বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ০৫:৫৮ পূর্বাহ্ন

নতুন বইয়ের ঘ্রাণে মাতোয়ারা দেশ

নতুন বইয়ের ঘ্রাণে মাতোয়ারা দেশ

ভিশন বাংলা ডেস্কঃ বছরের প্রথম দিন নতুন বইয়ের ঘ্রাণে উচ্ছ্বসিত, উদ্বেলিত কোমলমতি শিক্ষার্থীরা। তাদের আনন্দে মাতোয়ারা দেশ। সারা দেশের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাঠ্যপুস্তক উৎসব উদযাপিত হয়েছে ১লা জানুয়ারি। বছরের প্রথম দিন বিদ্যালয় থেকে নতুন বই নিয়ে হাসিমুখে বাড়ি ফিরেছে শিক্ষার্থীরা। গতকাল মায়ের হাত ধরে স্কুলে এসেছে ছোট্ট সানিফা। নতুন বই নিয়ে তবেই ফিরবে বাড়ি। তাই অপেক্ষা। একসময় কাক্সিক্ষত মুহূর্ত এলো। শেষ হলো অপেক্ষার প্রহর। ছোট্ট সানিফা পেলো নতুন বই। বইগুলো হাতে নিয়েই ঝট করে বুকে চেপে ধরলো সে। বন্ধ হলো চোখ। জগতের সব ভাবনা-কোলাহল ভুলে নিমগ্ন হলো অনুভবের আবেশে। প্রচ- শীতে একটু উষ্ণতার জন্য ছোট শিশু যেমন মায়ের বুকের ওম নিতে তীব্রভাবে লুটিয়ে থাকে, তেমন করেই বইগুলো বুকে চেপে রাখলো সে। এভাবে স্থির রইলো কিছুক্ষণ। আরও কিছুক্ষণ। তারপর জানালার বন্ধ কপাটের মতো হঠাৎ খুলে ফেললো তার একটা। নাক গুঁজে দিলো সেখানে। লম্বা একটা টান, তৃপ্তির শ্বাস, অমোঘ প্রশান্তি নিয়ে পাশে দাঁড়ানো মায়ের হাতটা ধরে বললো, ‘মা’ বইয়ের গন্ধটা ঠিক তোমার মতো। চোখ ছলছল করে উঠলো মায়ের। মা কিছু বলতে গিয়েও বলতে পারলেন না। গলা বুজে এলো তার। মা তার আবেগ সংবরণ করে হাত বুলাতে থাকেন মেয়ের মাথায়। আর দাঁড়িয়ে থাকার কান্তি দূর হয় মেয়ের আনন্দ-উচ্ছ্বাস দেখে। নতুন বছরের প্রথম দিন গতকাল মঙ্গলবার, পহেলা জানুয়ারি রাজধানীর আজিমপুর গভর্নমেন্ট গার্লস হাইস্কুলের সুবিশাল মাঠে কেন্দ্রীয়ভাবে উদ্বোধন করা হয় পাঠ্যপুস্তক উৎসব-২০১৯ এর। এদিন সকালে যথাসময়েই এসে উপস্থিত হয়েছিলেন শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সদ্য জয়ী হওয়া সংসদ সদস্য নাহিদের মনেও তাই ছিলো বাড়তি আনন্দ। সুখের উল্লাস। তার হাত থেকেই ষষ্ঠ শ্রেণির নতুন বই নিয়েছে সানিফা হোসেন সাদিয়া। বই পাওয়ার পর তার প্রতিক্রিয়া, ‘খুব ভালো লাগছে। আনন্দ হচ্ছে।’ এদিন মন্ত্রীর হাত থেকে বই নিয়েছেন আরও অনেকেই। হাসিবুর রহমান, হৃদয়, শিউলি, রঞ্জনাসহ অন্যরা। তাদের অনুভূতি এক-অভিন্ন। ‘নতুন বছরে নতুন ক্লাসে উঠেছি। বছরের প্রথম দিনেই বই পেয়ে খুব খুশি লাগছে। আনন্দ হচ্ছে। নতুন ক্লাসে উঠছি বলে মনে হচ্ছে, বড় হয়ে গেছি।’ গতকাল মঙ্গলবার সারা দেশে একযোগে পালিত হয়েছে পাঠ্যপুস্তক উৎসব। তবে ৭ দিন আগেই উৎসবের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সদ্য শেষ হওয়া সংসদ নির্বাচনের কারণে যথাসময়ে বই উৎসব অনুষ্ঠিত হওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিলেও শেষ পর্যন্ত তা আর হয়নি। এ বছর নিয়ে মোট ১০ বছর ধরে বছরের প্রথম দিনই সারা দেশের শিক্ষার্থীরা বিনামূল্যে পেলো নতুন বই। এ বছর প্রাক-প্রাথমিক থেকে নবম শ্রেণি পর্যন্ত স্কুল, মাদ্রাসা ও ভোকেশনালের ৪ কোটি ২৬ লাখ ১৯ হাজার ৮৬৫ জন শিক্ষার্থীর হাতে তুলে দেয়া হলো মোট ৩৫ কোটি ২১ লাখ ৯৭ হাজার ৮৮২ নতুন বই। ঢাকার দুটি পৃথক ভেন্যুতে এবার পাঠ্যপুস্তক উৎসবের কেন্দ্রীয় অনুষ্ঠান ছিল। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের আয়োজনে রাজধানীর আজিমপুর গভর্নমেন্ট গার্লস হাইস্কুল এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের আয়োজনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় খেলার মাঠে।এদিন সকাল থেকেই আজিমপুর গভর্নমেন্ট গার্লস হাইস্কুলে আসতে শুরু করে রাজধানীর ২৬টি স্কুলের ৭ হাজার শিক্ষার্থী। তাদের সাথে ছিলেন ৩ হাজার শিক্ষক। আর অভিভাবকরা তো ছিলেনই। স্কুলের বিশাল মাঠের একপ্রান্তে সাজানো হয় এক মঞ্চ। আর মঞ্চের সামনে বসে থাকা হাজার হাজার শিক্ষার্থী কারো মাথায় ছিলো লাল ক্যাপ, কারো মাথায় সবুজ ক্যাপ। আর হাতে ছিলো বিভিন্ন বাণী সম্বলিত প্লাকার্ড-ফেস্টুন। বছরের প্রথম দিন পাওয়া নতুন বইতো ছিলোই। কিছুক্ষণ পরপর আনন্দে মেতে ওঠে শিক্ষার্থীরা হাতের নতুন বই উঁচু করে নাড়াতে থাকে। যা মোহনীয় এক দৃশ্যের সৃষ্টি করে। অনুষ্ঠান শুরু হয় জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশনের মাধ্যমে। বেলুন উড়িয়ে এ উৎসবের উদ্বোধন করেন শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ। পরে তিনি শিক্ষার্থীদের হাতে তুলে দেন নতুন বই। এ সময় শিক্ষামন্ত্রী বলেন, ‘শিক্ষায় পিছিয়ে পড়া দেশগুলোর জন্য বাংলাদেশ অনুকরণীয়। বিশ্বের কাছে আমরা এখন রোল মডেল। কেউ আমাদের এ অগ্রগতি থামাতে পারবে না। আমরা একসময় বিশ্বে নেতৃত্ব দিতে সক্ষম হবো।’ উপস্থিত সবাইকে নতুন বছরের শুভেচ্ছা জানিয়ে মন্ত্রী বলেন, ‘আজ আমাদের জন্য আনন্দের দিন, একটি ইতিহাস সৃষ্টিকারী দিন। বিনামূল্যে এত সংখ্যক বই বিতরণের এমন উদাহরণ বিশ্বের কোথাও আর নেই। আমরাই এতে সফল হয়েছি। প্রতিবছর জানুয়ারির ১ তারিখে সারা দেশের শিক্ষার্থীদের হাতে নতুন বই তুলে দেই। ২০১০ সালের পর একবারও এর ব্যত্যয় হয়নি। স্বাধীন দেশ বলে এটা সম্ভব হয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘বিরাট সম্ভাবনা নিয়ে আমরা এগুচ্ছি। আর নতুন বাংলাদেশের সম্ভাবনা বাস্তবায়নে নেতৃত্বে দিচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত রাষ্ট্রে পরিণত করার লক্ষ্যে এগিয়ে যাচ্ছি আমরা।’ নাহিদ বলেন, ‘আগামী ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হবে। আগামী দিনের বাংলাদেশ গড়ে তোলার নেতৃত্ব দেবে তরুণ প্রজন্ম। এর জন্য আমাদের শিক্ষার গুণগত মানকে বিশ্বমানে পৌঁছাতে হবে। আজকের এ তরুণ প্রজন্মই এ দেশকে বিশ্ব দরবারে উঁচু করে তুলে ধরবে।’ মন্ত্রী বলেন, আমরা তরুণ প্রজন্মের জন্য সবকিছু উজাড় করে দেবো। আমাদের এ প্রজন্ম কোনো অংশেই বিশ্বের কোনো অংশ থেকে পিছিয়ে নেই। আমাদের সৌভাগ্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার পর একটা যুগোপযোগী শিক্ষানীতি প্রণয়ন করতে পেরেছি। আমরা কাউকে পেছনে ফেলে যাবো না, সবাইকে নিয়ে সামনে এগিয়ে যাবো। সব ছেলে-মেয়েকে বিদ্যালয়ে নিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছি। আজকে ছেলে-মেয়ে সমতা আনতে পেরেছি। মাধ্যমিকে মেয়েরা ছেলেদের চেয়ে এগিয়ে গেছে।’ তিনি বলেন, ‘আমরা বিশ্বমানের শিক্ষা দিতে চাই। একই সঙ্গে নৈতিক মূল্যবোধ সম্পন্ন খাঁটি মানুষ তৈরি করতে চাই। আমরা সব শ্রম ও মেধা দিয়ে আমাদের সন্তানদের গড়ে তুলবো।মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব সোহরাব হোসাইনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে শিক্ষা মন্ত্রণালয়, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডসহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও শিক্ষকরা উপস্থিত ছিলেন। এদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় খেলার মাঠে আলাদাভাবে বই উৎসবের আয়োজন করে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। এ মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. আকরাম আল হোসেনের সভাপতিত্বে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রী মো. মোস্তাফিজুর রহমান ফিজার। তবে এ স্থানের উৎসবে হঠাৎ উপস্থিত হন কিক্রেটার সাকিব আল হাসান। তার আগমনে উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠে শিক্ষার্থীরা। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে প্রাথমিক ও গণশিক্ষামন্ত্রী মোস্তাফিজুর রহমান ফিজার বলেন, ‘বছরের শুরুর দিনই আমরা শিক্ষার্থীদের হাতে নতুন বই তুলে দিতে পারছি। যা আমাদের কাছে আনন্দের ও গর্বের। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে এই দেশ এগিয়ে যাচ্ছে বলেই সাফল্যের এই ধারা অমরা অব্যাহত রাখতে পারছি। তার নেতৃত্বে আমরা প্রাথমিক শিক্ষাকে আমরা উন্নত-সমৃদ্ধ পর্যায়ে নিয়ে যেতে চাই।’ উৎসবের এ আয়োজনে মাথায় রঙিন ক্যাপ আর ব্যাজ পরে অংশগ্রহণ করে লালবাগ, কোতোয়ালি, ডেমরা, সূত্রাপুর, মতিঝিলসহ রাজধানীর বিভিন্ন স্কুলের শিক্ষার্থী-শিক্ষক আর অভিভাবকরা।শিক্ষার্থী-শিক্ষক-অভিভাবকদের অনুভূতি : পাঠ্যপুস্তক উৎসবের এ আয়োজনে শিক্ষার্থীদেন পাশাপাশি উচ্ছ্বসিত-আনন্দিত হয়ে উল্লাস করতে গেছে শিক্ষক ও অভিভাবকদের। শিশুদের নতুর বই প্রাপ্তিতে খুশি তারাও। আজিমপুর গভর্নমেন্ট হাইস্কুলের ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্রী সুমাইয়া আক্তার জানায়, ‘খুব ভালো লাগছে। আজ থেকেই নতুন বই পড়বো। নতুন বইয়ের গন্ধ আমার বেশ ভালো লাগে। আশরাফাবাদ উচ্চবিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণির ছাত্র মাহমুদুল হাসান ও হৃদয় জানায়, ‘খুব ভালো লাগছে। বাসায় গিয়েই পড়া শুরু করবো।’ আইডিয়াল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক শিরিন আক্তার বলেন, ‘বছরের প্রথম দিনেই শিশু শিক্ষার্থীরা নতুন বই পাচ্ছে। ছোট্ট শিশুদের জন্য বিষয়টি খুবই আনন্দের। শিশুদের খুশিতে আমরাও খুব আনন্দ পাচ্ছি। আজিমপুর গভর্নমেন্ট হাইস্কুলে মেয়েকে সাথে নিয়ে উৎসবে এসেছিলেন অভিভাবক শিউলি আক্তার। তিনি অনুভূতি জানাতে গিয়ে বলেন, সত্যিই এটি খুব আনন্দের। মেয়ে বছরের প্রথম দিনই নতুন বই পেয়ে খুবই উচ্ছ্বসিত। মেয়ের সাথে আনন্দ লাগছে আমারও। লিপিকা বানু নামের এক অভিভাবক বলেন, মেয়ে তো গতকাল থেকেই মুখিয়ে ছিলো কখন বই পাবে। আজ বাসায় গিয়েই নতুন বই পড়তে বসে যাবে।’ রাজিবুল হাসান নামের আরেক অভিভাবক বলেন, ‘বার্ষিক পরীক্ষার পর বেশ কিছুদিন আরামেই কেটেছে। আজ থেকে আবার স্কুলে দৌড়ঝাঁপ শুরু হলো। তবে বই পাওয়ার আনন্দ সব ভুলিয়ে দিয়েছে।’

ভালো লাগলে নিউজটি শেয়ার করুন

© All rights reserved © 2011 VisionBangla24.Com
Desing & Developed BY ThemesBazar.Com