শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ০৫:৩১ পূর্বাহ্ন
করোনা মহামারির চলতি সময়ে স্বাস্থ্য খাতের অনিয়ম-অব্যবস্থাপনার বিষয়টি দেশের মানুষকে বিস্মিত করেছে। সঙ্গত কারণেই সবার নজর এখন এদিকে। কাকে সরিয়ে দেওয়া হচ্ছে, নতুন কাকে আনা হচ্ছে, অবস্থার পরিবর্তন হচ্ছে কি হচ্ছে না, দুর্নীতি-অনিয়ম-অব্যবস্থাপনা কিভাবে বন্ধ হবে তা নিয়ে চলছে আলোচনা। এ প্রেক্ষাপটে সাবেক স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রী এবং বর্তমানে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য ও খ্যাতিমান অর্থোপেডিক চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. আ ফ ম রুহুল হক কথা বলেছেন একটি জাতীয় দৈনিকের সঙ্গে। সাক্ষাৎকারটি হুবহু তুলে ধরা হল:
প্রশ্ন : দেশের স্বাস্থ্য খাত নিয়ে বর্তমানে যে পরিস্থিতি চলছে এ সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন কী?
রুহুল হক : শুধু করোনা মহামারির পরিস্থিতিই নয়, আগে থেকেই নানা ধরনের সমস্যা চলছিল। সরকারি চিকিৎসা ব্যবস্থাপনার প্রতি এক ধরনের আস্থাহীনতা তৈরি হয়েছিল। রাজধানীর বিশেষায়িত হাসপাতাল থেকে শুরু করে কমিউনিটি ক্লিনিক পর্যন্ত চমৎকার অবকাঠামো রয়েছে, যা বিশ্বের অনেক দেশেই নেই। কিন্তু এগুলোর ব্যবস্থাপনায় গলদ থাকায় মানুষ সরকরি হাসপাতাল ছেড়ে প্রাইভেটে ছুটছে। নানাভাবে হয়রানি হচ্ছে। আর করোনা মোকাবেলার ক্ষেত্রে শুরু থেকেই আমাদের পলিসিতে বিভিন্ন ভুল ছিল। ঠিক কোনো পলিসি ছিল কি না তা নিয়েও আমার সংশয় রয়েছে। আমার মতো কেউ কেউ যখন এগিয়ে গিয়েছিলাম বিভিন্ন পরামর্শ দিতে তখন পাত্তা দেওয়া হয়নি। সংসদীয় কমিটিতে আলোচনা তুললেও সেখানেও বিভ্রান্তিমূলক তথ্য দিয়ে ওই কমিটির অন্য সদস্যদেরও বিভ্রান্ত করা হয়েছে। ফলে পরে, এখন পর্যন্ত করোনা মোকাবেলার কোনো বিষয় নিয়ে সংসদীয় কমিটির আর কোনো বৈঠকও হয়নি। বারবারই মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে ভুল তথ্য দিয়ে ভুল পরামর্শ দেওয়া হয়েছে; যার ফলে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া যায়নি। অনেক বিশৃঙ্খল অবস্থা তৈরি হয়েছে।
প্রশ্ন : স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের পদত্যাগের বিষয়টি আপনি কিভাবে দেখছেন?
রুহুল হক : পদত্যাগ করে ভালো করেছেন। তবে বিদ্যমান কাঠামো বহাল থাকলে শুধু চেয়ারের মানুষ পরিবর্তন করেই লাভ হবে না। প্রয়োজন স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার আমূল সংস্কার। কারণ দুর্নীতি-অব্যবস্থাপনা আর বিশৃঙ্খলার সুযোগ রয়ে গেছে বর্তমান কাঠামোর ভেতরেই। যদি একজন মন্ত্রী, সচিব, ডিজি বা পরিচালক পাল্টালেই সমস্যার সমাধান হয়ে যেত, তবে বছরের পর বছর, সরকারের পর সরকার দুর্নীতি-অব্যবস্থাপনা আর বিশৃঙ্খলা টিকে থাকত না।
প্রশ্ন : কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে মন্ত্রী বা মহাপরিচালকের (ডিজি) নানামুখী ব্যর্থতা-অযোগ্যতার অভিযোগ তুলে পদত্যাগের প্রশ্নটিই যেন বিভিন্ন মহল থেকে বড় হয়ে উঠেছিল; আপনি যদি এখন মন্ত্রী থাকতেন উদ্ভূত পরিস্থিতিতে আপনাকে পদত্যাগ নিয়ে প্রশ্ন করা হলে কী বলতেন?
রুহুল হক : (চটপট জবাব) আমি প্রশ্নের সুযোগই দিতাম না। এমন পরিস্থিতি হলে আগেই নিজ থেকে সরে যেতাম। কারণ পদ-পদবির চেয়ে সম্মানটি অনেক বড় হওয়া উচিত। বিভিন্ন মহলে, এমনকি সংসদেও যে ভাষায় ভর্ত্সনা করা হয়েছে তা শুনেও ওই পদে থাকা কঠিন। এ ছাড়া আমি এখন মন্ত্রী থাকলে করোনা শনাক্তে অবশ্যই অনেক পরীক্ষা করার ব্যবস্থা করতাম, যেটা শুরু থেকে না করে বড় ভুল হয়েছে। এটা করেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। তারা বারবার বলেছে বেশি পরীক্ষার প্রয়োজন হবে না। পরীক্ষাকেন্দ্র বাড়ানোর দরকার হবে না। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেগুলো করতে হলো। কিন্তু তত দিনে সংক্রমণ অনেক বেড়ে গেছে। আর এসব কাজের জন্য অপরিকল্পিতভাবে বা নিয়ম ভেঙে কেনাকাটাও হয়েছে।
প্রশ্ন : করোনা মোকাবেলায় সরঞ্জাম কেনাকাটার ক্ষেত্রে যে দুর্নীতি হয়েছে তা কিভাবে সামাল দেওয়া যেত বলে মনে করেন?
রুহুল হক : এটা খুব সহজ না হলেও আবার খুব কঠিন ছিল না। যেহেতু জরুরি কিছু কেনাকাটা করতে হবে তাই সেটি মাথায় রেখেই ক্লিন ইমেজের (স্বচ্ছ ভাবমূর্তির) কয়েকজন বিশেষজ্ঞ নিয়ে একটি কমিটি করে তাদের দিয়ে কেনাকাটা করালেই হতো। তাতে দুর্নীতি একদম বন্ধ করা না গেলেও যা হয়েছে এতটা কিছুতেই হতো না। যেভাবে প্রকৃত দামের চেয়ে একেকটি পণ্য কয়েক গুণ বেশি দামে কেনা হয়েছে, আবার নকল সুরক্ষা দিয়ে মানুষকে মেরে ফেলেছে, এটা মেনে নেওয়া যায় না।
প্রশ্ন : স্বাস্থ্য খাতের যেকোনো ক্রয়সংক্রান্ত কাজই তো সব সময় সিন্ডিকেটের হাত থাকে। এই সিন্ডিকেট কি ভাঙা সম্ভব নয়?
রুহুল হক : আমি আগেই বলেছি আমাদের সিস্টেমের (ব্যবস্থার) ভেতর দুর্নীতি ও সিন্ডিকেটের সুযোগ করে দেওয়া আছে। ফলে সব সরকারের সময়ই এগুলোর জাল বিস্তার করা থাকে। আমি যখন মন্ত্রী ছিলাম আমিও চেষ্টা করেছিলাম এই সিন্ডিকেট ভাঙতে, কিন্তু পারিনি। আমার আগে ও পরে যাঁরা ছিলেন তাঁরাও পারেননি। যদি সিস্টেম পাল্টানো না হয় তবে সামনে যাঁরা আসবেন তাঁরাও হয়তো পারবেন না।
প্রশ্ন : কিভাবে দুর্নীতির সুযোগ রয়েছে সিস্টেমের ভেতরে?
রুহুল হক : এই যে বড় কোনো যন্ত্রপাতি কিনলেই বিভিন্ন কম্পানির এজেন্ট বা দালালদের মাধ্যমে কিনতে পারা যায়, যারা মধ্যস্বত্বভোগী হিসেবে দুই টাকার জিনিস ১০ টাকা দাম ধরে দেয়। আর এগুলো যারা মন্ত্রণালয় বা অধিদপ্তরে ঠিকঠাক করে দেয়, তাদের জন্য তো কিছু ভাগ করে রাখা হয়। সিএসএসডি থেকেই মূল কাজগুলো হয়। এ ক্ষেত্রে যদি এজেন্টদের কাছ থেকে কেনার সিস্টেম বাদ দিয়ে সরাসরি প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে কেনার বিধি রাখা হয় তবে একদিকে যেমন দালাল থাকবে না, মধ্যস্বত্ব খরচ দিতে হবে না, দামও প্রকৃত থাকবে। কখনো ভালো কোনো কম্পানি নিজেদের সুনাম নষ্ট করতে দুই টাকার জিনিস ১০ টাকায় বিক্রি করতে আসবে না। ফলে দুর্নীতি ও অনিয়ম এমনিতেই কমে যাবে। দৌরাত্ম্যও কমবে। আর ওই সিন্ডিকেটের সঙ্গে বাইরে রাজনৈতিক বা অরাজনৈতিক যেসব অদৃশ্য প্রভাব থাকে, সেটাও অটোমেটিক বন্ধ হবে।
প্রশ্ন : আপনি যে কাঠামোগত সংস্কারের কথা বললেন সেটা কেমন?
রুহুল হক : হ্যাঁ, আমি এখন এই সংস্কারের ওপর খুবই জোর দিচ্ছি। এ ক্ষেত্রে প্রস্তাব হচ্ছে—স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব থেকে শুরু করে একেবারে উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা পর্যন্ত স্বাস্থ্য ক্যাডারের পদায়ন থাকবে; যাঁরা চিকিৎসক হলেও রোগী দেখবেন না বা স্বাস্থ্য শিক্ষা পড়াতে যাবেন না; কিন্তু স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে থাকবেন বিভিন্ন স্তরে। কোথায় কী প্রয়োজন, কোথায় কী অবস্থা সেটি সহজে বুঝতে পারবেন, স্বাস্থ্য খাতের বাজেট তৈরি এবং প্রয়োজন অনুসারে ব্যবস্থা নিতে পারবেন। আর যাঁরা রোগী দেখবেন বা পড়াবেন তাঁরা সেদিকেই থাকবেন। তাঁরা স্বাস্থ্য প্রশাসনের কোনো পদে আসবেন না। এতে দুই দলের স্ব স্ব ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় দক্ষতা ও যোগ্যতা থাকবে মাঠ পর্যায় থেকে একেবারে ওপর পর্যন্ত।
সৌজন্যে: কালের কণ্ঠ