শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১০:২২ পূর্বাহ্ন

স্কুলের কোচিংয়ে পাশের গ্যারান্টি রক্ষা করতে প্রশ্ন ফাঁস

স্কুলের কোচিংয়ে পাশের গ্যারান্টি রক্ষা করতে প্রশ্ন ফাঁস

নিজস্ব প্রতিবেদক:  স্কুলের কোচিংয়ে পাশের গ্যারান্টি রক্ষা করতেই কুড়িগ্রামের ভুরুঙ্গামারীতে চলমান এসএসসি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে। শুধু এবারই নয় কয়েক বছর ধরে এমন ঘটনা ঘটিয়েছে প্রধান শিক্ষক লুৎফর রহমান। প্রশ্ন ফাঁস করে অর্থ আয় ছাড়াও অন্য স্কুলের চেয়ে ভালো ফল ছিল তার টার্গেট। প্রশ্নপত্রের মোড়ক পরিবর্তন হওয়ায় এবার পুরো প্যাকেট নিতে গিয়ে বিষয়টি জানাজানি হয়।

স্কুলে অতিরিক্ত ক্লাসের নামে শিক্ষার্থীদের বাধ্যতামূলক স্কুলে কোচিং করতে বাধ্য করতো কোচিং সংশ্লিষ্ট শিক্ষকরা। এর জন্য অতিরিক্ত টাকা দিতে হতো শিক্ষার্থীদেরকে। সেই টাকার শতকরা ১০ টাকা হারে পেতেন প্রধান শিক্ষক লুৎফর রহমান। স্কুলের ভেতর দুটি কোচিং এর সমন্বয় করতেন শিক্ষক যোবায়ের।

সরেজমিন গিয়ে দেখা গেছে, নেহাল উদ্দিন বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে কয়েকজন শিক্ষক উপস্থিত। কথা হয় তাদের সঙ্গে। কিন্তু কেউই নাম প্রকাশ করতে চাননি। শিক্ষকরা জানান, সকাল সাতটা থেকে সাড়ে নয়টা পর্যন্ত স্কুল ভবনে অতিরিক্ত ক্লাস নেয়া হতো। এছাড়া স্কুল ছুটির পরও নেয়া হতো কোচিং ক্লাস। পরীক্ষাকালেও এ ঘটনার আগ পর্যন্ত দুপুর ২টা থেকে ক্লাস নিতেন তারা। ষষ্ট শ্রেণি থেকে সকল শিক্ষার্থীকে বাধ্যতামূলক কোচিং করতো হতো। না হলে তাদের পরীক্ষার ফল খারাপ করে দেয়া হতো।

 

ওই বিদ্যালয়ের গণিত বিভাগের সহকারী শিক্ষক লুৎফর রহমান বলেন, কোচিং ছিল না। ভালো ফলের জন্য অতিরিক্ত ক্লাস নেয়া হতো। সেখানে ক্লাস নিতেন চার শিক্ষক। তারা হলেন, হামিদুল, রাসেল, যোবায়ের ও আল মামুন সোহেল। শিক্ষক হারুন অর রশিদ জানান, বিষয়গুলো আমরা কখনও জানতাম না। আমাদের দায়িত্ব দিত কক্ষ পরিদর্শকের। আমরা এর বেশি কিছু জানতাম না। কখনও জানার চেষ্টা করিনি।

 

আরও কয়েকজন শিক্ষক জানান, প্রশ্ন ফাঁস নিয়ে গ্রেপ্তার হওয়ার আগের দিন পর্যন্ত দুপুর দুইটার পর থেকে কোচিং চলতো। তারা আটক হওয়ার পর থেকে বন্ধ রয়েছে।

 

 

 

স্কুলের একটু দূরে কয়েকজন অভিভাবকের সঙ্গে কথা হয়। তাদের দু’জনের মেয়ে ওই স্কুল থেকে এসএসসি পরীক্ষা দিচ্ছে। তারা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, মাসে তিন হাজার টাকা নিয়ে তারা অতিরিক্ত ক্লাস নিতো। ভর্তির সময় প্রধান শিক্ষকসহ সংশ্লিষ্ট শিক্ষকরা ভালো ফলাফলের গ্যারান্টি দিতো। এজন্য অন্য স্কুল রেখে অনেকে এখানে মেয়েকে ভর্তি করান। দূর থেকেও অনেকে মেয়েকে বাসা বা হোস্টেলে রেখে এই স্কুলে পড়াচ্ছেন।

 

নেহাল উদ্দিন বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা পরীক্ষা দিচ্ছে ভুরুঙ্গামারী সরকারি পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রে। সেখানে গেলে প্রধান শিক্ষক প্রশ্ন ফাঁস নিয়ে কথা বলতে চাননি। তিনি বলেন, এ ঘটনায় শিক্ষার্থীদের অনেক ক্ষতি হলো। অনেকে ভয় পেয়ে যাবে। বলেন, সকালে জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা এসেছিলেন। ওনার সঙ্গে কথা বলেছি।

 

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কয়েকজন প্রধান শিক্ষক চলমান ঘটনায় নাম প্রকাশ করতে চাননি। বলেন বোর্ডের ব্যাপার। আমরা কথা বলতে চাই না। তবে তারা কিছু তথ্য দেন। এক প্রধান শিক্ষক বলেন, কেন্দ্রে অন্য প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা হলে অনেকে পরীক্ষার্থীদের ডিস্টার্ব করতেন। যাতে তাদের ফল খারাপ হয়। তার স্কুলের ফল ভালো দেখাতে পারলে শিক্ষার্থী সংখ্যা বাড়বে, একই সঙ্গে অর্থ আয় হবে। প্র্যাকটিক্যাল পরীক্ষাতেও নম্বর কম দেয়ার অভিযোগও করেন নেহাল উদ্দিন বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকসহ সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে। এবারে ফাঁস হওয়া প্রশ্ন উপজেলা ছাড়াও অন্য জেলায় যেতে পারে বলেও তাদের ধারণা।

 

 

 

প্রশ্নফাঁসের ঘটনায় বিতর্কে পড়েছে প্রশ্নপত্র সংরক্ষণ ও সরবরাহ পদ্ধতি। কয়েকজন শিক্ষক বলেন, একদিনে অনেক প্রশ্নপত্রের প্যাকেট যাচাই-বাছাই করতে হয়। সে তুলনায় লোকজন খুব কম থাকে। এতে সহজে প্রশ্নপত্র ফাঁসের সুযোগ থাকে। লোকজন বাড়ানো দরকার।

 

বুধবার দিনাজপুর বোর্ডের গণিত, পদার্থ বিজ্ঞান, রসায়ন বিজ্ঞান ও কৃষি বিজ্ঞান বিষয়ে পরীক্ষা সাময়িক স্থগিত করা পরীক্ষার নতুন রুটিন বৃহস্পতিবার প্রকাশ করে শিক্ষা বোর্ড। আগামী ১০-১১-১৩ ও ১৫ অক্টোবর এবং ব্যবহারিক পরীক্ষা হবে ১৬ থেকে ২০ অক্টোবর। বৃহস্পতিবার বিকেলে জীববিজ্ঞান ও উচ্চতর গণিত বিষয়ের প্রশ্নপত্র বাতিল করে শিক্ষা বোর্ড।

 

এজাহার ও বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা গেছে, নেহাল উদ্দিন বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ওই কেন্দ্রের কেন্দ্রসচিব লুৎফর রহমান বাংলা প্রথম পত্রের পরীক্ষার দিন এবং ইংরেজি প্রথম পত্র পরীক্ষার দিন ছয়টি বিষয়ের প্রশ্ন পত্রের প্যাকেট নেন গোপনে। পরে তার কোচিংয়ের শিক্ষক যোবায়ের, সোহেল, হামিদুল ও রাসেলকে দিয়ে হাতে লিখে প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীসহ বিভিন্ন এলাকায় টাকার বিনিময়ে হাতে লেখা প্রশ্ন সরবরাহ করতেন।

 

বিষয়টি জানাজানি হলে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে অভিযোগ করেন অনেকে। এ অভিযোগের ভিত্তিতে ইংরেজি প্রথম পত্র পরীক্ষা শুরুর আগে কেন্দ্রে গিয়ে জানতে পারেন অফিস কক্ষ রেখে ভবনের দ্বিতীয় তলায় প্রশ্নপত্র খোলা হয়েছে সেদিন। বিষয়টি জেনেও চেপে যান ইউএনও।

 

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা দীপক কুমার দেব শর্মা বলেন, ওইদিন গিয়ে প্রশ্ন দোতালায় দেখেছি। তাদের বলা হয়েছে এরপর থেকে যেন অফিসে প্রশ্নপত্রের প্যাকেট খোলেন তারা। এরপরই তিনি ব্যস্ত বলে ফোন রেখে দেন।

 

ইতোমধ্যে প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনায় ভূরুঙ্গামারী থানায় মামলা দায়ের করেছেন কেন্দ্রের দায়িত্বপ্রাপ্ত ট্যাগ কর্মকর্তা উপজেলা মৎস্য অফিসার আদম মালিক চৌধুরী। মামলায় নেহাল উদ্দিন বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের পাঁচ শিক্ষকসহ এক কর্মচারীকে গ্রেপ্তার করে জেল হাজতে পাঠিয়েছে ভুরুঙ্গামারী থানা পুলিশ।
আটকরা হলেন- ওই কেন্দ্রের কেন্দ্র সচিব প্রধান শিক্ষক লুৎফর রহমান, ইংরেজি শিক্ষক রাসেল মিয়া, ইসলাম শিক্ষার শিক্ষক যোবায়ের হোসেন, কৃষি বিষয়ের শিক্ষক হামিদুর রহমান, বাংলা বিষয়ের শিক্ষক সোহেল আল মামুন এবং স্কুলের পিয়ন সুজন।

 

 

 

এদিকে স্থানীয় শিক্ষা সংশ্লিষ্ট ঘটনার সঙ্গে উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা আব্দুর রহমানের সংশ্লিষ্ট থাকার অভিযোগ ওঠে। একই সঙ্গে ট্যাগ অফিসারের মামলার বাদী হওয়া নিয়েও নানা সমালোচনা হয়। বৃহস্পতিবার বিকেলে উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা আব্দুর রহমানকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। কুড়িগ্রাম সদর উপজেলা সহকারী মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা সাজ্জাদ হোসেনকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। এতে উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তার সংশ্লিষ্টতা বিষয়টি অনেকটা নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে।

 

অন্যদিকে দিনাজপুর শিক্ষা বোর্ডের কলেজ পরিদর্শক প্রফেসর ফারাজ উদ্দিন তালুকদারকে প্রধান ও উপ-পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক (উমা) প্রফেসর মো. হারুন অর রশিদ মণ্ডল এবং মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের রংপুর অঞ্চলের উপ-পরিচালক মো. আক্তারুজ্জমানকে সদস্য করে করা শিক্ষা বোর্ডের তদন্ত দল বৃহস্পতিবার বিকেলে ভূরুঙ্গামারীতে আসেন। তারা ঘটনাস্থলে যাননি। জেলা পরিষদ ডাকবাংলোয় বসে সংশ্লিষ্ট অনেকের সঙ্গে কথা বলেন প্রায় ঘণ্টাখানেক।

 

এদিন সকালে জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা শিক্ষকদের তথ্য নিতে ঘটনাস্থলে তদন্ত করেন। জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা মো. শামছুল আলম বলেন, আমার ডিজির নির্দেশে যেসব শিক্ষক ও কর্মচারী ইতোমধ্যে গ্রেপ্তার হয়েছেন তাদের প্রাতিষ্ঠানিক কিছু তথ্য সংগ্রহ করতে এসেছি। সেসব তথ্য নিলাম। এগুলো পাঠানোর পর তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।

 

তিনি আরও বলেন, প্রমাণিত হলে শিক্ষক ও কর্মচারীদের ইনডেক্স ডিলেট হতে পারে। তাদের বেতন বন্ধ হতে পারে। চাকরিও যেতে পারে।

 

বিদ্যালয়ের ভেতরে কোচিং বাণিজ্যের বিষয়ে জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা বলেন, সেটাও শুনলাম। তারা দুইভাগে সেখানে কোচিং চালাতো। মূলত কোচিং নিয়ে তারা প্রশ্ন ফাঁস করেছে।

 

এ বিষয়ে বরখাস্ত হওয়া উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তার সঙ্গে একাধিকবার মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলেও তাকে পাওয়া যায়নি। ঘটনার পর থেকে তিনি গা-ঢাকা দিয়েছেন বলে জানা গেছে।

 

ভুরুঙ্গামারী থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) আলমগীর হোসেন বলেন, প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনায় সংশ্লিষ্ট ছয়জনকে গ্রেপ্তার করে আদালতে পাঠানো হয়েছে। আদালত তাদেরকে জেলহাজতে পাঠিয়েছে।

 

 

 

এজাহার নামীয় একজন এখনও পলাতক রয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, আরও একাধিক নাম পাওয়া গেছে।

ভালো লাগলে নিউজটি শেয়ার করুন

© All rights reserved © 2011 VisionBangla24.Com
Desing & Developed BY ThemesBazar.Com