বর ঢাকা থেকে বরিশালগামী এমভি পারাবাত-১১ লঞ্চের স্টাফ কেবিন থেকে জান্নাতুল ফেরদৌস লাবনী (২৯) নামে এক যাত্রীর লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। গত ১৪ নভেম্বর রাতে ঢাকাগামী একটি লঞ্চ থেকে নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়েন ফাল্গুনী আক্তার নামে এক শিক্ষিকা। ওই রাতেই নদীতে মাছ শিকাররত জেলেরা তাকে অর্ধমৃত অবস্থায় উদ্ধার করেন। ১৬ জানুয়ারি টিপু-৭ লঞ্চের ২৩৮ নম্বর থেক মেহেদি হাসান নামে এক যাত্রর মৃতদেহ উদ্ধার করে কেরানীগঞ্জর থানা পুলিশ।
এছাড়া ২০১৯ সালের ২৩ ডিসেম্বর পাতারাবাত-১২ লঞ্চ থেকে সেলিম হাসান নামে এক যুবকের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। একই বছর ২০ জুলাই সুরভী-৮ লঞ্চ থেকে আঁখি আক্তার নামে এ নারীর লাশ উদ্ধার করা হয়। ওই বছর ৮ সেপ্টেম্বর গলাচিপাগামী এমভি বাগেরহাট-২ থেকে অজ্ঞাত এক নারীর লাশ উদ্ধার করে পটুয়াখালীর কোতোয়ালী থানার পুলিশ।
ক্রিসেন্ট নেভিগেশনের স্বত্ত্বাধিকারী রেজীন উল কবির বলেন, লঞ্চের সিসি ক্যামেরা স্থাপনের প্রধান সমস্যা বিদ্যুত ও দক্ষ অপারেটর। লঞ্চে জেনারেটরের মাধ্যমে বিদ্যুৎ দিয়ে বিজলী বাতি ও টেলিভিশন চালু রাখা হয়। ওই বিদ্যুৎ দিয়ে কম্পিউটার চালু রাখা যায় না। জেনারেটরের বিদ্যুৎ ভোল্টে ওঠানামা করায় সিসি ক্যামেরা ও কম্পিউটার নষ্ট হয়ে যায়। এছাড়া পুরো লঞ্চে সিসিটিভি ক্যামেরা চালু করতে প্রায় কোটি টাকা দরকার।
বিআইডব্লিউটি এর উপ পরিচালক ও বরিশাল নৌবন্দর কর্মকর্তা মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, বরিশাল-ঢাকা নৌরুটের যাত্রীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে লঞ্চগুলোতে প্রয়োজনীয় সংখ্যক সিসি ক্যামেরা স্থাপানের জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। ওই নির্দেশনা কেউ বাস্তবায়ন করেছে, আবার কোনো কোনো লঞ্চমালিক বাস্তবায়ন করেননি। মালিকদের লঞ্চে সিসি ক্যামেরা স্থাপনের জন্য পুনরায় নির্দেশনা দেওয়া হবে।