রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ১০:০৩ পূর্বাহ্ন
ক্রীড়া ডেস্কঃ বাংলাদেশ দলের দেশে ফিরতে তখনো ঘণ্টা দুয়েক বাকি। এর মধ্যেই রাজধানীর ওল্ড ডিওএইচএসে তামিম ইকবালের বাসায় আত্মীয়-স্বজনের ভিড়। ক্রাইস্টচার্চের নূর মসজিদে বন্দুকধারীর হামলা থেকে অল্পের জন্য বেঁচে যাওয়া ক্রিকেটারদের দেখার অপেক্ষায় এমন ভিড় গত রাতে নিশ্চিতভাবেই অন্যদের বাসায়ও হয়েছে।
সবাই ফিরেছেন, রাত ১০টা ৪০ মিনিটের ফ্লাইটে। ক্রাইস্টচার্চ থেকে সিঙ্গাপুর হয়ে ঢাকা। দীর্ঘ ভ্রমণ-ক্লান্তির সঙ্গে এর আগের দুঃসহ অভিজ্ঞতা
যোগ হয়ে একেকজনের রীতিমতো বিধ্বস্ত অবস্থা। এমনই যে, বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) মিডিয়া কমিটির প্রধান জালাল ইউনুস আগে থেকেই বলে রাখলেন—অধিনায়ক মাহমুদ উল্লাহকে কোনো প্রশ্ন করা যাবে না। কেউ করলেনও না। সাকিব আল হাসানের অনুপস্থিতিতে দুই টেস্টে দলকে নেতৃত্ব দেওয়া ক্রিকেটার বলছিলেন, ‘আমরা যখন রুমের মধ্যে (ঘটনার রাতে হোটেলে) ছিলাম তখন একটি কথাই শুধু মনে হচ্ছিল যে আমরা কতটা ভাগ্যবান।’
সেই সঙ্গে বীভৎস ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী হওয়ার যে মানসিক ধাক্কা, সেটি সামলে ওঠার জন্য দেশবাসীর দোয়াও চেয়েছেন মাহমুদ, ‘দেশবাসীর প্রতি বলব, আমাদের জন্য দোয়া করবেন; যেন আমরা এই মানসিক অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে পারি। নিউজিল্যান্ড ক্রিকেট বোর্ডকে ধন্যবাদ, একই সঙ্গে ধন্যবাদ বিসিবিকেও।’ রাতে সভাপতি নাজমুল হাসান থেকে শুরু করে বিসিবির অনেকেই গিয়েছিলেন হযরত শাহজালাল বিমানবন্দরে। সেখানে ছিলেন যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী মো. জাহিদ আহসান রাসেলও।
বিসিবি সভাপতি আপাতত ক্রিকেটারদের সব কিছু ভুলে থাকার জন্য দিয়েছেন এমন পরামর্শ, ‘একটু আগে রিয়াদ আমাকে বলেছে ওরা সারা রাত (ঘটনার দিন) ঘুমাতে পারেনি। এরপর এই ২২ ঘণ্টার ভ্রমণ। এত লম্বা ভ্রমণে সবাই ক্লান্ত। মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছে অনেকেই। এখন ওদের সঙ্গে কথা বলারও কিছু নেই। আমরা সবাই ওদের বলেছি—যাও, বাসায় যাও। সব কিছু বাদ দিয়ে, ঠাণ্ডা মাথায় নিজেদের মতো করে যা ভালো লাগে সেভাবে কাটাও। সব কিছু ঠাণ্ডা হলে এরপর আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ কোরো। খেলাধুলা নিয়ে এই মুহূর্তে কোনো চিন্তাভাবনা করবে না।’
এমন এক দেশ থেকে দুঃসহ স্মৃতি নিয়ে ফিরেছেন বাংলাদেশের ক্রিকেটাররা, হাহাকার আছে সেখানেও। গতকাল শনিবার নিউজিল্যান্ডের একটি দৈনিকের প্রধান শিরোনামজুড়ে সেটিই প্রকাশিত, ‘দি এন্ড অব আওয়ার ইনোসেন্স’। সন্ত্রাসের কালো থাবায় নিজেদের নিষ্কলুষ ভাবমূর্তি লুটোপুটি খেতে দেখে ব্যথিত ছবির মতো সুন্দর দেশটির শান্তিপ্রিয় মানুষগুলো। প্রচণ্ড ভীতি মনে নিয়েও তাই দেশটির প্রতি সমবেদনা ঝরেছে মুশফিকুর রহিমের কণ্ঠে, ‘এর পরও আমরা নিউজিল্যান্ডকে ভালোবাসি।’
কয়েক মিনিটের জন্য মৃত্যুর হাত থেকে রেহাই পাওয়ার উচ্ছ্বাস নেই বাংলাদেশি কোনো ক্রিকেটারের প্রতিক্রিয়ায়।
শুক্রবারের ঘটনার পর সিরিজ অসমাপ্ত রেখে গত রাতে দেশে ফেরা ক্রিকেটারদের অভিব্যক্তিতে আতঙ্কের রেশ রয়েই গেছে। সন্ত্রাসী ব্রেন্টন টারান্টের গুলি কাউকে স্পর্শ না করলেও রাস্তায় পড়ে থাকা হতাহতদের তো দেখেছেন তামিম ইকবালরা। গতকাল স্থানীয় সময় দুপুরে ক্রাইস্টচার্চ থেকে ঢাকার ফিরতি ফ্লাইট ধরার আগে সে আতঙ্কের কথাই স্থানীয় গণমাধ্যমকে বলেছেন তামিম, ‘এ ঘটনার ধাক্কা সামলাতে অনেক সময় লাগবে।’
হৃদয়বিদারক এ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে এই প্রথমবারের মতো হোটেল থেকে বিমানবন্দরে নিজেদের চারপাশে সশস্ত্র নিরাপত্তাকর্মী দেখেছেন মাহমুদ উল্লাহরা। নিউজিল্যান্ডে কোনোকালেই নিরাপত্তার বাড়াবাড়ি ছিল না। ওয়েলিংটনে দেশটির প্রধানমন্ত্রীর বাড়ির সামনে বাড়তি নিরাপত্তা বলে কিছু নেই। বিমানবন্দর কিংবা গুরুত্বপূর্ণ কোনো স্থাপনা ঘিরেও সশস্ত্র পাহারা চোখে পড়ে না। শান্তি বজায় রাখার জন্য সন্ত্রাসবাদ দমনের নামে বহুজাতিক বাহিনীতেও নাম লেখায় না নিউজিল্যান্ড। আর সে দেশেই সন্ত্রাসীর হাতে কয়েক মিনিটে প্রাণ গেল ৪৯ জনের!
হতচকিত নিউজিল্যান্ড সরকারের তাত্ক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় সশস্ত্র পাহারা পেয়েছে বাংলাদেশ দল। বিমানবন্দরে ঢাকাগামী ফ্লাইটে ওঠার আগে সবার চোখে-মুখেই দেখা গেছে উদ্বেগের ছাপ। বার্তা সংস্থা সিনহুয়ার প্রতিনিধি বাংলাদেশ দলের চেকইনসংক্রান্ত ব্যস্ততার মাঝেই কথা বলেন মুশফিকুর রহিমের সঙ্গে। সে আলাপে সন্ত্রাসী হামলার পরও নিউজিল্যান্ড সম্পর্কে ভালোলাগার কথাই জানিয়েছেন মুশফিক, ‘বিশ্বের সেরা দেশগুলোর একটি নিউজিল্যান্ড। এর পরও আমরা নিউজিল্যান্ডকে ভালোবাসি।’ তবে মৃত্যুকে অতটা কাছ থেকে দেখার আতঙ্ক তখনো মুশফিকের চোখে-মুখে। গভীর সমবেদনা জানিয়েছেন তিনি সন্ত্রাসী হামলায় নিহতদের পরিবারকে। মুশফিকের বেঁচে ফিরতে পারার প্রতিক্রিয়াও সে শোকে ভারী, ‘হুম, ভাগ্য যে আমরা এখনো বেঁচে আছি।’