রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ০২:২৮ পূর্বাহ্ন
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়ার কারাদন্ডকে প্রকৃতির অমোঘ বিধান উল্লেখ করে বলেছেন, অতীত দুর্নীতি এবং মানুষ পুড়িয়ে হত্যার সাজাই তিনি পেয়েছেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, মানুষের ওপর অত্যাচার করলে আল্লার আরশও কেঁপে যায়। যারা মানুষকে পুড়িয়ে হত্যা করেছে তার বিচার এমনি হয়। সেই বিচারই হচ্ছে।
তিনি বলেন, ২০১৫ সালে খালেদা জিয়া তার অফিসে বসে বলেছে, আওয়ামী লীগ সরকার উৎখাত না করে ঘরে ফিরবে না। হাজার হাজার গাড়ি ভাংচুর করেছে। ২০১৩, ১৪, ১৫ সালে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে ৫ শতাধিক মানুষ হত্যা করেছে। ৩ হাজারেরও বেশি মানুষকে পুড়িয়ে আহত করেছে। আর করেছে লুটপাট, দুর্নীতি। আজকে তিনি কোথায়।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আজ বরিশাল বঙ্গবন্ধু উদ্যানে জেলা আওয়ামী লীগ আয়োজিত বিশাল জনসভায় একথা বলেন। তিনি এখানে ৭৫টি উন্নয়ন প্রকল্পের উদ্বোধন ও ভিত্তিপ্রস্তরও স্থাপন করেন।
বরিশাল জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আবুল হাসনাত আব্দুল্লাহর সভাপতিত্বে জনসভায় আরো বক্তৃতা করেন দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু ও বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ, সভাপতি মন্ডলীর সদস্য কৃষিমন্ত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরী, সমাজকল্যাণ মন্ত্রী রাশেদ খান মেনন, দলের যুগ্ম সম্পাদক মাহবুব-উল-আলম হানিফ ও ডা. দীপু মনি, সাংগঠনিক সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম এবং কেন্দ্রীয় নেতা আফজাল হোসেন বক্তৃতা করেন।
বিএনপি’র মানুষ পুড়িয়ে রাজনীতি ও দুর্নীতির কঠোর সমালোচনা করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এসবের পরিণামেই খালেদা জিয়াকে আজকে শাস্তি ভোগ করতে হচ্ছে।
জিয়া অরফানেজ ট্রাস্টের অর্থ আত্মস্যাতের মামলায় খালেদা জিয়ার সাজা হওয়া সম্পর্কে বলেন, এতিমের জন্য বিদেশ থেকে টাকা এসেছে। সে টাকা এতিমের কাছে চলে যাবে, সে টাকা কেন থাকবে।
তিনি বলেন, আজকে ধরা পড়ে গেছে এতিমের টাকা মেরে। এতিমের সম্পদ মেরে খেলে তার শাস্তি আল্লাহ রাব্বুল আলামিনও দেন, সেই শাস্তি আজ খালেদা ও তারেক জিয়া পেয়েছে। লজ্জা থাকলে জীবনে আর লুটপাট ও দুর্নীতি করবে না। আদালতের রায়ে আমাদের কিছু করার নেই। কিন্তু অন্যায় করলে যে শান্তি পেতে হয় সেটা আজকে প্রমাণিত হয়েছে।
প্রাক নির্বাচনী প্রচারের অংশ হিসেবে প্রায় ৬ বছর পর প্রধানমন্ত্রী বরিশাল সফর করেন। প্রধানমন্ত্রীর এই সফরকে ঘিরে পুরো বরিশাল শহর উৎসবের নগরীতে পরিণত হয়। তোরণ, ব্যানার, ফেস্টুনে ছেয়ে যায় ছোট্ট শহরটি। সকাল থেকেই শহরের মধ্যে গাড়ি চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। দলে দলে মানুষ যেতে থাকে জনসভাস্থলের দিকে। দোকান-পাটও অধিকাংশই বন্ধ হয়ে যায়। শহরে ঢোকার মুখে রুপাতলী বাসস্ট্যান্ড এলাকার বাইরেই দুরপাল্লার যাত্রীদের নামিয়ে দেয় পরিবহনগুলো। সবার যেন একটাই গন্তব্য। বরিশাল নদী বন্দরের টার্মিনালে আশপাশের জেলা থেকে লঞ্চ ভর্তি করে হাজারো উৎফুল্ল জনতা সমাবেশে যোগ দিতে আসে।
প্রধানমন্ত্রী দক্ষিণ বাংলার জনগণের বহু আকাঙ্খিত পদ্মা সেতু নির্মাণে বিএনপি’র অসহযোগিতার সমালোচনা করে বলেন, তাঁর সরকার ২০০১ সালে পদ্মাসেতু নির্মাণের প্রকল্প গ্রহণ করেছিল এবং খালেদা জিয়া ২০০১ সালে ক্ষমতায় এসেই পদ্মা সেতুর কাজ বন্ধ করে দেয়। তাঁর সরকার ২০০৯ সালে ক্ষমতায় এসে আবার পদ্মা সেতুর নির্মাণ কাজ শুরু করে।
প্রধানমন্ত্রী পদ্মা সেতু নির্মাণ নিয়ে তাঁর সরকার এবং পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাংকের দুর্নীতির অভিযোগ দেয়ার অপচেষ্টার বিরুদ্ধে এখানে কোন দুর্নীতি হয়নি বলে তাঁর কঠোর চ্যালেঞ্জ জানানোর প্রসংগ উল্লেখ করে বলেন, রাজনীতি করেন জনগণের জন্য, তাঁদের কল্যাণের জন্য। কাজেই জনগণের টাকা মেরে খেতে ক্ষমতায় আসেননি। তিনি বলেন, কানাডার ফেডারেল কোর্ট বলেছে কোন দুর্নীতি হয় নাই।
তিনি নিজেদের অর্থায়নেই পদ্মা সেতু নির্মাণে তার সংকল্পের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেন, আজকে আপনাদের দোয়া ও আশির্বাদে সেই পদ্মা সেতু আমরা নিজেদের অর্থেই নির্মাণ করছি।
প্রধানমন্ত্রী সারাদেশের মাধ্যমিক পর্যায়ে বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক বিতরণ, বৃত্তি-উপবৃত্তি প্রদান, বৃত্তির টাকা মোবাইল ফোনের মাধ্যমে বৃত্তিপ্রাপ্তদের মায়েদের মোবাইল ফোনে পৌঁছে দেয়া, প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা সহায়তা ট্রাস্ট ফান্ড করে উচ্চশিক্ষায় সহায়তা প্রদান, ২ কোটি ৩ লাখ শিক্ষার্থীকে নিয়মিত বৃত্তি প্রদানের তথ্য উল্লেখ করেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, যেসব গ্রামে স্কুল নাই সেখানে তাঁর সরকার স্কুল করে দিচ্ছে। যেসব স্কুল রয়েছে তাঁর উন্নয়ন করে দিচ্ছে। যে সব এলাকায় বিশ্ববিদ্যালয় নাই সেখানে বিশ্ববিদ্যালয় করে দিচ্ছে। এই বরিশালেও তাঁর সরকার বিশ্ববিদ্যালয় করে দিচ্ছে। কারণ ছেলেমেয়েরা লেখাপড়া করে যাতে মানুষের মত মানুষ হতে পারে।
ইউনিয়ন স্বাস্থ্য কেন্দ্র এবং সারাদেশে কমিউনিটি ক্লিনিক করে স্বাস্থ্যসেবাকে জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেয়ার এবং বেসরকারি খাতকে উন্মুক্ত করে দিয়ে জনগণের নাগালের মধ্যে মোবাইল ফোনকে নিয়ে আসা এবং স্কুলে মাল্টিমিডিয়া ক্লাস রুম, ডিজিটাল ল্যাব করে দিয়ে দেশকে ডিজিটাইজেশনে তাঁর সরকারের উদ্যোগের কথাও তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী।
দেশের চলমান উন্নয়নের প্রসঙ্গ তুলে শেখ হাসিনা বলেন, আজ সর্বক্ষেত্রে উন্নয়নের সুবাতাস বইছে। সেই উন্নয়নের ছোঁয়া বরিশাল ও দক্ষিণাঞ্চলের সর্বত্র লেগেছে। বরিশালে অনেক ব্রিজ-কালভার্ট ও সড়ক নির্মাণ করেছি আমরা।
ভোলার গ্যাস পাইপ লাইনের মাধ্যমে বরিশালে নেয়া হবে জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ভোলা থেকে পাইপ লাইনে বরিশালে গ্যাস এনে দেয়া হবে। আর ভোলায় করা হবে পাওয়ার প্লান্ট। সেখানকার বিদ্যুৎও এখানে আসবে। বরিশাল থেকে ভোলায় যাবার জন্য নদীর ওপর সেতুও আমরা করে দেব।
তিনি বলেন, প্রতিটি ঘরে বিদ্যুৎ ও গ্যাসের শতভাগ চাহিদা পূরণ করতে কাজ করছে সরকার। ২০২১ সালের মধ্যে দেশের শতভাগ মানুষ বিদ্যুৎ পাবে। প্রতিটি ঘরে বিদ্যুতের আলো পৌঁছে দেয়া হবে।
প্রধানমন্ত্রী দেশে উন্নয়নের এই ধারা অব্যাহত রাখতে তাঁর সরকারের পুনরায় ক্ষমতায় আসার ওপর গুরুত্বারোপ করে বলেন, আপনারা নৌকা মার্কায় ভোট দিয়েছেন, আমরা দেশের উন্নয়ন করেছি। এই বছর ২০১৮’র ডিসেম্বরে আবার নির্বাচন হবে। সেই নির্বাচনে আপনাদের কাছে আমার আকুল আবেদন থাকবে উন্নযনের ধারাকে অব্যাহত রাখতে নৌকা মার্কায় ভোট দিয়ে আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের জয়যুক্ত করবেন। আমরা আওয়ামী লীগ এবং আমাদের জোটকে ভোট দেয়ার জন্য আপনাদের কাছে আহবান জানাই। কারণ আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসলেই দেশের উন্নতি হয়।
তিনি বলেন, ওই লুটপাটকারী, জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাস সৃষ্টিকারী, এতিমের টাকা লোপাটকারীদের স্থান এই বাংলার মাটিতে হবে না। তারা ক্ষমতায় আসা মানেই দেশকে ধ্বংস করে দেয়া।
শেখ হাসিনা সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ এবং মাদকের বিষয়ে সতর্ক থাকার জন্যও অভিভাবক, শিক্ষকসহ সমাজের সর্বস্তরের মানুষের প্রতি আহবান জানান।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, একমাত্র আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসলেই দেশের উন্নয়ন হয়। আপনারা নিজেরাই সেটা দেখেছেন। মাত্র ৯ বছরে আমরা বাংলাদেশকে যেভাবে উন্নয়নের ধারায় এগিয়ে নিয়ে গেছি তা আমাদের অব্যাহত রাখতে হবে।
প্রধানমন্ত্রী আগামী নির্বাচনে নৌকায় ভোট দেয়ার জন্য জনগণের ওয়াদা চাইলে বিশাল সমাবেশের উপস্থিত জনতা হাত তুলে এবং চিৎকার করে তাতে সায় দেন।
প্রধানমন্ত্রী জনগণের কাছে তাঁর ওয়াদা চাওয়ার ব্যাখ্যায় বলেন, আমি আপনাদের কাছে ওয়াদা চাই এই জন্য যে, আমারতো চাওয়া-পাওয়ার কিছু নেই। বাবা, মা, ভাই- সব হারিয়েছি। সবকিছু হারিয়ে সেই শোক ব্যাথা বুকে নিয়েও আমি কাজ করে যাচ্ছি। স্বজন হারানোর বেদনা নিয়েও আপনাদের পাশে দাঁড়িয়েছি। কারণ এই বাংলাদেশকে যেন আমার বাবার স্বপ্নের ক্ষুধা মুক্ত, দারিদ্র্য মুক্ত সোনার বাংলা হিসেবে গড়ে তুলতে পারি। তাই আপনাদের সাহায্য ও সহযোগিতা চাই।
তিনি এদেশের জনগণের মাঝেই তাঁর হারানো বাবা, মা ও ভাইদের স্নেহ ফিরে পেয়েছেন বলেও উল্লেখ করেন।