মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ০৯:১৭ অপরাহ্ন

কাঁটাতার একে অপরের আলিঙ্গন আঁটকাতে পারলেও আঁটকাতে পারেনি চোখের অশ্রু!

কাঁটাতার একে অপরের আলিঙ্গন আঁটকাতে পারলেও আঁটকাতে পারেনি চোখের অশ্রু!

অন্তর রায়, ঠাকুরগাঁও প্রতিনিধি: প্রতি বছরের ন্যায় এবছরও শুক্রবার (৭ ডিসেম্বর) পালিত হলো ঠাকুরগাঁওয়ের চাপসা সীমান্তে দুই বাংলার মিলন মেলা। দু’পাশে দুই দেশের নাগরিক, মাঝে কাঁটাতারের বেড়া, দু’দেশের নাগরিকেরই চোখে জল। কাঁটাতারের বেড়া হয়তো আটকাতে পারে একে অপরের আলিঙ্গন।কিন্তু আঁটকাতে পারেনি চোখের অশ্রু,হৃদয়ের ভালোবাসা। রাণীশংকৈল কোচল ও হরিপুর চাপসা সীমান্তে ভারত ও বাংলাদেশের ৪ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে মানুষের মিলন মেলায় পরিণত হয় এই দিনটি। প্রতি বছর পাথর কালীর মেলা বিজিবি ও বিএসএফের সম্মতিতে পাসপোর্ট ভিসা ছাড়াই এই সুযোগের সৃষ্টি হয়। কাঁটাতারের বেড়া তাদের আলাদা করে রাখলেও আবেগ পৌঁছে যায় দেশকালের সীমানা ওপারে। প্রতি ডিসেম্বর মাসের প্রথম শুক্রবার সকাল ১০টা থেকে বিকাল ৬টা পর্যন্ত চলে এই মিলন মেলা। সীমান্ত এলাকার স্থানীয়রা জানান, ভোর থেকে দুই দেশের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষেরা এসে জড়ো হয় সীমান্তে।দীর্ঘদিন ধরে বিচ্ছিন্ন থাকায় একে অপরের সঙ্গে মিলিত হবার এ সুযোগ হাত ছাড়া করতে চায় না কেউ। কাঁটাতারের দু’পাশে দুই দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আগতরা প্রতি বছর ২’দেশের স্বজনদের মিলন মেলায় পরিণত হয় এ জায়গা। ২’দেশের বিভিন্ন স্থানে থাকা যেসকল সাধারণ মানুষ টাকা পয়সার অভাবে পাসপোর্ট ভিসা করতে পারেন না তারা এই দিনটির অপেক্ষায় থাকেন। সারা বছর দু’দেশের মানুষ অপেক্ষা করে এই দিনটির জন্য আত্নীয়-স্বজনের সঙ্গে দেখা করতে। সকাল ১০টায় বিজিবি ও বিএসএফ কাঁটাতারের বেড়া বরাবর এলাকায় আগত লোকদের কথা বলার সুযোগ তৈরী করে দেন।যার জন্য অনেকে দুর দূরান্ত থেকে ভোর বেলায় চলে আসেন নির্ধারিত সীমান্তে।সকাল ১০ টার পরপরই দীর্ঘদিন পর নিকট আত্বীয়দের দেখতে পাওয়ার আনন্দে অশ্রু সিক্ত হয়ে পড়েন।এ সময় এক বিরল দৃশ্যের অবতারণা হয়। অনেকে দীর্ঘদিন পর স্বজনদের সঙ্গে দেখা হওয়ায় কান্নায় ভেঙে পড়েন। কাঁটাতারের দু'প্রান্ত থেকে হাজারো মানুষ তাদের প্রিয়জনদের জন্য বাড়ি থেকে আনা খাবারসহ নানা উপহার সামগ্রী বিনিময় করেন কাঁটাতারের উপর দিয়ে ছুঁড়ে দিয়ে। ভারতীয় অধিবাসীরা কাঁটাতারের পাশে এলে সেখানে বাংলাদেশের ও লাখো নারী পুরুষ সমবেত হয়। বাংলাদেশের ঠাকুরগাঁও,পঞ্চগড়, দিনাজপুর, রংপুর এবং ভারতের কোচবিহার, আসাম, দার্জিলিং, শিলিগুড়ি, জলপাইগুড়ি, কলকাতাসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে বাই সাইকেল, অটোরিক্সা, মাইক্রোবাস, মিনিবাস যোগে মেলা স্থলে এসে
হাজির হন তারা। মেলায় আসা আজগর নামের একজনের সাথে কথা বললে তিনি বলেন, ১০ বছর পর ছোট ভাইকে দেখে চোখে যেন আনন্দ বাঁধ মানছিল না, সে থাকে ভারতের জলপাইগুরি জেলার রায়গঞ্জ থানায়। হাজারো মানুষ কথা বলেছে এই দিনে তাদের প্রিয় স্বজনদের সাথে। ২’দেশের সীমারেখা কাটাতার দিয়ে আলাদা করা হলেও আলাদা করা যায়নি তাদের ভালবাসার টান,আত্মার টান। আবার কেউ প্রিয়জনের দেখা না পেয়ে বাড়ি ফেরে নিরাশ হয়ে, যেতে হয় চোখের পানি নিয়ে। কাঁটাতারের এপাশে বাংলাদেশের প্রান্তে ছোট বৌমা মায়াবতি ভারতীয় সীমান্তে ও শ্বাশুড়ী মুক্তিরাণী বাংলাদেশ সীমান্তে সঙ্গে নাতী নাতনি সবাই সবার সাথে কান্নাজড়িত কন্ঠে কথা বলছে। মুক্তিরাণী বলেন ৮ বছর পর ছেলে, বৌমা নাতি নাতনির দেখা পেলাম একে অপরকে জড়িয়ে ধরার ইচ্ছা থাকলেও পারছিনা। বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছে মাঝখানে কাঁটাতারের বেড়া। ভারতের মাকড় হাটে থাকা ছোট বোন রোজিনাকে দেখতে আসা দিনাজপুরের আবুল বাসার বলছিলেন, বোনকে একটু
ছুঁয়ে দেখার ইচ্ছে হচ্ছিল কিন্তু ছুতে পারছিলামনা। জড়িয়ে একটু চিৎকার করে কান্না করি তবে হয়তো দির্ঘদিনের জমে থাকা কষ্টগুলো থেকে একটু হাল্কা হতাম। পাথর কালীর মেলার সভাপতি নগেন কুমার পাল বলেন, হরিপুর উপজেলার অধিকাংশ এলাকা পাকিস্তান-ভারত বিভক্তির আগে ভারতের দক্ষিণ দিনাজপুর জেলার অধীনে ছিল। এ কারনে দেশ বিভাগের পর আত্মীয় স্বজনেরা দুই দেশে ছড়িয়ে পড়ে। তাই সারা বছর তারা আত্নীয় স্বজনের সঙ্গে দেখা সাক্ষাৎ করতে পারেনা। অপেক্ষা করে থাকে পাথর কালি মেলার জন্য।এই দিনেই তারা মনের কথা প্রকাশ করে মাঝখানে টাতারে বেড়া রেখে।

ভালো লাগলে নিউজটি শেয়ার করুন

© All rights reserved © 2011 VisionBangla24.Com
Desing & Developed BY ThemesBazar.Com