সোমবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ১২:৫৭ অপরাহ্ন
নিজস্ব প্রতিবেদক: জাতিসংঘের শিশু সহায়তা তহবিল-ইউনিসেফ প্রকাশিত নতুন এক বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে করোনা মহামারির পুরোটা সময় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার ফলে প্রাক-প্রাথমিক থেকে উচ্চতর শিক্ষার স্তর পর্যন্ত চার কোটিরও বেশি শিক্ষার্থী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে গ্রীষ্মকালীন ছুটি শেষ হওয়ার প্রেক্ষাপটে ইউনিসেফ প্রকাশিত বিশ্লেষণে আরও বলা হয়েছে, প্রায় ১৪ কোটি শিশুর ক্ষেত্রে স্কুলের প্রথম দিন, যা কিনা বিশ্বব্যাপী খুদে শিক্ষার্থী এবং তাদের মা-বাবার জন্য একটি বিশেষ মুহূর্ত, কোভিড-১৯ এর কারণে বিলম্বিত হচ্ছে। এই শিক্ষার্থীদের মধ্যে প্রায় ৮০ লাখ এমন স্থানে বসবাস করে, যেখানে মহামারির পুরো সময়ে স্কুল বন্ধ রাখা হয়েছে। এ কারণে সশরীরে শিক্ষাগ্রহণের প্রথম দিনটির জন্য তারা এক বছরের বেশি সময় ধরে অপেক্ষা করছে এবং এই অপেক্ষা বেড়েই চলেছে। এর মধ্যে বাংলাদেশের প্রায় ৪০ লাখ প্রথম বারের শিক্ষার্থীও রয়েছে।
বাংলাদেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো ২০২০ সালের ১৭ মার্চ থেকে বন্ধ রয়েছে, যা কোভিড-১৯ এর কারণে স্কুল বন্ধের ক্ষেত্রে বিশ্বের দ্বিতীয় দীর্ঘতম।
ইউনিসেফের নির্বাহী পরিচালক হেনরিয়েটা ফোর বলেন, ‘স্কুলের প্রথম দিন একটি শিশুর জীবনে উল্লেখযোগ্য এক মুহূর্ত, যা তাদের ব্যক্তিগত শিক্ষা অর্জন ও বিকাশের ক্ষেত্রে একটি জীবন পরিবর্তনকারী পথে পরিচালিত করে। আমরা প্রায় সবাই স্কুলের প্রথম দিনের অসংখ্য ছোটখাটো বিবরণ মনে রাখি—যেমন কী পোশাক পরেছিলাম, শিক্ষকের নাম, কার পাশে বসেছিলাম। তবে, লাখ লাখ শিশুর জন্য সেই গুরুত্বপূর্ণ দিনটি অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করা হয়েছে। যখন বিশ্বের অনেক জায়গায় ক্লাস পুনরায় শুরু হয়েছে, তখন প্রথম শ্রেণির লাখ লাখ শিক্ষার্থী এক বছরেরও বেশি সময় পর সশরীরে ক্লাসরুমে যাওয়ার অপেক্ষায় আছে। আরও লাখ লাখ শিশুর হয়তো এই মেয়াদেও স্কুলে একেবারেই যাওয়া হবে না। যারা সবচেয়ে ঝুঁকির মুখে রয়েছে, তাদের জীবনে আর কখনোই স্কুলে ফিরতে না পারার ঝুঁকি প্রবল বেগে বাড়ছে।’
প্রথম শ্রেণিতে পড়া, লেখা ও গণিতের সঙ্গে শিশুদের পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়, যা ভবিষ্যতের সব ধরনের শিক্ষার ভিত্তি গড়ে দেয়। একই সঙ্গে এটি এমন একটি সময়, যখন সশরীরে উপস্থিত হয়ে শিক্ষাগ্রহণ শিশুদের স্বাধীনস্বত্বার বিকাশ, নতুন নিয়মের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়া এবং শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের সঙ্গে অর্থপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তুলতে সহায়তা করে। সশরীরে উপস্থিত হয়ে শিক্ষাগ্রহণ একইসঙ্গে কোনো শিশুর শিক্ষার ক্ষেত্রে ঘাটতি, মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা ও নির্যাতনের বিষয়গুলো শনাক্ত ও সমাধান করতে শিক্ষকদের সহায়তা করে।
২০২০ সালে বিশ্বব্যাপী স্কুলগুলো গড়ে ৭৯ শিক্ষা-দিবস পুরোপুরি বন্ধ ছিল। তবে, মহামারি শুরুর পর ১৬ কোটি ৮০ লাখ শিক্ষার্থীর জন্য স্কুলগুলো প্রায় পুরো বছর বন্ধ ছিল। এমনকি এখনও অনেক শিশুকে দ্বিতীয় বছরের জন্য শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাহত হওয়ার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। স্কুল বন্ধ থাকার কারণে অনেক শিশুর, বিশেষ করে বিকাশের গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়ে থাকা ছোট শিক্ষার্থীদের, শেখার ক্ষতি, মানসিক চাপ, টিকা না পাওয়া এবং ঝরে পড়ার উচ্চ ঝুঁকি, শিশুশ্রম ও শিশুবিয়ের মতো পরিণাম ভোগ করতে হবে।
যদিও বিশ্বব্যাপী দেশগুলো দূরশিক্ষণ পদ্ধতিতে শিক্ষা প্রদানের জন্য কিছু পদক্ষেপ নিচ্ছে, তবে প্রাথমিক শিক্ষার্থীদের কমপক্ষে ২৯ শতাংশের কাছে এই শিক্ষা পৌঁছানো যাচ্ছে না। দূরশিক্ষণ পদ্ধতিতে শিক্ষা প্রদানের জন্য সম্পদ বা উপকরণের ঘাটতি রয়েছে। একই সঙ্গে খুদে শিশুরা প্রযুক্তি ব্যবহারের সহায়তা এবং শিক্ষার জন্য মানসম্পন্ন পরিবেশের অভাবে, গৃহস্থালির কাজ করার চাপে, অথবা কাজ করতে বাধ্য হওয়ার কারণে হয়তো এই পদ্ধতির শিক্ষা কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করতে পারছে না।
বাংলাদেশে মহামারির পুরোটা সময়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার ফলে প্রাক-প্রাথমিক থেকে উচ্চতর শিক্ষার স্তর পর্যন্ত ৪ কোটিরও বেশি শিক্ষার্থী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। যত বেশি সময় ধরে শিশুরা স্কুলের বাইরে থাকবে, সহিংসতা, শিশুশ্রম ও শিশুবিয়ের ঝুঁকির সম্মুখীন হওয়ায় ততই তাদের স্কুলে ফিরে আসার সম্ভাবনা কমে যাবে।
বাংলাদেশে ইউনিসেফের প্রতিনিধি টোমো হোযুমি বলেন, ‘স্কুল ও সশরীরে উপস্থিত হয়ে শিক্ষাগ্রহণ কার্যক্রম বন্ধ থাকা শিশুদের কেবল পড়াশোনার ক্ষেত্রে নয়, একইসঙ্গে তাদের স্বাস্থ্য, সুরক্ষা ও মনস্তাত্ত্বিক সুস্থতার ওপর অত্যন্ত গুরুতর প্রভাব ফেলে। প্রান্তিক শিশুরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে, যা তাদের অধিকতর দারিদ্র্য ও অসমতার দিকে ঠেলে দিচ্ছে এবং ভবিষ্যতেও দেবে। নিরাপদে স্কুল পুনরায় খুলে দেওয়া এবং সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্তদের পড়াশোনার ক্ষতি পুষিয়ে নিতে বিনিয়োগ করাকে অগ্রাধিকার দেওয়া আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের আজকের এই সিদ্ধান্ত এই শিশুদের পুরো জীবনকে প্রভাবিত করবে।’
গবেষণায় দেখা গেছে, এই অন্তর্বর্তীকালীন সময়ে স্কুলের ইতিবাচক অভিজ্ঞতাগুলো শিশুদের ভবিষ্যতের সামাজিক, আবেগীয় ও শিক্ষাগত ফলাফলের ইঙ্গিত বহন করে। একই সময়ে, যেসব শিশু শুরুর বছরগুলোতে পড়াশোনায় পিছিয়ে পড়ে, তারা প্রায় ক্ষেত্রেই স্কুলে কাটানো অবশিষ্ট সময়ের জন্য পিছিয়ে থাকে এবং বছরের পর বছর এই ব্যবধান বাড়তে থাকে। একটি শিশুর প্রাপ্ত শিক্ষা বছরের সংখ্যা তার ভবিষ্যতের আয়ের ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলে।
বিশ্বব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, সমাধানমূলক পদক্ষেপ বাস্তবায়ন করা না হলে এই পুরো প্রজন্মের শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ আয়ের ক্ষেত্রে যে পরিমাণ ক্ষতি হবে, তা প্রায় ১০ ট্রিলিয়ন ডলারের সমপরিমাণ। বিদ্যমান তথ্য-প্রমাণ বলছে, আগেভাগে সামাল দেওয়া গেলে শিক্ষাগ্রহণের ক্ষেত্রে এই ব্যবধান কমানোর খরচ অনেক কম ও কার্যকারিতা অনেক বেশি হয় এবং সে ক্ষেত্রে শিক্ষার পেছনে বিনিয়োগ অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার, প্রবৃদ্ধি ও সমৃদ্ধি অর্জনে সহায়ক হয়।
ইউনিসেফ যত শিগগির সম্ভব সশরীরে উপস্থিত হয়ে শিক্ষাগ্রহণের জন্য স্কুলগুলো পুনরায় খুলে দিতে এবং শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে সহায়তার জন্য বিস্তৃত পরিসরে পদক্ষেপ গ্রহণে সরকারগুলোর প্রতি আহ্বান জানায়। বিশ্বব্যাংক ও ইউনেস্কোর সঙ্গে মিলে ইউনিসেফ স্কুলগুলো আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনার জন্য তিনটি গুরুত্বপূর্ণ অগ্রাধিকারের প্রতি মনোনিবেশ করতে সরকারগুলোর প্রতি আহ্বান জানায় :
১. সব শিশু ও তরুণদের স্কুলে ফিরিয়ে আনার জন্য সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যভিত্তিক কর্মসূচি প্রণয়ন করা, যেখানে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, মনোসামাজিক সুস্থতা এবং অন্যান্য চাহিদা পূরণের জন্য তারা তাদের প্রত্যেকের প্রয়োজন অনুযায়ী উপযুক্ত সেবা গ্রহণের সুযোগ পাবে;
২. শিক্ষার্থীদের লেখাপড়ার ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে সহায়তা করতে কার্যকর প্রতিকারমূলক শিক্ষার ব্যবস্থা করা; এবং
৩. শিক্ষার ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে এবং শিক্ষাদান প্রক্রিয়ায় ডিজিটাল প্রযুক্তি অন্তর্ভুক্ত করার জন্য শিক্ষকদের সহায়তা দেওয়া।
ইউনিসেফের নির্বাহী পরিচালক বলেন, ‘স্কুলের প্রথম দিনটি আশা ও সম্ভাবনার দিন—একটি শুভ সূচনার দিন। তবে, সব শিশু এই শুভ সূচনার সুযোগ পায় না। এমনকি কিছু শিশু শুরুই করতে পারছে না। আমাদের যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সশরীরে উপস্থিত হয়ে শিক্ষা গ্রহণের জন্য স্কুলগুলো পুনরায় খুলে দিতে হবে এবং এই মহামারি এরই মধ্যে শিক্ষা কার্যক্রমে যে ক্ষতি করেছে, তা পুষিয়ে নিতে আমাদের অবিলম্বে পদক্ষেপ নিতে হবে। তা না করলে কিছু শিশু হয়তো কখনোই এই ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে পারবে না।’
নিরাপদে স্কুল খোলার লক্ষে ইউনিসেফ বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছে। এই কর্মযজ্ঞের অংশ হিসেবে নির্দেশিকা তৈরি করা হচ্ছে, যাতে শিশু এবং তাদের শিক্ষকেরা মাস্ক পরিধান করে, সাবান পানিতে হাত ধুয়ে স্বাস্থ্যবিধি মেনে নিরাপদে স্কুল শুরু করতে পারে। ইউনিসেফ স্কুলের শিশু, তাদের অভিভাবক ও শিক্ষকদের সঙ্গেও যোগাযোগ চালিয়ে যাচ্ছে, যাতে নিরাপদে স্কুল খুলে দেওয়ার বিষয়ে সবার মধ্যে আত্মবিশ্বাস তৈরি হয়।
আগামী কয়েক সপ্তাহে, ইউনিসেফ তার অংশীদার এবং বৃহত্তর জনগণকে সঙ্গে নিয়ে কাজ করবে, যাতে এই শিক্ষা সংকট কোনোভাবেই শিক্ষা বিপর্যয়ের দিকে ধাবিত না হয়। অনলাইন ও অফলাইন প্রচারাভিযানে বিশ্ব নেতৃবৃন্দ, শিক্ষক ও অভিভাবকদের সমন্বয়ে একটি সর্বসম্মত উদ্দেশ্য নিয়ে কাজ করবে, যাতে যত শিগগির সম্ভব সশরীরে উপস্থিত হয়ে শিক্ষা গ্রহণের জন্য স্কুলগুলো পুনরায় খুলে দেওয়া যায়। বিশ্বের সবচেয়ে অসহায় শিশুদের ভবিষ্যৎ ঝুঁকিতে রয়েছে।