শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ১০:১২ অপরাহ্ন
বিশেষ প্রতিবেদক :
বীমা আইন লঙ্ঘন করায় তাকাফুল ইসলামী ইন্স্যুরেন্স লিমিটেডের বিষয় কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে যাচ্ছে বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ। আইডিআরএ’র সদস্যরা বলছেন, নিয়োগ অনিয়ম, বাকী ব্যবসা, অতিরিক্ত কমিশিন, ডামি নিয়োগ, অর্থ আত্মসাৎ, অপরাধ আর জালিয়াতির এসব অভিযোগ প্রমাণ হলে প্রতিষ্ঠানকে আইনগত শাস্তির মুখে পড়তে হবে। সুশাসন ও উন্নয়ন এবং বীমা খাতের স্বার্থ সুরক্ষায় যেকোন কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন তারা।
মূলত, মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা পদে কাজী মোকাররম দাস্তগীরের নিয়োগ অনুমোদন নিয়ে আইডিআরএ’র সঙ্গে আইনগত জটিলতায় জড়িয়ে পড়ে বেসরকারী খাতের সাধারণ বীমা প্রতিষ্ঠান তাকাফুল ইসলামী ইন্স্যুরেন্স। যার ধারাবাহিকতায় প্রতিষ্ঠানটির বোর্ড মিটিংয়ে মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা কাজী মোকাররম দাস্তগীরের তিন বছরের নিয়োগ অনুমোদন বাতিলের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা পর্ষদ সদস্যরা। শুধুমাত্র চলতি বছর তাকে সিইও হিসেবে দায়িত্ব পালনের জন্য বলা হয়। কাজী মোকাররম দাস্তগীরের নিয়োগ নিয়ে বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষর সঙ্গে আইনী জটিলতা নিরসন নিয়ে বোর্ড সভা হয়। মঙ্গলবার সন্ধ্যায় রাজধানীর ধানমন্ডিতে প্রতিষ্ঠানটির পরিচালনা পর্ষদের অন্যতম প্রভাবশালী সদস্য আনোয়ার হোসেন খান এমপির বাড়িতে সভায়- এ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়।
সূত্র নিশ্চিত করেছে, দু’ঘন্টাব্যাপী সভায় মূখ্য-নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে কাজী মোকাররম দাস্তগীর-এর দায়িত্ব পালন নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হয়। তার নিয়োগ ইস্যুতে বাকবিতন্ডতায় জড়ান পরিচালকরা। প্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব ও কোন্দলের বিষয়টিও স্পষ্ট উঠে আসে আলোচনায়। এমডি নিয়োগে অনিয়ম, অতিরিক্ত কমিশন, বাকি ব্যবসা, ডামি নিয়োগ- এ সংক্রান্ত তথ্য গণমাধ্যমে কিভাবে প্রকাশিত হলো– তা নিয়েও ব্যাপক আলোচনা হয়। মিটিং থেকে এমডিকে গণমাধ্যম এড়িয়ে চলার নির্দেশও দেয়া হয়। একইসঙ্গে মোকাররম দাস্তগীরকে তিন বছরের জন্য নিয়োগ না দেয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। শুধুমাত্র চলতি বছর তাকে দায়িত্ব পালনের জন্য বলা হয়। এছাড়াও মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে মোকাররম দাস্তগীর-এর নিয়োগ সংক্রান্ত আইনগত জটিলতা নিয়ে আইডিআরএ-কে মোকাবেলার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে তাকাফুলের পরিচালনা পর্ষদ।
এ সময় প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান তাহমিনা আফরোজ, ভাইস চেয়ারম্যান এমদাদ উল হক চৌধুরী, ইসি কমিটির চেয়ারম্যান হুমাউন কবীর পাটোয়ারী, ক্লেইম কমিটির চেয়ারম্যান খোরশেদ আলম খান, অডিট কমিটির চেয়ারম্যান মাহদী হাসানসহ ১৮ জন সদস্য উপস্থিত ছিলেন।
এর আগে ২০২১ সালে কাজী মোকাররমকে ২ বছরের জন্য নিয়োগ অনুমোদন করে আইডিআরএ। তবে অনুমোদন চিঠিতে তিন মাসের মধ্যে পূর্বে কর্মরত প্রতিষ্ঠানের ছাড়পত্র বাধ্যতামূলক বলা হয়। কিন্তু কাজী মোকাররম ছাড়পত্র জমা দিতে ব্যর্থ হন। এভাবে ছাড়পত্রহীন চাকরী বীমা আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন, বলছেন খাত সংশ্লিষ্টরা।
বীমা বিশেষজ্ঞদের মতে, বীমা আইন অনুযায়ী নতুন প্রতিষ্ঠানে যোগদানের ক্ষেত্রে ছাড়পত্র বাধ্যতামূলক। আইডিআরএর শর্ত লঙ্ঘিত হলে ‘এমডি পদ’ তার যোগ্যতা হারায়। বীমা আইন অনুযায়ী কাজী মোকাররমের এমডি হিসেবে দায়িত্ব পালনের কোন সুযোগ নেই। এ ক্ষেত্রে তাকে ছাড়পত্রহীন নিয়োগ দিয়ে আইন লঙ্ঘন করে তাকাফুল ইসলামী ইন্স্যুরেন্সের পরিচালনা পর্ষদ শাস্তিযোগ্য অপরাধে জড়িয়েছেন।
শুধু তাই নয়, এমডি হিসেবে তার দু’বছরের দায়িত্ব পালন শেষ হওয়ার পর আরো অতিরিক্ত এক বছর নবায়নের জন্য আইডিআরএ বরাবর চিঠি ইস্যু করে তাকাফুল কর্তৃপক্ষ। সেই চিঠি বিপরীতে এক বছর নবায়ন বাতিল করে গত ৩০ এপ্রিল তাকাফুলকে চিঠি দেয় আইডিআরএ। চিঠিতে এক বছরের নিয়োগ বাতিল করে তিন বছরের নিয়োগের সকল কাগজপত্র জমা দেয়ার জন্য বলা হলেও, বোর্ড মিটিং চলতি বছর দায়িত্ব পালনের জন্য বলা হয়েছে। পূনরায় তিনি বছরের জন্য নিয়োগের আইডিআরএর চিঠি, সেই নির্দেশনাও উপেক্ষিত হয়েছে বোর্ড মিটিং এর সিদ্ধান্তে।
বীমা বিশ্লেষকরা বলছেন, মূলত গত ৩০ এপ্রিল আইডিআরএর পাঠানো নবায়ন বাতিলের চিঠির পর এমডি পদে দায়িত্ব পালনের বিষয়টি নিয়ে আইনগত সংকট তৈরী হয়েছে। কাজী মুকাররম দাস্তগীরের এক বৎসরের নিয়োগ আইডিআরএ অনুমোদন না-দেয়ায় মূলতঃ মূখ্য নির্বাহীর পদ শূন্য হয়ে যায়। তারপরও তিনি দিব্যি দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। তারা বলছেন, প্রথমত, ছাড়পত্রহীন চাকরী অবৈধ, এরপরও আবার নবায়নহীন দায়িত্ব পালন সুস্পষ্ট বীমা আইন বিরোধী। এভাবে পদে পদে আইন ভঙ্গ করে দিন দিন বেপরোয়া হয়ে উঠছে তাকাফুল এর পরিচালনা পর্ষদ। শুধুমাত্র এমডি নিয়োগ নয়– ডামি ব্যবসা, ভুয়া ব্যবসা, ভুয়া ক্লেইম পরিশোধ দেখিয়ে অর্থ আত্মসাৎ, অতিরিক্ত কমিশন, বাকি ব্যবসা, মালিকানা শেয়ার নিয়ে কেলেংকারীর মতো ভংয়কর সব অপরাধের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ইসলাম নামধারী এই সাধারণ বীমা প্রতিষ্ঠানটি।
বীমা কোম্পানির সিইও নিয়োগ ও আর্থিক অনিয়মের কারণে তাকাফুলের ভবিষৎ অবস্থা দিন দিন নিম্ন দিকে ধাবিত হচ্ছে। কাজী মোকাররম দস্তগীর ৩ বছর চাকুরীরত অবস্থায় অসংখ্যবার বীমা আইন লঙ্ঘন করে প্রতিষ্ঠানকে বিপদে ফেলেছেন। নানা অনিয়ম, অপকর্ম আর দূর্নীতিতে জড়িয়েছেন। তার বিরুদ্ধে স্বেচ্ছাচারিতা, অনিয়ম-দুর্নীতি-সুশাসনের ঘাটতিসহ নানা অভিযোগ তীব্র হলেও- এখনো কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা পর্ষদ। অপরাধের সঙ্গে যুক্ত এই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অধিকতর তদন্ত করে স্থায়ীভাবে বরখাস্তর পাশাপাশি আইনগত ব্যবস্থা গ্রহন করা উচিত।
কেন ছাড়পত্র দেয়া হয়নি– এমন প্রশ্নের জবাবে দেশ জেনারেল ইন্স্যুরেন্সের একাধিক সিনিয়র কর্মকর্তা বলেছেন, ‘‘ কাজী মোকাররম দীর্ঘ বছর দেশ জেনারেল ইন্স্যুরেন্সের সিইওসহ একাধিক পদে দায়িত্ব পালন করেছেন। প্রতিষ্ঠানে তার পেইনডিং লেনদেন ছিলো। এসব হিসাব তিনি বুঝিয়ে দেননি। এমনকি তাকে এ সকল বিষয়ে একাধিকবার চিঠি দেয়া হয়েছে, পাশাপাশি এসব চিঠির অনুলিপি আইডিআরএ-কেও দেয়া হয়েছে। এরপরও কোন অর্থ ফেরত পায়নি দেশ জেনারেল ইন্স্যুরেন্স।’’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা ক্ষোভ প্রকাশ করে আরো বলেন, ‘‘আইডিআরএ-কে চিঠি দেয়ার পরও কোন অর্থ ফেরত পাওয়া যায়নি। কাজী মোকাররমের ছাড়পত্রও নেই। কিভাবে, কোন আইনে কাজী মোকাররম তাকাফুল ইসলামী ইন্স্যুরেন্সে এমডির দায়িত্ব পালন করেন, সেটাই বড় প্রশ্ন? এসব এমডি কিংবা আইনভঙ্গকারী বীমা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত।”
আইডিআরএর সাবেক সদস্য বলেন, ‘‘অপরাধ কিংবা আইন লঙ্ঘন প্রমান হলে যে কোন বীমা প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স বাতিল হতে পারে। আইডিআরএ’র অনুমোদন ছাড়া কোনো ব্যক্তির সিইও পদে যোগদান করা বীমা আইন এবং বীমা কোম্পানির সিইও নিয়োগ ও অপসারণ প্রবিধানমালার পরিপন্থী। আইডিআরএ’র অনুমোদন ছাড়া কেউ সিইও হিসেবে কাজ করতে পারবেন না। বেতন-ভাতাও নিতে পারবেন না। এ কারণে এমডি, চেয়ারম্যান এমনকি পরিচালনা পর্ষদ শাস্তির আওতায় আসতে পারেন।”
এ প্রসঙ্গে আইডিআরএ’র সদস্য বলেন, অনিয়ম খুঁজে বের করতে প্রয়োজনে বিশেষ অডিটের সিদ্ধান্ত নেয়া হতে পারে। অনিয়ম প্রমান হলে প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে যথাযথ আইনী পদক্ষেপ নেয়া হবে। প্রয়োজনে প্রশাসক নিয়োগ করা যেতে পারে।
আইডিআরএর অপর এক সদস্য বলেন, মূখ্য নির্বাহীর সর্বোচ্চ এ পদে অনিয়ম আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। কোন অন্যায়-অনিয়ম প্রমান হলে, সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে দোষীদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। প্রয়োজনে লাইসেন্স বাতিলের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হবে। আইডিআরএর নিয়োগ সংক্রান্ত বিষয়গুলো আরো খতিয়ে দেখা হবে। আইন লঙ্ঘন প্রমান হলে, প্রয়োজনে এমডির নিয়োগ বাতিল করা হবে। একইসঙ্গে প্রতিষ্ঠানকেও জবাবদিহিতার আওতায় নিয়ে আসা হবে।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ পুঁজিবাজার বিনিয়োগকারী ঐক্য পরিষদের পরিষদের সাধারণ সম্পাদক বলেন- ‘‘অর্থলোভীদের প্রতারণা, আত্মসাতসহ নানা অনিয়ম নিয়ে আগামী এজিএম মিটিংয়ে প্রকাশ্যে জানতে চাওয়া হবে। প্রাতিষ্ঠানিক কিংবা আর্থিক অনিয়মে কোন কর্মকর্তা-কর্মচারী জড়িত থাকলে তার বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেয়া হবে, অপরাধীর ঠিকানা হবে জেলখানা।’
বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের এডভোকেট মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘‘একটি গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদের রেফারেন্স নিয়ে তাকাফুল ইসলামী ইন্স্যুরেন্স এর চেয়ারম্যান, পরিচালনা পর্ষদ, সিইও, সিএফও এবং কোম্পানী সেক্রেটারীসহ উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে মামলা করার আইনগত বৈধতা যাচাই করতে শেয়ার হোল্ডার পরিচয়ে একাধিক ব্যক্তি এসেছিলেন। আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে সংক্ষুব্ধ ব্যক্তিদের মামলা করার আইনগত অধিকারের বিষয়টি খতিয়ে দেখা হবে। দেশের অর্থনীতি এবং বীমা খাতের স্বার্থ রক্ষায় প্রয়োজনে আমরা আইনী সহায়তা দিবো।’’
বিষয়গুলো নিয়ে ভিশন বাংলার প্রতিনিধির সঙ্গে শনিবার দুপুরে কথা বলেন কাজী মোকাররম দাস্তগীর। তিনি বলেন, ‘‘আমি এমডি আছি, এমডি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছি। নিয়োগ সংক্রান্ত জটিলতা এটা আমার কোন বিষয় নয়। বোর্ড মিটিং-এ সিদ্ধান্ত হয়েছে, এমডি হিসেবে দায়িত্ব পালন করবো। আমার নিয়োগ সংক্রান্ত বিষয় আইডিআরএর সঙ্গে তাকাফুল ইন্স্যুরেন্সের বোর্ড দেখবে। এক্ষেত্রে আমার কোন দায়-দায়িত্ব নেই।’’
তবে অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘‘বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। এক্ষেত্রে কোন আইন লঙ্ঘন বা অনিয়ম হয়নি।’’
প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান ও ইসি কমিটির চেয়াম্যানের বক্তব্য নিতে চাইলে কেউ মুঠো ফোন রিসিভ করেননি।